ডন মুস্তফা
হাসননগরের মুস্তফা মনে করে টাউনের ডন সে। মনে করে সে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, ফিসফাস করে ঘরদোরের মানুষজন।
ডন মুস্তফা যায়!
এই! এই! এই!
ডন মুস্তফা যায়!
চুপ! চুপ! চুপ!
টাউনের মায়েরা কার ডর দেখিয়ে ঘুম পাড়ায় তাদের দুরন্ত শিশুদের?
'ঘুমারে আবু, ঘুমা! না ঘুমাইলে ডন মুস্তফায় ধরব!'
ডন মুস্তফার নামে ষোলঘরের লিখন, বাসস্ট্যান্ড রোডের ফরিদ, উকিলপাড়ার কাওসার মামু, মড়ার টিলা রোডের খোকন মাস্টার এক টিউবওয়েলের আর্সেনিক মুক্ত পানি খায়। কেন?
ডন মুস্তফার হাত অনেক লম্বা। কত লম্বা? ঢাকা পর্যন্ত? ঢাকা! ওয়ারউইক টাউন কতদূর, ততদূর লম্বা। নিয়ন্ত্রণ অবশ্য রাখতে হয় ঢাকারও। রামপুরার উলন রোডে ওয়ালি থাকে, মিরপুরের শিয়ালপাড়ায় সহিদুল থাকে, পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে থাকেন বুলবুল ভাই। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ওয়ারউইকে থাকে বাপি। ডন মুস্তফার ডিরেক্ট চ্যালা এরা। বুলবুল ভাই বয়সে কিছু সিনিয়র হলেও। ডন মুস্তফার জবান এদের জবান। দায়িত্ব কম না।
কাল রাতে ঘুমাতে কিছু দেরি হয়ে গিয়েছিল, ডন মুস্তফা দুই ঘণ্টা এগার মিনিট সাকিনা এবং সাতচল্লিশ মিনিট তানহার সঙ্গে চ্যাট করেছে অনলাইনে। সাকিনা ডন মুস্তফার পুরনো প্রেমিকা। চট্টগ্রামের ঘাট ফরহাদ বেগ রোডে থাকে। বর্তমানে তার জামাই মালয়েশিয়ায়। ব্যবসা সংক্রান্ত মিটিং করতে গেছে। চ্যাটের আগে ম্যাসেঞ্জারে তার দুটো ছবি পাঠিয়েছে সাকিনা। ফর্সা, শঙ্খসাদা শরীর সাকিনার। পিংক রঙের নাইটি পরে আছে। কিছু বোঝা যায় কিছু যায় না।
তানহা টাঙ্গাইলের মেয়ে। বিন্দুবাসিনী কলেজে পড়ে বলেছে। ডন মুস্তফার প্রেমিকা এখনো হয়নি। হয়ে যাবে। কাল রাতের চ্যাটে এ ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ডন মুস্তফা আশাবাদী। আর এক চ্যাট, হয়ে যাবে।
কত সাকিনা, কত তানহা। পৃথিবীটা ভর্তি তানহা সাকিনায়। তানহা-১, তানহা-২, তানহা-৩...। সাকিনা-১, সাকিনা-২, সাকিনা-৩, সাকিনা-৪...।
ডন মুস্তাফার বয়স এ বছর সাতচল্লিশ কি আটচল্লিশ হয়েছে। ব্যাপার না। ছিয়াশি কি সাতাশি হলেও ব্যাপার হতো না। সাকিনা, তানহারা থাকত। ডনদের জন্য তারা থাকে।
'ডন মুস্তফা!'
কেউ ডাকে?
না।
পাখি হতে পারে। এখন কে ডাকবে পাখিরা ছাড়া?
কিছু পাখি এর মধ্যে আরেকটা দিনের ঘোষণা দিতে শুরু করেছে। সুবেহ সাদেক দেখেছে এবং দূরে মেঘের ডাক শুনেছে, ডন মুস্তফার আর কিছু মনে নেই, ঘুমিয়ে গেছে সে। দুপুরে একবার ঘুম ভেঙেছিল হয়ত কিংবা বিকেলে, বৃষ্টি দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়াটাকে শ্রেয়তর মনে করেছে। উঠে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেজা একটা সন্ধ্যা, ঝিপঝিপ বৃষ্টি হচ্ছে।
রং চা?
রং চা।
সিগারেট?
