শরীরে ৭ বুলেট: তীব্র যন্ত্রণায় দিন কাটছে সুজনের
খালেদ মাহমুদ সুজন (২৫) শরীরে ৭ গুলি নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। বুলেট নিয়ে এখনো বেঁচে থাকলেও শরীরের বামপাশ অবশ (প্যারালাইজড) হয়ে গেছে তার। চলতে পারছেন না অন্যের সাহায্য ছাড়া।
এ অবস্থায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সুজন, তার পরিবারের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন। প্রতিবন্ধী বাবা ও প্রতিবন্ধী ভাইসহ মোট ৫ সদস্যের পরিবার সুজনের। পরিবারকে দেখার মতো আর কেউ নেই।
গত ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এখন অভাব অনটনে চলছে সুজনের সংসার। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তার চিকিৎসাও। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছেন, দেশের কোনো হাসপাতালেই সুজনের শরীর থেকে ৭টি গুলি বের করা সম্ভব না।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) সুজনদের বাড়ি গিয়ে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।
এ সময় সুজন জানান– তার ঘাড়ে ১টি, বুকে ২টি, ডান হাতে ৩টি, কানের নিচে ১টিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ৭টি গুলি রয়েছে। শরীরে গেঁথে যাওয়া ৯টি বুলেটের মধ্যে অপারেশনের মাধ্যমে মাত্র দুটি গুলি বের করা গেছে।
গুলিবিদ্ধ খালেদ মাহমুদ সুজন, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রুহিতা ইউনিয়নের রসুলগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ৪ নং ওয়ার্ড তাজল ইসলাম ভূঁইয়া বাড়ির বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শাহীন কাদিরের ছেলে। বড় ভাই সোহান হোসেনও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তার উপার্জনে পরিবারের ৫ সদস্যের পরিবার চলতো। লক্ষ্মীপুর শহরে মা ফার্নিচার হাউজ নামে ছোট একটি ব্যবসা রয়েছে তার। অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ স্ট্যাডি সেন্টারে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত তিনি।
সুজনের চাচা কফিল উদ্দিন ও চাচাতো বোনের স্বামী মোবারক হোসেন জানান, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র বাবার পক্ষে সুজনের চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব না। ফলে এখন তাদের পরিবার অন্ধকারে। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছোট ভাইয়ের পড়াশোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সুজন বলেন, "ফেসবুকে আন্দোলন দেখে গত ৪ আগস্ট তারিখে লক্ষ্মীপুর মাদাম ব্রিজ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেই।"
"বেলা ৪টা ২০-২৫ মিনিটের দিকে মিছিল নিয়ে লক্ষ্মীপুর শহরে অবস্থিত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসার সামনে গেলে ছাদের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়েন স্বয়ং উপজেলা চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু," দাবি করেন সুজন।
এ সময় প্রায় শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন বলেও জানা তিনি। তার শরীরের বিভিন্ন অংশেও ৯টি গুলি লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সুজন। একই দিন গুলিতে মারা যান ৪ আন্দোলনকারী।
পরে আন্দোলনকারী সহযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।
চাচাতো বোনের স্বামী মোবারক হোসেন বলেন, "গুলিবিদ্ধ সুজনকে হাসপাতালে দেখার মতো পরিবারের কেউ ছিল না। তাই আমি সদর হাসপাতালে ছুটে যাই।"
কিন্ত সদর হাসপাতালে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের হামলার আশঙ্কা সুজনকে শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান তিনি।
সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে নোয়াখালীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওই হাসপাতাল গুলিবিদ্ধ সুজনকে ভর্তি নেয়নি। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারশনের মাধ্যমে তার লিভার থেকে চিকিৎসকরা পিতলের বড় একটি গুলি বের করেন বলে জানান মোবারক হোসেন।
সুজন বলেন, "ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৮ দিন থাকার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সিএমএইচ হাসপাতালে অপারেশন করে আমার হাতের একটি গুলি বের করা হয়। সিএমএইচে চিকিৎসরা জানিয়েছে আমার শরীরে বর্তমানে যে ৭টি গুলি রয়েছে, সেগুলো তারা বের করতে পারবেন না। বিদেশে চিকিৎসার মাধ্যমে তা বের করা যেতে পারে।"
"৩০ দিন পর আমি সিএমএইচ ত্যাগ করি। সুজন বলেন আমার ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাড়ি ও গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছেন।"
সুজন বলেন, "এখন একদিকে আমার উপার্জন বন্ধ, অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকা দরকার। কিন্ত আমাকে দেখার মতো কেউ নেই। কোনো টাকা পয়সা নেই। সংসার চলছে না।"
"৫ সদস্যের পরিবারে বাবা এবং বড় ভাই প্রতিবন্ধী; কোনো কাজ ও উপার্জন করতে পারেন না। ছোট ভাই ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। তার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখন আমি কি চিকিৎসার ব্যয় চালাবো না–কি সংসার?," আক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন রাখেন দিশাহারা সুজন।
স্বাভাবিক জীবনে কখন ফিরতে পারবেন, তা জানেন না এই তরুণ। জানালেন, "ওইদিনের ঘটনায় আমাদের বাড়ির আশপাশের আরও প্রায় ১০-১৫ জন আহত হয়।"
দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন বলেন, "এখন আমার প্রধান চাহিদা চিকিৎসা ও পরিবারের ৩ বেলা খাবার। মামলা করবো কিনা জানি না। শুনেছি মামলা নিয়ে বাণিজ্যও হচ্ছে।"
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক জয়নাল আবেদিন জানান, "সুজনের দেহের প্রতিটি গুলি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কোনো কারণে শরীরে ইনফেকশন দেখা দিলে নিশ্চিত প্রাণহানি ঘটতে পারে। দ্রুত তার শরীর থেকে গুলিগুলো বের করা দরকার। এরজন্য হয়তো বিদেশে নেওয়া লাগতে পারে।"
জেলার পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, "বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকজনকে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।"
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) রাজীব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, "বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। আমরা তাদের পরিবারের পাশে আছি।"