ঋণের দুষ্টচক্রে আটকা পড়া শহুরে গরিব আর স্থানীয় মহাজনদের জটিল সম্পর্ক
একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করতেন কালাম। হঠাৎই তিনি কিডনি বিকল হয়ে মারা যান। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের জন্য কোনো সঞ্চয়ই রেখে যেতে পারেননি তিনি। বরং তাদের জন্য রেখে গেছেন ৫০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা।
শারমিন নিপা স্বামীর মৃত্যুর পর ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করতে বাধ্য হন। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ে ওঠেন। সংসারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়, বাড়িভাড়া, খাদ্য খরচ এবং স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা সামলাতে হিমশিম খেতে থাকেন নিপা।
নিপা বলেন, "এটা কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ নয়। জালাল ভাই ও খুরশিদা আপা প্রতি হাজারে ১০০ টাকা সুদে ঋণ দেন। আর মাসে মাসে আমাদের এই সুদ পরিশোধ করতে হয়।"
নিপাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। যতক্ষণ না তিনি পুরো ঋণ একবারে পরিশোধ করতে পারবেন, তাকে এই সুদ দিয়ে যেতে হবে।
এখন নিপা তার আত্মীয়দের কাছে টাকা ধার করার চেষ্টা করছেন। এমনকি, যেখানে তিনি গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন, স্বামীর নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে সেখান থেকেও ঋণ নিয়েছেন ।
নিপা হতাশ হয়ে বলেন, "প্রতি মাসে আমাকে এই বোঝা টানতে হয়। আমার মাসিক বেতনের অর্ধেকটা চলে যায় [ঋণের সুদ দিতে]। আমি যেকোনো মূল্যে এটা শেষ করতে চাই।"
নিপা ও তার ছেলে যেখানে থাকেন, সেই বস্তিতে খুরশিদা এবং জালালের মতো মানুষের যোগাযোগ রয়েছে। যখনই কারও টাকার প্রয়োজন হয়, তারা তাদের নম্বর চেয়ে নেয় এবং মহাজনরা (ঋণদাতা) তাদের লোকদের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন।
তারপর, প্রতি মাসে, তাদের লোকেরা ঋণগ্রহীতাদের কাছে গিয়ে মাসিক সুদ সংগ্রহ করে।
যদি কেউ সুদ পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে কী হয়? "এরা সবচেয়ে বাজে ভাষা ব্যবহার করে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে, বস্তির সামনে সবচেয়ে অশ্লীল গালি দেয়। এই ভয়ে, সবাই সময়মতো সুদ দেয়," নিপা উত্তরে বলেন।
শুধু খিলগাঁওতেই নয়, এই মহাজনদের গুলশান-বনানির করাইল বস্তি থেকে শুরু করে আগারগাঁও এবং মোহাম্মদপুরেও দেখা যায়। শহরের দরিদ্র জনগণ তাদের ওপর নির্ভরশীল।
মহাজনরা শহরের ছোট দরিদ্র পরিবার ও নিম্ন আয়ের মানুষদের ঋণের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন; বিশেষত যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছাতে পারেন না, তাদেরকে ঋণ দেন। তারা উচ্চ সুদে কম পরিমাণ টাকা ঋণ হিসেবে দিয়ে থাকেন।
১৯৪০ সালের মানিল্যান্ডার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী, কোন মহাজন ব্যবসা চালানোর জন্য বৈধ লাইসেন্স ছাড়া ঋণ দিতে পারেন না। এর মানে হল, এই স্থানীয় মহাজনদের কাজ প্রকৃতপক্ষে অবৈধ।
এখন আমরা দেখি, কীভাবে অনানুষ্ঠানিক ঋণদান ব্যবস্থা বিভিন্ন রূপে এবং নামে চলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা ব্যাখ্যা করেন, "যেহেতু মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থা শহরের জনগণের মধ্যে ততটা জনপ্রিয় নয়, এখানে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক ঋণদান মডেল চালু আছে। ব্যাংক, মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু নির্দিষ্ট নথিপত্র প্রয়োজন এবং আরো কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে, যেগুলো মেনে চলা প্রয়োজন।"
তিনি আরও বলেন, "শহরের দরিদ্র জনগণের জন্য এভাবে ঋণ দেওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা তুলনামুলকভাবে সহজ কাজ।"
যেহেতু বৈধ লাইসেন্স বা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অনুমোদন নেই, এই মহাজনরা উচ্চ সুদের মাধ্যমে দরিদ্রদের শোষণ করতে পারেন। এতে ঋণগ্রহীতারা শেষ পর্যন্ত সুদ-ঋণ পরিশোধের একটি দুষ্ট চক্রে আটকে যান।
কারা এই মহাজন?