সিগারেট।
ধূমপান এবং মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক যদিও, সিগারেটের ধোঁয়া সহযোগে ডন মুস্তফা স্টার্ট দিল সন্ধ্যাটা। সন্ধ্যা রাত হলো। ক্ষুধা লেগে গেল। ডনদেরও ক্ষুধা লাগে এবং খেতে হয়। কাপ নুডলস আছে ঘরে। ডন মুস্তফা পৃথিবীর সেরা আবিষ্কার মনে করে কাপ নুডলসকে। ঝুট ঝামেলা ছাড়া একটা ব্যাপার।
ডন মুস্তফার বউ পোলাপান নেই। ডনরা একা হয়, সে একা। বউ ছিল। চলে গেছে। বলে গেছে, 'তোমার মাথায় দোষ আছে।' দুই বছর আট মাস মতো ছিল, পোলাপান বিয়োতে পারেনি বউটা। ভালো করেছে। ডন মুস্তফা এজন্য কখনই দোষারূপ করে না বউকে। প্রাক্তন বউকে।
ফোন বাজল।
কে? এসময় ডন মুস্তফাকে কল দেয় কে?
ডন কর্লিয়নি? ডন দাউদ?
তা না, প্যাঁচা সহিদুল। মিরপুরের শিয়ালপাড়া নিবাসী।
ইনসমনিয়া আছে সহিদুলের। টানা বহুরাত ধরে ঘুমায় না। রোজ রাত বারটা-একটায় কল দেয়। মাত্র সন্ধ্যায় কী সমস্যা তার? ডন মুস্তফা দায়িত্ব নিয়ে ধরল। বলল, 'হ্যালো?'
সহিদুল এক নিঃশ্বাসে বলল, 'শোন একটা সমস্যা হইছে আজ একজনের সাথে আমার পরিচয় হইছে সে ড বলতে পারে না ডাকাতকে বলে ধাকাত।'
বলে ফোনের লাইন কেটে দিল সহিদুল। অর্বাচীন শিশু। ডন মুস্তফা মাইন্ড করল না। অর্বাচীন শব্দটার অর্থ সে জানে। সহিদুল একটা প্রকৃত অর্বাচীন।
অর্বাচীনটা আবার কল দিল।
'সে ছেলে না, মেয়ে।'
বলে আবার লাইন কেটে দিল।
ছেলে না মেয়ে, ড-কে ধ বলে, তাতে কী হলো? ডন মুস্তফা ধরেও ধরল না। সহিদুল একটা ছিটগ্রস্থ। মেষ শাবক। বিয়ে করেছিল। ডিভোর্স হয়ে গেছে। হতভাগাকে বউ মারধোর করত। গলা টিপে ধরেছিল দুইদিন।
পানি গরম করে একটা কাপ নুডলস বানাল ডন মুস্তফা। বৃষ্টি ঠান্ডা এই সন্ধ্যার তুলনা হয় না।
আবার ফোন বাজল। ভাস্করদা কলিং।
ডন মুস্তফা নিজেকে যখন দাউদ ইব্রাহিম মনে করে, ভাস্করদাকে অতি অবশ্যই মনে করে ছোটা সাকিল। ভাস্করদা তাকে ডাকেন মুস্তফ। মুস্তফার আ-কার বাদ দিয়ে ডাকেন।
ডন মুস্তফা কল ধরল, 'ভাস্করদা?'
ভাস্করদা বলল, 'ইয়া মাবুদ! তুমি উঠছ? একশ তিনবার কল দিছি মিয়া তোমারে! হিসাব আছে। কী করছ তুমি? ঘুমের বড়ি খাইছো? ঘুমের বড়ি খাওয়া কিন্তু ভালো না। তুমি এমনেই আধা পাগল। পুরা পাগল হইতে সময় লাগব নাÑ।'
'ভেরি গুড হবে সেইটা। ভেরি ভেরি গুড হবে। কিন্তু ও ভাস্কর বাবু, ডন মুস্তফা দিনে ঘুমায়, ফোন অফ করে ঘুমায়, এইটা আপনি জানেন না বলেন? দিনে ফোন করলেন কেন তাহলে? একশ তিন বার! এক কোটি তিন লক্ষ বার কল দিলে কী, ডন মুস্তফা আপনার কল ধরত? সেই বান্দা এই ডন মুস্তফা না।'
'রাখো মিয়া তোমার ডনগিরি। ডন মুস্তফা ফোন অফ করে ঘুমায়! আমি তো ভাবতেছি হইলটা কী? ইয়া মাবুদ! পাড়ার এরে জিগাই তারে জিগাই মিয়া, মসজিদের মাইকে কি কিছু বলছে?'
