উকিল মুন্সির প্রয়াণ দিবস: বিনম্র শ্রদ্ধা হে মহাজন
এক
বাংলাদেশের ভাবসংগীত ও মরমীবাদ কিংবা সুফি চিন্তার ফলে যে নতুন একটি দর্শনের উদ্ভব হয়েছে তা হলো বাউল দর্শন। যেখানে নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই হিংসা, নেই অহংকার কিংবা আমিত্ববোধ। বাউলরা তাঁদের গানে রূপকের মাধ্যমে অসীমকে সীমায় আবদ্ধ করেছেন আর সীমার মধ্যে থেকে অসীমের সাধনা করেছেন- এটাই বাউল সাধনার মূল কথা।
আমাদের এই ভূখণ্ডে এই বাউল দর্শনকে নিয়ে যদি আমরা একটু মোটাদাগে চিন্তা করি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, মূলত এর গোড়াপত্তন এ দেশের দুটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। এর একটি হলো লালন সাঁইজি কেন্দ্রিক কুষ্টিয়া আর অপরটি হলো অসংখ্য মরমি বাউল সাধকদের জন্মস্থান ভাটি বাংলা বা বাংলার ভাটি অঞ্চল।
নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলাগুলোকে একসাথে ভাটিবাংলা হিসেবে ধরা হয়। মেঘভরা আকাশের সঙ্গে পানি আর নৌকার মিতালিতে জন্ম নেওয়া এ অঞ্চলের গানের পাখি ও তাঁদের কীর্তি সমৃদ্ধ করেছে এ দেশের লোকজ ভান্ডারকে। এ অঞ্চলের বাউল তথা ভাবসাধকরা বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, ঘাটু গান, মুর্শিদি গান, মারফতি গান প্রভৃতি সৃষ্টি করেছেন।
ভাটি বাংলার বাউলরা গৃহী এবং তাঁদের আছে বাউল গান, বৈঠকি ভাব ও দীর্ঘলয়ের সুর। কুষ্টিয়ার বাউলরা আখড়াই এবং তাঁদের সুরও আখড়াই। সাধনা আখড়া কেন্দ্রিক। কুষ্টিয়ার বাউলরা শিষ্য-পরম্পরা, তাঁদের আছে গুরু। আর ভাটি বাংলার বাউলরা স্বতন্ত্র সাধক, তাঁদের আছে পীর/মুর্শিদ। তাঁদের গানে সুফি দর্শনের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাউল আসলে কোনো ধর্ম নয়, এটি একটি দর্শন। এ দর্শনে আমরা লিখিত কোনো গ্রন্থ কিংবা দিক-নির্দেশনা পাইনি, কিন্তু পেয়েছি ভাব ও সংগীত যার মাধ্যমে ঘটেছে ভাবের আদান-প্রদান। এ দর্শনে সাধন-ভজন ও ভাব বিনিময় হয় সংগীতের মাধ্যমে।
লোকসাহিত্যে বাউল গান আমাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবের সঞ্চার করে। বাউলদের গান লোকসাহিত্যের প্রাচীন ঐতিহ্য। বাউল দর্শনকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সাহিত্য ভান্ডার তৈরি হয়েছে তা-ও সংগীতাশ্রয়ী।
কুষ্টিয়ার মহাত্মা লালন ফকির তাঁর সুর, সংগীত ও সাধনার মাধ্যমে এক স্বতন্ত্র দর্শন সৃষ্টি করেন যে দর্শনের প্রভাব বিস্তার ঘটে সারা বাংলায়। তৈরি হয় একটি স্বতন্ত্র বাতিঘর। লালন সাঁইজির ছেঁউরিয়া তাই এই বাংলার সংস্কৃতির একটি রাজধানী রূপে এখন প্রতিষ্ঠিত। তেমনি ভাটি-বাংলাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় আরেকটি ঘরানা।
বাংলার ভাটি/হাওড় অঞ্চলে লালন-পরবর্তী সময়ে জন্ম নেয় অনেক মরমি সাধক। তাঁদের মধ্যে বাউল রশিদ উদ্দিন, হাসন রাজা, পাগলা কানাই, দ্বীন শরৎ, উকিল মুন্সি, রাধারমণ দত্ত, আলেফচান দেওয়ান, মনমোহন দত্ত, সৈয়দ শাহ নূর, জালাল উদ্দিন খাঁ, দূরবীন শাহ, চাঁন মিয়া ফকির, চান খাঁ পাঠান, হৃদয় সরকার, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, আব্দুল মজিদ তালুকদার, দ্বিজ কানাই, মনসুর বয়াতি, শাহ আব্দুল করিমসহ আরও অনেক বিখ্যাত মহাজন তাঁদের ভাব ও গানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীত ভান্ডার, সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন আমাদের লোকজ ঐতিহ্য এবং ভাবাশ্রিত করেছেন অসংখ্য ভক্তবৃন্দকে।
