মদ বিক্রিতে বছরের পর বছর মুনাফা ধরে রেখেছে কেরু
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) আওতাধীন এক ডজনেরও বেশি কোম্পানি যখন অনেকটা 'শ্বেতহস্তী'তে (লোকসানে পড়েছে) পরিণত হয়েছে, তখন বছরের পর বছর ধরে ডিস্টিলারি ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগোচ্ছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মদ উৎপাদনকারী কোম্পানিটি— যা আগের বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, শুধুমাত্র ডিস্টিলারি ব্যবসা থেকেই প্রায় ১৫০ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে কেরুর; তবে চিনি ইউনিটে প্রায় ৬০ কোটি টাকা লোকসানের কারণে মোট মুনাফা কমে ১০০ কোটি টাকার নিচে দাঁড়িয়েছে।
মূলত দাম বৃদ্ধির কারণে মুনাফা বেড়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। যদিও কোম্পানির রাজস্ব গত বছরের ৪৭৫ কোটি টাকা থেকে কিছুটা কমে এ বছর ৪৫৯ কোটি টাকা হয়েছে।
কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কড়াকড়ির কারণে বিদেশি মদের আমদানি কমেছে, তাই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মদের চাহিদা বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।"
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ২০২১ সালে বিদেশি মদ আমদানির ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি শুরু করে এনবিআর; যার প্রভাবে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়, হ্রাস পায় বিদেশি মদের আমদানি। আর এতে বিক্রি বেড়ে যায় কেরুর বিক্রি।
প্রতিষ্ঠানটির ডিস্টিলারি ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, চলতি ২০২৪ সালের জুন নাগাদ কেরুর স্পিরিট এবং অ্যালকোহল উৎপাদন সামান্য বেড়ে ৬০ লাখ প্রুফ লিটারে পৌঁছেছে। ২০২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৫৯ লাখের চেয়ে একটু বেশি। 'প্রুফ' শব্দটি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের মধ্যে অ্যালকোহল উপাদানের পরিমাপ বোঝাতে করতে ব্যবহৃত হয়।
চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত দেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী ডিস্টিলারি প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড তার বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটিই কেরুর চিনিগুড়া থেকে উৎপাদিত সর্বোচ্চ পরিমাণ স্পিরিট এবং অ্যালকোহলের উৎপাদন।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসান বলেন, "যাত্রা শুরুর পর থেকে এত পরিমাণ লাভের মুখ দেখেনি কেরু। গত কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মদের উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে।"
তিনি বলেন, "কর্পোরেট ট্যাক্সেশনের আগে, কোম্পানির মুনাফা ১১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল; তবে ট্যাক্সের পরে নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৮৫ কোটি টাকায়; আগের অর্থবছরে এই মুনাফা ছিল ৬৪ কোটি টাকা।"
রাব্বিক হাসানের মতে— ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে, গণ-অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে কেরুর স্পিরিট এবং অ্যালকোহল উৎপাদন সামান্য হ্রাস পেয়েছে।
তবে চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ডিস্টিলারি ইউনিট সম্পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
চিনি ইউনিটে লোকসান অব্যাহত
দেশের প্রাচীনতম চিনি প্রস্তুতকারকদের মধ্যে অন্যতম কেরু অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ সালে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭৩ সালে সরকার ডিস্টিলারিটিকে জাতীয়করণ করে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্য চিনি সংস্থাগুলোর মতো কেরুর চিনি ইউনিটও লোকসানের মুখ দেখছে; ২০২৩ অর্থবছরে এই ইউনিটে কোম্পানির লোকসান হয়েছে ৬১ কোটি টাকা।
চিনি ইউনিটে ধারাবাহিক ক্ষতির বিষয়ে রাব্বিক হাসান বলেন, "কাঁচামালের সংকটের কারণে অনেক দিন ধরে কারখানা চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গত অর্থবছরে চিনি ইউনিট মাত্র ৫০-৫২ দিন চালু ছিল। এই সময়ে আখ মাড়াইয়ের কাজ চলেছে।"
তিনি বলেন, "চলতি অর্থবছরের জন্য আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষকদের উৎসাহিত করতে, আখের দাম বাড়ানো হয়েছে। সামগ্রিকভাবে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায়, এ বছর ৬৫ দিন মিল চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।"
বিএসএফআইসি-এর অধীনে অন্য চিনিকলগুলোর কী অবস্থা?
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) একডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। এরমধ্যে অধিকাংশই চিনি কল। যেখানে ২০২৪ অর্থবছরে চিনি কলগুলোর ৬০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে, সেখানে কেরু ছিল একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
মন্ত্রণালয় থেকে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএসএফআইসির অধীনে ১৫টি চিনিকলের মোট পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৬৫৬.৮৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে জয়পুরহাট চিনিকলে।
এই লোকসানের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে আখ চাষ কমে যাওয়া, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, চিনির বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কম থাকা এবং ঋণের ব্যয় বৃদ্ধি অন্যতম কারণ।
কেরুর ডিস্টিলারি ইউনিট
কেরু অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান পণ্য চিনি। তবে আখ থেকে চিনি নিষ্কাশন করার পর বিভিন্ন উপজাত পণ্যও (বাই-প্রোডাক্ট) উৎপাদন করা হয়। যেমন— মদ, ভিনেগার, স্পিরিট এবং জৈব সার।
প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় মদ, পরিশোধিত স্পিরিট এবং বিকৃত স্পিরিট উৎপাদন করে থাকে। পাশাপাশি, দুই প্রকার ভিনেগার— মল্ট ভিনেগার এবং সাদা ভিনেগারও তৈরি করে থাকে।
এর কারখানাগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১.৩৫ কোটি প্রুফ লিটার।
কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ডিস্টিলারি ইউনিটে রয়েছে ৯ প্রকারের মদ— ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্রান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জারিনা ভদকা, রোসা রাম এবং ওল্ড রাম।
১৮০ মিলি, ৩৬৫ মিলি এবং ৭৫০ মিলির বোতলে মদ বিক্রি করে কেরু। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সবগুলো নির্ধারিত গুদামে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা এবং সিলেটের শ্রীমঙ্গলের গুদামগুলো অর্ডারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি কেসে ৭৫০ মিলির ১২ বোতল, ৩৬৫ মিলির ২৪ বোতল বা ১৮০ মিলির ৪৮ বোতল মদ থাকে।