'মসজিদের মাইকে? মসজিদের মাইকে আবার কী বলব ভাস্কর বাবু?'
'তুমি মিয়া কত বড় ডন। তোমার কিছু হইলে মসজিদের মাইকে শোক সংবাদ দিব না?'
'এখন হাসতে পারতেছি না, এইটা নিয়া পরে আমি একবার হেসে নেব ভাস্কর বাবু। কিন্তু একটা কথা শুনে রাখেন, ডন মুস্তফা এইভাবে মরবে না। একে ফরটি সেভেনের গুল্লি না খেয়ে পৃথিবীর ডনদের কেউ আজো মরে নাই। এ কে ফরটি সেভেন আবিষ্কারের পর থেকে। এ কে ফরটি সেভেনের আবিষ্কারক আবার আফ্রিকা পাড়ার আবুল কালামরে ভাববেন না ভাস্কর বাবু। আলেক্সান্দার কালাশনিকভ। মনে রাখতে পারবেন? আরো দুইবার বলি। আলেক্সান্দার কালাশনিক। আলেক্সান্দার কালাশনিকভ।'
'ইয়া মাবুদ! তোমার মাথা দেখি পুরাই গেছে মিয়া। মুস্তফ! রাইত দুইটার এইসব কী বলতেছো তুমি!'
'রাইত দুইটা! হা! হা! হা! মাথা কার গেছে ভাস্কর বাবু? এশার আজানের পর আমার ঘুম ভাঙল মাত্র।'
'এশার আজান! এশার আজান তুমি শুনছো?'
'শুনি নাই। উঠার পরে এশার আজানও হয় নাই।'
'তোমার মোবাইলের টাইম ঠিক আছে? না তোমার মাথার মতোই গেছে? না গিয়া থাকলে কয়টা বাজে দেখো। আমি রাখি। পেশাব করতে উঠছিলাম। কল দিয়া দেখলাম। মনে করছিলাম তুমি ধরবা না। ধরছো ধরছো আবার যা মন ধরে বলতেছো। তোমার মাথা পুরা ঠিক অইব না কোনদিনই। রাখো।'
'ডন মুস্তফার সালাম নিন, বোতল মার্কায় ভোট দিন।'
বলে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে ডন মুস্তফা এগার সেকেন্ড নিঃশব্দে হাসল। হা করে হাসে সে। বন্ধু মহলে এজন্য একদা তার নাম হয়েছিল হা-করা মুস্তফা। বাপি সেটা মনে রেখেছে, ডাকে এখনো। কোন ওয়ারউইক থেকে কল দেয়, 'ও হা-করা, কী করো তুমি?'
ডন মুস্তফা অবশ্য একথা শোনে না। সে শোনে তার মতো করে। পাগলা বাপির কথাটা শুনে এভাবে, 'হে ডন আপনার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হোক।'
আচ্ছা, এশার আজান কখন হয়েছে? ভাস্করদার কথা তেঁতুল পাতা। ডন মুস্তফা সময় দেখল তার স্মার্ট ফোনে। এ কী কা-! ০২:০২ এএম। সত্যি সত্যি রাত দুইটা বেজে গেছে! কী করে? কখন? মাত্র না সে ঘুম থেকে উঠল! সন্ধ্যা হতে দেখল! ভুল দেখেছে। এত ঘুম ধরেছিল তার? বৃষ্টি কতক্ষণ ধরে হচ্ছে? ধরেনি একবারও?