দুই
বাউল গান বাঙালির মনের খোরাক, আধ্যাত্মিক চেতনার নিয়ামক, মানস ফসল এবং বাঙালির আত্মদর্শন। গ্রিক ইতিহাসের মূলে যেমন আমরা পাই ট্র্যাজেডি তেমনি বাংলার বাউল গানের মূলে আমরা পাই ভাব ও মায়া। এই মায়ার পেছনে লুকিয়ে আছে বিরহ গাথা সুর। বাংলার যে কয়জন বাউল এই বিরহকে নারীর কান্নার বিলাপের মতো করে মানুষের অন্তরে তীরবিদ্ধ করতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাউল সাধক উকিল মুন্সি।
চারিদিকে অথই পানি, জলমগ্ন পথ-ঘাট, আফালের গর্জন, খাল-বিল, নদী-নালা সব পানিতে একাকার হয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল জলাশয়- কূলকিনারাবিহীন হাওর, ভাটির দেশ। বছরের প্রায় ছয় মাস থাকে এই জল-জোছনার খেলা, নৌকার গলুইতে বসা মাঝির উদাসী সুর, ভাবাশ্রিত এক অধ্যায়। সেই ভূ-প্রকৃতির সন্তান উকিল মুন্সি।
জন্ম তাঁর হাওর অঞ্চলের নেত্রকোনা জেলায়, খালিয়াজুড়ি উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে, ১৮৮৫ সালে। গোলাম রসুল আকন্দের প্রথম সন্তান তিনি। উকিল মুন্সির প্রকৃত নাম আব্দুল হক আকন্দ। পিতা-মাতার ইচ্ছা ছেলে পড়ালেখা করে একদিন উকিল হবে তাই তাঁরা ছেলেকে আদর করে ছোটবেলায় ডাকতেন উকিল নামে। পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় মসজিদে ইমামতি করতে গিয়ে তাঁর নামের সাথে মুন্সি যুক্ত হয়। এভাবেই আব্দুল হক আকন্দের নাম হয়ে যায় উকিল মুন্সি।
তিন
উকিল মুন্সির গানে তাঁর সমসাময়িক পরিবেশ-প্রতিবেশ ও অঞ্চলের কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়-
"আরে ও আষাঢ়িয়া পানি
কার্তিক মাসে থাকবেনা তো সাধের জোয়ানি।
ঘাটে ঘাটে বান্ধা আছে সুন্দর তরনী
সুন্দর বউ আসে ঘাটে শুনে খলখলানি।"
জল, নৌকা, খোলা আকাশের শূন্যতা, আফালের গর্জন, প্রকৃতি, উজান-ভাটি, ভাঙনের আহুতি, অভিমান, নারী হৃদয়ে সুন্দরের ক্ষয়, ভাব-ভাঙন- স্রষ্টার প্রতি আকুতি -এই মিলিয়ে তৈরি হয়েছে উকিল মুন্সির সাধনা ও সংগীতের প্রেক্ষাপট। উকিল মুন্সির আধ্যাত্মিকতাও প্রকৃতি, বিরহ ও স্রষ্টাকে কেন্দ্র করে।
উকিল মুন্সির গানে বিরহ/বিবাগী ভাব একটা আলাদা ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। এই ভাব, প্রেম কিংবা বিরহ আধ্যাত্মসাধনকে ঘিরে। তাঁর এই সংগীত, সংগীতের অন্তরালের বিরহ মানুষকে ভাবাশ্রিত করে, আকর্ষণ করে কালান্তরের স্রোতে। তাঁর গানে রয়েছে প্রেমতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব প্রভৃতির বিকাশ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উকিল মুন্সির গানের মধ্যে শ্রোতার হৃদয়ে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে তাঁর বিরহ গাথার সুর। উকিল মুন্সির গানে নারীর কান্নার বিলাপের সুর পাওয়া যায়। এই স্বতন্ত্র প্রেমময় অভিব্যক্তি ও বিরহ আর্তি মানুষের কাছে তাঁকে আরও সুদৃঢ় করেছে। তাই তাঁকে বলা হয় বিরহী বাউল। তিনি গানে গানে বলেছেন-
"সুজন বন্ধুরে আরে ও বন্ধু কোনবা দেশে থাকো
আমারে কান্দাইয়া বন্ধু রে
কোন নারীর মন রাখো সুজন বন্ধুরে..."