মো. জালাল মিয়া (ছদ্মনাম) খিলগাঁওয়ে একটি স্থানীয় বেকারি চালান। সেখানে চায়ের দোকানে বিক্রির জন্য সস্তা কেক, রুটি এবং বিস্কুট তৈরি হয়। তার ছোট ভাই মো. ওসমান গনি বেকারি ব্যবসা চালান এবং জালাল ঋণ দেওয়ার ব্যবসা দেখভাল করেন।
খিলগাঁওয়ের রিকশাচালক থেকে শুরু করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন জালালের কাছে ঋণ নিতে আসেন। সাধারণত, মেয়ের বিয়ে, চিকিৎসা, অথবা কিছু কেনাকাটার জন্য মানুষজন ঋণ নেন। জালাল সম্ভবত জনপ্রিয়, কারণ তিনি অন্য মহাজনদের তুলনায় বড় পরিমাণে ঋণ দিতে পারেন।
অনানুষ্ঠানিক মহাজনদের এত বেশি চাহিদা কেন? "এদের মধ্যে অনেকেই কখনও কোনো ব্যাংকে পা রাখেননি। তারা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত নয়। এছাড়া, যদি আপনি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চান, তবে সেখানে অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয় এবং কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। আর এই লোকজনের কোনো নিয়মিত কাজ বা আয় নেই," বলেন মো. জালাল।
যদিও মাইক্রোফাইন্যান্সের মতো বিকল্প রয়েছে, তাও এর জন্য কিছু শর্ত প্রযোজ্য।
ঋণ দেওয়ার আগে জালাল কিছু বিষয় যাচাই করেন। যেমন, ঋণগ্রহীতা তার প্রতিবেশীদের কাছে পরিচিত কি না এবং তার কোনো কাজ আছে কি না। ঋণের পরিমাণ যদি ৭০ হাজার টাকার বেশি হলে ঋণগ্রহীতাকে একজন জামিনদার দিতে হয়, যিনি জালালের পরিচিত।
"যদিও তাদের অধিকাংশের কাছে মূল্যবান কিছু নেই, কখনও কখনও তারা কিছু সোনার বা রূপার গয়না বন্ধক রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি তা নেই না, কারণ এই ব্যবসা সুদের উপর চলে," বলেন জালাল।
খুরশিদা বেগম (ছদ্মনাম) একজন গৃহকর্মী। সিপাহীবাগ এবং বনশ্রী এলাকায় তিনি একইরকম ব্যবসা চালান। তবে তিনি বেশি পরিমাণে ঋণ দিতে পারেন না। তিনি ১০-১৫ হাজার টাকার বেশি ঋণ দিতে পারেন না।
খুরশিদা বলেন, "ঈদ এবং পূজায় আমি যেসব বাড়িতে কাজ করি, সেখান থেকে বোনাস পাই। সেই টাকা খরচ না করে, আমি 'সুদের কারবার' [ঋণদান ব্যবসা] চালাই।"
যদিও তিনি সারাদিন কাজ করেন, তার ভাতিজি পাখি মাসিক সুদ সংগ্রহ করতে আশেপাশের বস্তি আর বাড়িতে চলে যায়। বর্তমানে, তিনি তিনজন ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সুদ পাচ্ছেন।
"আমি ৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছি– ১০, ১৫ এবং ৫ হাজার করে প্রত্যেককে তিন মাস আগে। তাই গত তিন মাস ধরে আমি ৩ হাজার টাকা সুদ পাচ্ছি," বলেন খুরশিদা।
খুরশিদা তার টাকা দিয়ে পটুয়াখালির গ্রামের বাড়িতে কিছু ছাগল কেনার পরিকল্পনা করছেন। সেখানে তার বাবা থাকেন এবং তিনি ছাগল পালন করে আসন্ন ঈদুল আযহায় সেগুলো বিক্রি করবেন।
খুরশিদা টিবিএসকে বলেন, "সুদের কারবার [সুদের ব্যবস্থা বা রিবা] ইসলামে হারাম, কিন্তু ব্যাংকগুলো এই মডেলে কাজ করে। আমি গরিবদের ঋণ দিয়ে একই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করছি । আর এছাড়া কীভাবে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করব? আমি তো শুধু একজন গৃহকর্মী।"
ঋণগ্রহীতাদের দুর্দশা
অনেক ঋণগ্রহীতা মূলত ধার করা টাকার তিন থেকে পাঁচ গুণ পরিশোধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত, কিছু মানুষ তাদের মূল ঋণ পরিশোধ করতে নিজেদের মূল্যবান কিছু বিক্রি করতে বাধ্য হন।
আসমা এবং তার পরিবার ২৬ বছর ধরে করাইল বস্তিতে বসবাস করছেন। ২০১৬ সালে একটি অগ্নিকাণ্ডের পর, আসমার বাবা আজমল মিয়া করাইলের একজন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাদের দুই তলা বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেন। এই বাড়ির ১৭টি রুম ভাড়া দেয়া হয় এবং তিনটি রুম তারা নিজেদের জন্য রেখেছেন।
ভাড়া ছাড়া কিছু রুমও বিক্রি করা হয়; যদিও বৈধ মালিকানা নেই, কারণ বস্তিটি সরকারি জমিতে অবস্থিত।
আজমল যে ২৫ হাজার টাকা ভাড়া পান, তার মাধ্যমে তাকে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে, পরিবারটি ৪ শতাংশ সুদের হারে ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
"তিনি [মহাজন] স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং নেতাদের সাথে সম্পর্ক রাখেন। যদি কিছু ভুল হয়, তিনি এটাকে বড় ঘটনা বানিয়ে ফেলতে পারেন," বলেন আসমা।
কিছুক্ষেত্রে, ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সালিশ বা সম্প্রদায় আদালতও গঠন করা হয়।