আচ্ছা। টাউনের নদী ঠিক আছে কি না দেখে আসতে হবে এখন যত রাত হোক। রাতে নদী আরেক নদী হয়ে যায়। দেখে রাখতে হয়। টাউনের ডন, এও দায়িত্ব।
ঝিপঝিপ বৃষ্টি সহজে ধরবে না। তাও ছাতা না নিয়েই বের হয়ে পড়ল ডন মুস্তফা। ঝিপঝিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে তার। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে আরো ভালো লাগে।
রাস্তায় টাউনের বিখ্যাত কুকুর কালু সঙ্গ নিল ডন মুস্তফার। নেড়ি। তবে তার সঙ্গে যখন হাঁটে ডন মুস্তফা মনে করে কালু বিদেশি কুকুর। ব্লাড হাউন্ড জাতীয়। কালুও তখন 'ব্ল্যাক' হয়ে যায়।
ডন মুস্তফা হাঁটছে।
ব্ল্যাক হাঁটছে।
খ্রিস্টান মিশনের রাস্তার দিকে একটা টহল গাড়ি চলে গেল পুলিশের। বেমক্কা নিঃশব্দ হয়ে গেল রাস্তা। বাবা ডংকাশার মোকাম পার হচ্ছে তারা। মেজাজ মর্জি সব সময় ঠিকঠাক থাকতে নেই ডনদের। ডন মুস্তফা এজন্য হঠাৎ খেপল। হাঁটতে হাঁটতে কোনো কারণ ছাড়াই খেপল। দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, 'ব্ল্যাক, আমি এই রাস্তায় কারফিউ দিলাম। আমি। আমি। আমি ডন মুস্তফা এই রাস্তায় কারফিউ দিলাম। তোর কোনো আপত্তি আছে?'
ব্ল্যাক বলল, 'না, বস।'
'গুড। কেউ যেন কারফিউ না ভাঙ্গে!'
'ভাঙব না, বস্।'
'তাও কিছু বেয়াদব তো আছে, যদি ভাঙ্গে তুই তোর কর্তব্য করবি।'
'শিওর বস।'
'কী করবি?'
'খ্যাঁক করে পায়ের নলি কামড়ে দিব বস।'
'গুড। ভেরি ভেরি গুড। তোরে আমি নোবেল পুরস্কার দিব শান্তিতে। কেউ যদি না দেয় আমি দিব। এই আমি। ডন মুস্তফা। কথা দিলাম তোরে।'
'থ্যাংক ইউ বস।'
কারফিউ জারি থাকবে কতক্ষণ? সিদ্ধান্ত নিল না কারণ সিদ্ধান্ত নিতে ভুলে গেল ডন মুস্তফা। সিদ্ধান্তহীন ভাবে একটা সিগারেট ধরাল। ঝিপঝিপ বৃষ্টি এখনো হচ্ছে।
কেউ ফুটে উঠল কি রাস্তায়? কারফিউ লংঘনকারী। রাস্তার মাথায় দেখা গেল তাকে। ছাতাঅলা বেয়াদব। ক্রুদ্ধ ডন মুস্তফা হাঁক দিল, 'এই কে রে?'
বেয়াদব বলল, 'তুই কে রে?'
ওরে সর্বনাশ! এ তো অংশুদা।
অংশুমান দাস
টাউনের ত্রাস।
ডন মুস্তফা বলল, 'অংশুদা! আদাব।'
অংশুমান দাস বললেন, 'আদাব। কে? মুস্তফা?'
'জি দাদা।'
'কেমন আছিস ভাই?'
'জি দাদা ভালো। রামার ঘর থেকে ফিরলেন দাদা?'
'না রে। রামারে পুলিশ ধরে নিয়া গেছে। এইটা তারা কোনো কাজ করছে বল? ভালো কাজ করছে? কেউ বলব? আমি তো বলব না। আমি এই অংশুমান দাস, টাউনের ত্রাস। সন্ধ্যায় সামান্য পরিমাণ গরম জল খাই, এটা তারা বরদাস্ত করতে পারল না!'
'দুঃখজনক কথা অংশুদা। আপনি তাইলে আজ কিছু খান নাই?'