"বন্ধু আমার নির্ধনিয়ার ধন রে
তারে দেখলে জুড়ায় পরান আমার
না দেখলে মরণ রে, বন্ধুরে আমার..."
চার
উকিল মুন্সি পীরের মুরিদ ছিলেন, ছিলেন খেলাফতপ্রাপ্ত। তাঁর পীর ছিলেন হবিগঞ্জের রিচি দরবার শরীফের পীর সৈয়দ মোজাফফর আহম্মেদ (রঃ)। উকিল মুন্সিরও তেমন মুরিদ ছিল, তিনিও অন্যকে খেলাফত দিয়েছেন। এর মাঝে আমরা উকিল মুন্সির দুটি সত্তা খুঁজে পাই। একটি হলো বাউল সাধক উকিল মুন্সি এবং অন্যটি হলো পীর উকিল মুন্সি। কিন্তু বাংলার মানুষ, বাংলা ভাষাভাষী সংগীতপ্রিয় হৃদয় উকিল মুন্সিকে একজন ভাব সাধক ও বাউল হিসেবেই বেশি গ্রহণ করেছেন। কারণ, মানব চরিত কিংবা মানুষের মনস্তত্ত্ব সৃষ্টি কিংবা সৃজনশীলতাকেই বেশি ভালোবাসে।
উকিল মুন্সি যদিও ছিলেন একজন বাউল, পীরের খেলাফতধারী কিন্তু তিনি ছিলেন একমাত্র বাউল যিনি শরীয়তপন্থী সাধক। তিনি মক্তবে বাচ্চাদের আরবি পড়াতেন, মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করতেন, সময়মতো নামাজের আযান দিতেন। জামাতে নামাজ আদায়ের সময় মুসল্লিদের ইমামতি করতেন, রাতভর জিকির করতেন, দরাজ কণ্ঠে গান গাইতেন, মানুষকে বিমোহিত ও ভাবাশ্রিত করতেন। তিনি মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়াতেন। এমনকি, জীবিত ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় ওসিয়ত করে যেতেন যে, তাঁর (জীবিত ওই ব্যক্তি) মৃত্যুর পর যেন উকিল মুন্সি তাঁর জানাজার নামাজ পড়ান। অথচ, উকিল মুন্সি ছিলেন একজন বাউল সাধক।
গ্রামের মুরুব্বিরা, মুসল্লিরা উকিল মুন্সিকে জানাজায় ইমাম হিসেবে পাওয়ার জন্য আকুতি করতেন। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, তিনি গানের আসর করছেন কিন্তু হঠাৎ খবর এসেছে যে জানাজায় যেতে হবে। তিনি গানের আসর ছেড়ে চলে গেছেন জানাজা পড়াতে।
উকিল মুন্সির গানে মুগ্ধ হয়েছেন অনেক পীর-দরবেশসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তৎকালীন সময়ে মদনের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোঃ আবুল ফজল। প্রেসিডেন্টের বাড়িতে মিলাদ মাহফিলের শেষ পর্যায়ে উকিল মুন্সি গিয়ে উপস্থিত হন। আবুল ফজল সাহেব হাত ধরে উকিল মুন্সিকে নিয়ে বসান এবং উপস্থিত মওলানা কে অনুরোধ করেন যে, মোনাজাত ধরবেন উকিল মুন্সি। উকিল মুন্সি মোনাজাতে দু'হাত তুলে শুরু করে দিলেন মূর্শীদি গান, আর অঝোরে কাঁদতে লাগলেন বিরহী এই মুন্সি। ওই মাহফিলের সবাই কাঁদলেন। মোনাজাত শেষে চোখ মুছতে মুছতে আবুল ফজল বললেন, উকিল মুন্সির গান প্রার্থনার চেয়েও বেশি কিছু। তাঁর গানে ফেরেশতারাও কাঁদে। একবার ঘটে যায় এক মজার ঘটনা। মসজিদে গান করা নিয়ে উকিল মুন্সির বিরুদ্ধে এক লোক থানায় অভিযোগ করে। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ওই তদন্তকারী পুলিশ অফিসার উকিল মুন্সির ভক্ত হয়ে যায়।
পাঁচ
আগেই বলেছি উকিল মুন্সি ছিলেন একজন বিরহী বাউল। প্রেম-বিরহ, ভক্তি-ভিনয়, ভাব, সাধন-ভজন, সুর-তাল প্রভৃতি ছিল উকিল মুন্সির গানের প্রধান নিয়ামক। তাঁর বিহনের আকুতি, ভাটি বাংলা তথা আবহমান বাংলার মানুষের মানসবোধ, অন্তরের শূন্যতা এবং যাপিত জীবনের রূপ-রস-গন্ধকে তাড়া করতো। তাঁর সুরের মূর্ছনায় মানুষ তাঁর নিজ অন্তরে ভাবের তাড়না অনুভব করতো।
