এস আলমের ঋণকে খেলাপি না দেখাতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেন সাবেক গভর্নর
এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সেসব ঋণকে খেলাপি দেখাতে ব্যাংকগুলোকে মানা করতেন বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য।
নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি টিবিএসকে বলেন, এই ধরনের হস্তক্ষেপের ফলে এস আলম গ্রুপ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে পেরেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত শ্বেতপত্র চূড়ান্ত করার পর্যায়ে থাকা এই কমিটি জানতে পেরেছে যে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংকখাতে ঋণ খেলাপি বাবদ ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণও অনেক কম দেখিয়েছে।
আগামী রোববার সরকারের কাছে এই শ্বেতপত্র জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। পরদিন সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে শ্বেতপত্রের ফল গণমাধ্যমকে জানানো হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক সেমিনারে তিনি এসব কথা জানান।
ড. দেবপ্রিয় টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বেশকিছু সুপারিশ করব, কারণ দাতারা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও পূর্বাভাসযোগ্যতা চায়।'
তিনি বলেন, ব্যাংকখাতের প্রকৃত অবস্থা, আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিগত ১৫ বছরে যে আশঙ্কাজনক মাত্রায় অর্থপাচার হয়েছে — বিশেষত এসব বিষয়সহ আমরা অর্থনীতির নানামুখী চ্যালেঞ্জগুলোকে রিপোর্টে তুলে ধরব।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত আগামী বছরের শুরুতে চারটি প্রধান আন্তর্জাতিক অংশীদার: উন্নয়ন অর্থদাতা, রপ্তানিবাজার প্রবেশাধিকার দেওয়া দেশ, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার কথা বিবেচনা করা, যাতে তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা যায়।
ব্যাংকখাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ
কমিটির ওই সদস্য টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে ডিসট্রেসড অ্যাসেট বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। তবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে এটি প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা হতে পারে।
তিনি বলেন, ব্যাংকখাতের দুর্বলতা ও অনিয়মের জন্য ব্যাংকগুলোতে কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের অভাব এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এখাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) দ্বৈত শাসন চলেছে বলে উল্লেখ থাকছে প্রতিবেদনে।
নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থায় এ ধরনের দ্বৈত শাসনের ফলেই ব্যাংকখাতে নানান অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব তৈরি হয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
তাই ব্যাংকখাতের রক্তক্ষরণের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরণের রক্তক্ষরণ না হয়, সেজন্য ব্যাংকখাতে চলমান দ্বৈত শাসনে ব্যবস্থা বাতিল করে একক নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা, এবং শুধুমাত্র কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এফআইডির এক্তিয়ার সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত জুনে ছিল ২ লাখ ১১ লাখ কোটি টাকা।
অর্থপাচার
শ্বেতপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ অর্থ পাচার নিয়ে থাকবে বলে জানান ওই কমিটির সদস্য।
কমিটি জানতে পেরেছে, বিগত ১৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে, অর্থনীতির আকার বাড়ার সাথে সাথে পাচারের অংকও বেড়েছে।
আরও অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং এই প্রবণতা বন্ধে সরকারকে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করবে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানায়, কেবল ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
কর অব্যাহতি
কমিটির অন্য একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ টিবিএসকে জানান, বিগত সরকারের সময় নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিবর্গকে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, এ বিষয়েও শ্বেতপত্রে তথ্য থাকছে।
এসব কর অব্যাহতির ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিটি। কারণ, যেখানে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে রাজস্বের অবদান মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ, সেখানে অব্যাহতির হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি বা ৬ শতাংশ। রাজস্ব আহরণে অটোমেশন কেন বাস্তবায়িত হয়নি, সে বিষয়টিও থাকবে শ্বেতপত্রে।
এছাড়া, ২০০৮ সালে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং নীতি বাস্তবায়নে পৃথক সংস্থা করার আইন করা হলেও – এতোদিনেও তা কেন কার্যকর করা যায়নি, সে বিষয়েও বর্ণনা থাকবে কমিটির রিপোর্টে।
রাজস্ব কাঠামোর দরকারি সংস্কার বাস্তবায়নে দেরীর কারণে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে দেশের কর রাজস্বে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পরিসংখ্যানের বিকৃতি
আগের সরকারের সময় অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যানে গড়মিলের বিষয়েও উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপত্রে। এতে বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হারসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সকল তথ্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দূষণ করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে পরিসংখ্যানের দূষণ রোধে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) একটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে সুপারিশ করেছে কমিটি।
তবে এটি করা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছে কমিটি। কারণ হিসেবে কমিটির একজন সদস্য বলেন, আগে ছিল শুধু পরিসংখ্যান ব্যুরো, পরে তাদের ক্ষমতা বাড়াতে পরিসংখ্যান বিভাগ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন পৃথক ডিভিশন করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রের সুপারিশের মধ্যে কর অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা নিয়ে আসা, এবং বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী তদারকির বিষয়টিও থাকছে।