'খাই নাই মানে? আমি কে তোর কি বিস্মরণ হইছে? মুস্তফা! আমি তোর দাদা, অংশুমান দাস।'
ডন মুস্তফা বলল, 'টাউনের ত্রাস।'
অংশুমান দাস প্রসন্ন হলেন, 'টাউনে টাউনের মানুষ নাই আর। পুরান মানুষ কমতেছে দিন দিন। মরতেছে, টাউন ছাড়তেছে। তোমরা যে কয়জন আছো পুরান, তোমরা বুঝবা এই অংশুমান দাসের মর্ম। রামারে তারা ধরে নিয়া গেছে, কী হইল? রামার ভাই গঙ্গা কি নাই? সে আরো পদের জিনিস বানায়। মরা মানুষের কাছে সত্য কী মিথ্যা কী, তোমরা কই যাও না যাও, সব খবর আমি রাখি মুস্তফা মিয়া। গোপন করার কিছু নাই বুঝছো? তোমার অভ্যাস আছে আমি জানি। গঙ্গার জিনিস ট্রাই করে দেখো একবার। বিশুদ্ধ গঙ্গাজল। খিক! খিক! খিক! তিন গ্লাস আর আধ গ্লাস, সাড়ে তিন গ্লাস খাইছি, রামার আট গ্লাসের ধরা ধরছে। আচ্ছা ভাই, আমি ঘর লই।'
ডন মুস্তফা বলল, 'জি দাদা। বৃষ্টির রাত, ঘুমান গিয়া।'
'কী করবো? ঘুমাবো? খিক! খিক! খিক! তোমার কি মনে হইতেছে আমি সজাগ? এই পৃথিবীর কেউ সজাগ নাই ভাই, ঘুমন্ত অবস্থায় সব ঘটনা ঘটতেছে। যাই, আচ্ছা। বলোÑ।'
'জি দাদা?'
'বলো ভাই, অংশুমান দাসÑ।'
'টাউনের ত্রাস।'
'বেঁচে থাকো ভাই। পাগল হয়ে বেঁচে থাকাও থাকা।'
বাবা ডংকাশার মোকামের ধার দিয়ে নেমে গেলেন অংশুমান দাস। টাউনের কিংবদন্তী। দাদাকে একসময় তার আদর্শ মনে করত ডন মুস্তফা। এইম ইন লাইফ ঠিক করেছিল অংশুমান দাস হবে। হতে পারে নি। ডন হয়ে গেছে। এখন অংশুমান দাসকে সম্মানসূচক পল এসকোবার উপাধি দিল সে। মেক্সিকোর ড্রাগ ডিলার পল এসকোবার। অংশুমান দাস যদিও গরম জলেরই মানুষ শুধু।
খক খক করে কেউ কাশল কোনো ঘরে। যক্ষ্মা রোগীর কাশি। নসর কাকার বৈমাত্রেয় ভাই রশিদ কাকা হতে পারেন, কৃপেশ আচার্য কাকাও হতে পারেন। এরা দুজনই যক্ষ্মায় আক্রান্ত। ডন মুস্তফা বিড়বিড় করে বলল,
'অংশুমান দাস
টাউনের ত্রাস।'
কখনো একটা মাছি মারেন নি মানুষটা। তাকে উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানিয়ে ডন মুস্তফা আরো একটা জনহিতকর সিদ্ধান্ত নিল। কারফিউ শিথিল করে দিল। আর টাউন টহল দিল না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবে। নদী দেখার কথা মনে নেই আর।
'ব্ল্যাক তুই কেন ভিজতেছিস?', ডন মুস্তফা বলল।
ব্ল্যাক বলল, 'কী করুম? ছাতা নাই, বস।'
'ভালো উত্তর দিছিস। তোরে আমি একটা ছাতা কিনে দিব। র্যালি ব্রাদার্সের কাঠের ডান্ডাঅলা ছাতা।'
'থ্যাংক ইউ, বস।'
'অ। অংশুদারে আদাব সালাম দিলি না দেখলাম।'
'বেয়াদবি মনে করে দেই নাই, বস। আদাব সালাম দিলে যদি দাদার তপস্যা ভঙ্গ হয়ে যায়।'
'কিহ! তুই একটা জিনিয়াস ব্ল্যাক। জিনিয়াস অফ দি সেঞ্চুরি। তোর মতো আদব লেহাজ আর টাউনের মানুষের মধ্যে দেখি না। আমারে না হয় ডরায়। ডন মুস্তফা! কী করি না করি! খিক! খিক! খিক! তারা জানে আমার পিস্তল বন্দুক আছে। এ কে ফরটি সেভেন রাইফেল আছে। কিন্তু বিভু কাকার তো একটা চাক্কুও নাইরে। উকিল পাড়ার বিভু কাকা। এমন একটা মানুষের গায়ে তারা হাত তুলল কিভাবে বল? তারা আফ্রিকায় জন্ম নিছে বলে? আফ্রিকা পাড়ায়?'
ব্ল্যাক বলল, 'বস, আপনে মানুষরে নিয়া দিন রাইত ভাবেন। টাউনের মেয়র সাবের উচিত আপনারে তার প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া। জ্ঞানী মানুষের উপযুক্ত সম্মান আর মনুষ্য সমাজে নাই। আফসোস!'
