‘আমার বাবা ফিরে আসবেন… আমি কখনও তার কণ্ঠস্বর শুনিনি’
বিদ্রোহীদের অভিযানের ফলে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকার পতন হয়েছে। এরপর বিদ্রোহীরা যে কারাগারগুলোর দখল নেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সাইদনায়া কারাগার। এই কুখ্যাত সামরিক কারাগারটি কয়েক দশক ধরে সিরিয়ায় সরকারের বিরাগভাজন হওয়া হাজারো মানুষকে আটক রাখা ও নির্যাতন করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর কুখ্যাত সাইদনায়া সামরিক কারাগারের সামনে শত শত মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন জওয়ান ওমর, যিনি বর্তমানে তুরস্কে বসবাস করেন। তিনি রোববার (৮ ডিসেম্বর) সাইদনায়া কারাগারে যান তার শ্বশুরের সন্ধানে। ২০১৩ সালে তাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাহায্যের অভিযোগে আটক করা হয়েছিল।
ওমর বলেন, "আমি কারাগারে গিয়ে আমার শ্বশুরের ছবি দেখিয়েছি, কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারেনি।"
তিনি আরও বলেন, "১১ বছর ধরে আমার স্ত্রী তার বাবার সন্ধানে স্বপ্ন দেখেছে। আমরা যখন শুনেছিলাম, কয়েদিরা মুক্তি পেয়েছে তখন আমরা অনেক আশা করেছিলাম। কিন্তু গতকাল থেকে আমার স্ত্রী কাঁদছে।"
তিনি জানান, অনেক বন্দিকে অন্য একটি স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে তাকে জানানো হয়েছে, যা তাকে হতাশ করেছে।
জওয়ান ওমর তার বন্ধু ড. শারভান ইবেশকে সঙ্গে নিয়ে সাইদনায়া কারাগারে যান। ড. ইবেশ সিরিয়ার সাহায্য সংস্থা বাহারের প্রধান নির্বাহী এবং নিখোঁজদের খুঁজে পেতে সহায়তা করছেন।
ড. ইবেশ জানান, কারাগারে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। শত শত মানুষ তাদের প্রিয়জনের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছিল।
তিনি বলেন, "কারাগার থেকে শত শত মানুষ বের হচ্ছিল আর আমাদের জানানো হয়েছিল, আমরা ভেতরে যেতে পারব না, কারণ এত মানুষ উদ্ধারকর্মীদের কাজে বাধা দিচ্ছিল।"
সিরিয়ার সিভিল ডিফেন্স দল হোয়াইট হেলমেটস কারাগারের বন্দিদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে। মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েকজন বন্দি কারাগারের গোপন ভূগর্ভস্থ কক্ষের প্রবেশদ্বার সম্পর্কে তথ্য দিলেও এখনও পর্যন্ত এর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার অনেক পরিবার নতুন করে তাদের প্রিয়জনদের খুঁজে পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছেন। এমনই এক পরিবার ইদলিবের নাদাফ পরিবার। তারা ২০১১ সালে সাইদনায়া কারাগারে পাঠানো থায়ের নাদাফের সন্ধান করছেন।
থায়ের গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তার দুটি সন্তান ছিল– একটি শিশু এবং একটি দুই বছর বয়সী ছেলে। এখন তার ১২ বছরের ছেলে মুস্তাফা বিবিসিকে জানায়, "আমি আশা করি তিনি ফিরে আসবেন। আমি তার কণ্ঠস্বর কখনও শুনিনি।"
থায়েরের মা ফায়জাহ নাদাফ জানান, "কেউ জানে না, কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।"
তিনি তার আরেক ছেলে মোহাম্মদকে দামাস্কাসের কারাগারে থায়েরের খোঁজে পাঠিয়েছেন।
দুই মাস আগে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া এক চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, থায়ের এখনও জীবিত এবং সাইদনায়ার ভূগর্ভস্থ অংশে বন্দি।
ফায়জাহ বলেন, "আমি আমার ছেলেকে আবার দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। ১২ বছর ধরে সে নিখোঁজ। আমি সব সময় প্রার্থনা করেছি, যেন সে তার সন্তানদের আবার দেখতে পারে।"
কারাগার থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দামেস্কের আল–সালাম মসজি মসজিদকে মুক্তি পাওয়া কারাবন্দি ও তাদের পরিবারের সাক্ষাতের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
রোববার ড. শারভান ইবেশ সেখানে গিয়ে কয়েকজন সদ্য মুক্ত হওয়া বন্দিকে দেখতে পান। তারা স্পষ্টতই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি বিবিসিকে জানান, একদল মানুষ সদ্য মুক্তি পাওয়া দুই ব্যক্তিকে ঘিরে সাহায্য করার চেষ্টা করছিল।
ইবেশ বলেন, "তারা কয়েক বছর ধরে কারাগারে বন্দি ছিলেন এবং সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ছিলেন। এমনকি তারা স্থান-কাল সম্পর্কেও কিছু জানত না।"
তিনি আরও বলেন, "তাদের নাম বা বয়স জিজ্ঞাসা করা হলেও তারা কোনো উত্তর দিতে পারছিল না। তাদের চেহারা দেখে বয়স বোঝা কঠিন ছিল। তারা সম্পূর্ণ হতবাক অবস্থায় সামনে তাকিয়ে ছিল।"
বন্দিদের মুক্তির পর অনেক পরিবার তাদের স্বজনদের খুঁজে পেলেও, এখনো অনেকের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
আসাদ সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কঠোর নির্যাতন চালিয়েছে। তুরস্কভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অব ডিটেনিজ অ্যান্ড মিসিং পারসনস অব সাইদনায়া (এডিএমএসপি) কারাগারটিকে একটি "মৃত্যুক্যাম্প" বলে অভিহিত করেছে।
২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সরকারি বাহিনী লক্ষাধিক মানুষকে এই কারাগারে আটকে রেখেছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এসব জায়গায় নির্যাতন ছিল একটি সাধারণ ঘটনা।
একসময় মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধীদের ওপর কঠোর অত্যাচারসহ নানা অভিযোগের জেরে আসাদের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে সিরিয়ায় শুরু হয় বিক্ষোভ। পরে সেই বিক্ষোভ রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে।
সেই গৃহযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় গত ২৭ নভেম্বর নতুন করে তাহরির-আল শাম-এর (এইচটিএস) নেতৃত্বে অভিযান শুরু করে বিদ্রোহীরা। শুরুতেই তারা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোর দখল নেয়। এরপর তারা আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর হামা-র দখল নেয়।
তারপর বিদ্রোহীদের হাতে পতন ঘটে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমস-এর। অবশেষে গতকাল রোববার দামেস্কে প্রবেশ করে বিদ্রোহীরা। এর মধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বাশার আল-আসাদ।