প্রাণ ফিরে পেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩২ বছরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়ার কাছারি বাড়ি
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি দেশের অন্যতম একটি পর্যটক স্থল। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহের নাম উঠলেই চলে আসে কবিগুরুর কথা। এই গ্রামের প্রধান আকর্ষণই রবিঠাকুরের এ কুঠিবাড়ি। রবীন্দ্রভক্ত অনুরাগী ও ইতিহাসবিদদের কাছে এই রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম।
অথচ মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত 'কাছারি বাড়ি' (তহশিল খানা) যুগের পর যুগ অযত্নে-অবহেলায় পড়ে ছিল। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কারের ছোঁয়ায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩২ বছরের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহের এই বাড়িটি।
কাছারি বাড়িটি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কশবা গ্রামে অবস্থিত। শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি থেকে ৫৫০ মিটার এগিয়ে গেলে একটি তেমাথা সংলগ্ন পাকা রাস্তার উত্তর পাশে পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত বাড়িটি।
জানা যায়, কাছারি বাড়িটি (তহশিল খানা) আয়তাকার নির্মিত একটি স্থাপনা। দক্ষিণমুখী করে নির্মিত দুই তলা বিশিষ্ট এই স্থাপনাটির দেয়ালসহ দৈর্ঘ্য ১৯.৫০ মিটার ও প্রস্থ ৯ মিটার। স্থাপনার দেয়ালগুলো প্রায় এক মিটার চওড়া। এটির নীচ তলায় চারটি কক্ষ এবং সামনে লম্বা একটি বারান্দা রয়েছে।
প্রতিটি কক্ষে একাধিক প্রবেশপথ ও জানালা রয়েছে। প্রবেশপথ ও জানালাগুলোতে সেগমেন্টাল খিলানের প্রতিফলন দেখা যায়। নিচতলার বারান্দার সামনে সমদূরত্বে স্থাপিত স্তম্ভের সারি রয়েছে। জোড়ায় জোড়ায় স্থাপিত স্তম্ভগুলোতে টুস্কান স্তম্ভের প্রতিফলন দেখা যায়। নীচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় উঠার জন্য পশ্চিম পাশের দেয়ালের সাথে লাগোয়া বাইরের দিকে একটি সিঁড়িও রয়েছে।
দ্বিতীয় তলাটি প্রায় নিচতলার আদলে নির্মিত। তবে দ্বিতীয় তলার সামনের বারান্দাটি ছাদ বিহীন এবং কোন স্তম্ভ নেই। এই বারান্দাটির সামনে স্বল্প উচ্চতার প্রাচীর রয়েছে। সাধারণ বৈশিষ্ট্যের এই স্থাপনাটির নির্মাণ উপকরণ হিসেবে পোড়া মাটির ইট, চুন, বালি, লোহা ও কাঠের ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদে লোহার বিম ও কাঠের বর্গার ব্যবহার করা হয়েছে।
জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ অঞ্চলের জমিদারি পান। ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাছারি বাড়িতে বসেই জমিদারি পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই কাছারি বাড়িতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের (তহশিল অফিস) কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল।
গত শনিবার (২৩ নভেম্বর) সরেজমিনে কাছারি বাড়িতে গিয়ে মনোমুগ্ধকর এক অন্যরকম পরিবেশ চোখে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলের আলোর রেখা যেন আছড়ে পড়ছে কাছারি বাড়ির বারান্দায়। এতে লাল রঙা দ্বিতল বাড়িটি যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া কাছারি বাড়ির বারান্দা থেকে সামনে তাকালে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। বাড়ির আঙিনায় শতবর্ষী কিছু গাছ যেন মৃতপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কাস্টডিয়ান আল আমীন জানান, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। চুন-সুরকি খসে পড়া দেয়ালে প্রলেপ লাগানো হয়েছে। ভবনের কিছু অংশের ছাদ ধসে গিয়েছিল, সেসব ঠিকঠাক করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, কাছারি বাড়িটির সামনের বিশাল জমিটি জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জমিটি চেয়ে আবেদন করাও হয়েছে। যদি পাওয়া যায়, তাহলে পর্যটকদের জন্য বাড়িটি আরও নতুন রূপে সাজানো সম্ভব হবে।
কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা জহির আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়িটি যুগের পর যুগ ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। নতুন করে সংস্কার করায় বাড়িটি দেখার জন্য এখন দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসছেন। এবার শীতে কুঠিবাড়ির মতো এখানেও পর্যটক বাড়তে পারে। এতে আমরা এলাকাবাসী অনেক আনন্দিত।
ঐতিহাসিক স্থাপনায় কাছারি বাড়িটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক সরওয়ার মুর্শেদ। তিনি বলেন, "কাছারি বাড়িটি সংস্কারে রঙ ফিরে পেয়েছে দেখে সত্যিই আনন্দ লাগছে।"
তিনি জানান, ১৮৮১ সালে বাবার আদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে জমিদারি দেখভালের কাজে শিলাইদহ এসেছিলেন। ১৮৯২ সালে ৯.৯১৮ একর জমির উপর নির্মাণ করা হয়েছিল বাড়িটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘদিন ধরে এই কাছারি বাড়িটিতে বসে খাজনা আদায় তথা জমিদারি পরিচালনা করে এসেছেন।
পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) মূলত শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির কেন্দ্র বিন্দু। কবি এখান থেকেই শাহাজাদপুর, পতিসর যাতায়াত করতেন। তাই সব কিছুর বিচারে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কাছারি বাড়ি বাঙালির জন্য এক অনন্য সম্পদ।
জানা যায়, ২০১৮ সালে কাছারি বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভবনটি বেশকিছু দিন শিলাইদহ ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২৩ সালে মে মাস থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনটি সংস্কারের কাজ শুরু করে।
শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীর কাস্টডিয়ান আল-আমীন জানান, বর্তমানে ভবন ও ভবন সংলগ্ন মাত্র ৬ শতাংশ জায়গা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে। বাকি প্রায় ৫ একর জায়গা জেলা প্রশাসনের ১ নং খাস খতিয়ানের অধীন। ইতঃপূর্বে জেলা প্রশাসকের অধীনে থাকা উক্ত জায়গা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য আবেদন জানানো হলেও এটির এখনও কোন সুরহা হয়নি।
বর্তমানে দর্শনার্থীরা বাইরে থেকে বাড়িটি ঘুরে দেখতে পারছেন। তবে এখন বাড়িটির ভেতরে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। বাকি জায়গা বন্দোবস্তা পাওয়া গেলে চারপাশে প্রাচীরের কাজ করা হলে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির মত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩২ বছরের স্মৃতি বিজড়িত এই কাছারি বাড়িটিও কুঠিবাড়ির মতো দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে টিকিট মূল্য নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে।
কুষ্টিয়ার নবাগত জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান জানান, কাছারি বাড়ি সংলগ্ন জমি বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।