'আফসোস! আবদুর রহিম মধু স্যারের কথা মনে পড়ে রে। পাক্কা একশ বছর বাঁচলেন। টাউনের একটা মানুষ নাই, স্যারের মৃত্যুতে যে চোখের পানি মুছে নাই। আবদুর রহিম মধু স্যার মনে হয় টাউনের শেষ ভালো মানুষ ছিলেন।'
'বস! চুপ!'
'কী হইছে ব্ল্যাক?'
ব্ল্যাক ফিসফিস করে বলল, 'রিশ্কা বস!'
'রিকশা!'
ঝিপঝিপ বৃষ্টি এবং অন্ধকার থেকে ফুটে উঠল রিকশাটা। হুড নামানো, পানি-কাপড় নেই, আরোহিনী আছে। রিকশাঅলা সাধু। আদাব সালাম দেয় দেখলে। তবে সে রাতকানা মানুষ। আন্দাজে রিকশা চালায় রাতে। রাস্তার ধারের ডোবা-নালায় রিকশা নিয়ে পড়ে যায় আকছার।
দেখে নাই বলে আদাব সালাম দিল না, তবে ডন মুস্তফার ধারে রিকশা রাখল সাধু। কেন?
রিকশার আরোহিনী বলল, 'মুস্তফা ভাই!'
ডন মুস্তফা বলল, 'কেগো?'
'মুস্তফা ভাই, আমি আফরিন।'
আফরিন। জামতলার শামসু কন্ট্রাক্টরের মেয়ে। টাউনের সেরা রূপবতী। কম ছেলেপান লাইন দেয়নি। কিন্তু এই পৃথিবীর কেউ পায়নি আফরিনকে। কোন পৃথিবীর কে পেয়েছে?
আফরিন বলল, 'মুস্তফা ভাই, রিকশায় ঘুরবেন?'
ডন মুস্তফা বলল, 'না গো। ঘুম পাইছে।'
'ঘুম পাইছে? হি! হি! হি! আমি আফরিন মুস্তফা ভাই। শামসু কন্ট্রাক্টরের ছোট মেয়ে আফরিন। আপনি না ঘুড্ডিতে আই লাভ ইউ আফরিন লিখে আমাদের বাসার দিকে ছাড়ছিলেন।'
কথা সত্য। ডন মুস্তফার মন সামান্য চনমন করে উঠল। তখন তারা সবে কলেজে উঠেছে। আফরিন নাইনে। টাউনের সেরা রূপবতী এবং কবিতা আবৃত্তি করে। টাউনের ছেলেপান লাইন ধরে আফরিনের প্রেমে পড়েছিল। ডন মুস্তফা তখনো ডন হয়নি। সে কেন প্রেমে পড়বে না আফরিনের? তার কি রাইট নেই? ঘুড্ডিতে 'আই লাভ ইউ আফরিন' লিখে শামসু কন্ট্রাক্টরের বাসার দিকে ছেড়েছিল সে। প্রায় নিখুঁত নিশানা। মুশকিল হলো উঠানে না পড়ে আফরিনদের পুকুরে পড়ে গিয়েছিল ঘুড্ডিটা।
ডন মুস্তফার একবার মনে হলো আফরিনের সঙ্গে রিকশায় উঠে যায়। তবে সে উঠল না। আফরিনকে বলল, 'না গো, তুমি যাও। আমি ঘুমাব।'
আফরিন হাসল, 'আচ্ছা গো ঘুমান গিয়া। স্বপ্নে আমার লগে রিকশায় ঘুরবেন।'
ডন মুস্তফা বলল, 'আচ্ছা গো।'
সাধু রিকশা টান দিল। চলে গেল তারা।
ডন মুস্তফা বলল, 'ব্ল্যাক!'
ব্ল্যাক বলল, 'বস্?'
'কিছু বুঝলি?'
ব্ল্যাক বোঝার চেষ্টা করল না এবং ব্ল্যাকও থাকল না আর। কালু হয়ে গেল। ডন মুস্তফা বিরক্ত হলো। তুই এখন ডন মুস্তফার সঙ্গে ঘুরছিস তুই এখন কেন কালু হয়ে যাবি? কালু কি ডন মুস্তফার কথা বোঝে?
প্রভু মরে গেলে কুকুররা বোঝে, টাউনের কেউ মরে গেলে বোঝে, মৃত ব্যক্তি যদি তার প্রভু না হয়?
অংশুমান দাস চার বছর আগে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আফরিনের মৃত্যু রহস্যের কিছু সুরাহা এখনো হয়নি। নিউজ হয়েছিল স্থানীয় পত্রিকায়। আত্মহত্যা নাকি হত্যা? সে সুরাহা আর হবে না কখনো। রব ভাই এখন কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা। বিয়ে করেছেন, ছেলেমেয়ে হয়েছে। কুড়িয়ার পাড়ের কবি রব ভাই। কবিতা লিখে প্রেম করেছিলেন এবং বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আফরিনকে। কার্তিকের এক রাতে আফরিন গলায় দড়ি দেয়।
কিছুর কোনো সুরাহা হয় নি।
কিছুর কোনো সুরাহা হয় না।
কালুকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ডন মুস্তফা তাদের বাসার টিনের গেট পার হয়ে ঢুকল। ঘুমন্ত ঘরদোর। উঠানে কিছু গাছ আছে। ফুলগাছ, ঝোপঝাড়। কিছু জোনাকি জ্বলছে নিভছে। ঘুম ধরছে না জোনাকি মেয়েদের? ডন মুস্তফা আকাশ দেখল। কিছু তারা মুখ দেখাতে লেগেছে। অবরোধ উঠিয়ে নিচ্ছে মেঘদল। আচ্ছা আকাশের তারারা কি জোনাকি মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে নাকি?
শিকল টেনে বেরিয়ে গিয়েছিল, ডন মুস্তফা ঘরে ঢুকল তার। অন্ধকারে হাতড়ে লাইটের সুইচ টিপল। বাতি জ্বলল না। বাল্ব গেছে। মোম আছে ঘরে? দরকার নেই। চেয়ার টেবিল খাট আবছা বোঝা যাচ্ছে। ডন মুস্তফা চেয়ারে বসল। অংশুমান দাসের কথা আর মনে নেই তার। আফরিনের কথা মনে নেই। রাতের নদী দেখার কথা মনে নেই। সে একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট না, মনে করল সিগার। হাভানা চুরুট। সে হলো ডন মুস্তফা। সে কি আর গোল্ড লিফ, বেনসন, কি হলিউড টানবে?
চুরুটের ধোঁয়া উঠল কু-লী পাকিয়ে। অন্ধকারের মধ্যেও আরো এক পরত ঢেকে দিল ডন মুস্তফার মু-ুটা। আচ্ছা, সে পাগল হয়ে গেল কিভাবে? তারা কেন বলে সে পাগল? তার প্রাক্তন বউ, টাউনের মানুষজন? সে কী করেছে? কামড়ে দিয়েছে কখনো টাউনের কাউকে? তবে? মৃত অংশুমান দাসের সঙ্গে কেন দেখা হয় তার? মৃত আফরিনের সঙ্গে কেন দেখা হয়? মৃত কুকুর কালু কেন তার সঙ্গে টাউন টহল দিয়ে বেড়ায়? এসব সে কী করে বলবে? কেন বলবে?
'তোমার মাথার দোষ আছে।'
কী কথা!
ডন মুস্তফা মায়া বোধ করল তার প্রাক্তন বউ এবং টাউনের নির্বোধ মানুষজনের জন্য। এবং হাসল। উচ্চৈঃস্বরে হাসল।
হা! হা! হা!
হা! হা! হা!
পড়শি নবদম্পতি টিপু লিজা। বৃষ্টি এবং ঠান্ডা রাত বলে দ্বিতীয়বারের মতো তারা পরস্পরের অন্তর্গত ছিল। রেশ কিছু কাটল ডন মুস্তফার হাসিতে। আঁতকে উঠে লিজা আরো জাপটে ধরল টিপুকে। নৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও ভয় পেয়ে গেছে। বলল, 'শোনো! পাগলটা হাসতেছে!'
টিপুও হাসল। তবে নিঃশব্দে। কিছু কিছু বিশেষ সময় ভয়ে আরো একটু জমে ওঠে।
ডন মুস্তফা কী শুনল না শুনল, ভাবল চলবেই, তাকে নিয়ে এরকম ফিসফাস টাউনে চলবেই। চলছে, চলবেই। হাভানা চুরুটে দ্বিতীয় টান দিল সে।