হাওড়ের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠা মানুষ উকিল মুন্সি। এই হাওড়, হাওড়ের ঢেউ, আফলের গর্জন, একূল-ওকূল ছাপানো দিগন্তজোড়া জলরাশির যোগাযোগহীনতার নিঃসঙ্গতা ছিল উকিলের গানের অনুষঙ্গ। আর ভরা বর্ষার আষাঢ় ও তার পানি ছিল উকিল মুন্সির গানের খোরাক।
চারিদিকে অথৈ পানি, ভরা বর্ষা, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জনপদ সব জনবিচ্ছিন্ন। স্বামীর ঘরে উজান দেশের গৃহবন্দি নারীটি যেন খাঁচা বন্দি পাখির মতো ছটফট করে দিনরাত তার বাবা-মা, আপনজন বিহনে। অসহায় নারীর জীবনের এই গহীনের আর্তনাদ উকিলের উপলব্ধিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই বন্দি নারীর পরবাসবোধ, আপনজনহীনতার বিরহ-বিচ্ছেদ, তার গহীনের আকুতি ও নদীর ঘাটে জল আনবার ছলে ক্ষয়িষ্ণু বিলাপ উকিল মুন্সির গানে ধরা দিয়েছে মানবিক প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা উভয় রূপেই।
উকিল মুন্সি এক বিরহী পাখি। তিনি নারী-পুরুষের অন্তরের আকুতি গানের মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। গানের মাঝেই তিনি প্রকাশ করেছেন নারী-পুরুষের ভালোবাসা, সুখ-দুঃখের কাহিনী, বিরহগাঁথা। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে ও স্বাক্ষী রেখে বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই ভাব জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়কেই ছুঁয়ে যায় সমান তালে। তাই তিনি লিখেছেন-
"আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে, পুবালি বাতাসে
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি আমারনি কেউ আসেরে.."
এই গানে প্রথম দিকে একটি পল্লীবধুর নাইওরের আকুতির কথা প্রকাশ পেয়েছে। শেষ দিকে তিনি নিজেই কার্তিক মাসে নাইওর যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই গানে ও সুরে উকিল মুন্সির হৃদয়ের এক গভীর বেদনার কথা ফুটে উঠেছে। তিনি কেন কার্তিক মাসের শেষে নাইওর যাওয়ার কথা বলেছেন? কারণ, তাঁর পীরের মৃত্যু হয়েছিল কার্তিক মাসের শেষের দিকে। তাই তিনি তাঁর মুর্শিদের যাত্রার সময়কেই ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করেছেন এই গানে।
তিনি আরও লিখেন-
"উড়াল বৈঠা বাইয়া যাওরে
ভরা গাঙে দিয়ারে-
ভাইটাল গাঙের নাইয়া
বন্ধের দেখা পাইলে কইও নাইওর নিতে আইয়া.."
এখানে তিনি 'বৈঠা বাওয়াকে' বুঝিয়েছেন মানব জীবনের কর্মরূপে, 'ভরা গাঙ' কে ইঙ্গিত করেছেন ভবনদীর রূপক হিসেবে এবং 'বন্ধে' শব্দটি দ্বারা মুর্শিদকে ইঙ্গিত করেছেন। এই মুর্শিদ ই তাঁর ভাবনদী কিংবা ভবনদী পারাপারের মাঝি।
উকিল মুন্সি বর্ষা মৌসুম, নৌকা, নাইওর, বিরহ, আকুতি, না পাওয়ার ব্যঞ্জনা প্রভৃতিকে আসলে দুটি রূপক অর্থে সমান তালে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। একটি হলো নারীর বিরহ, আরেকটি হলো জীব ও পরমের মিলনের আকুতি, দ্যোতনা কিংবা ব্যঞ্জনা।
বিবাগী কূল বধূর বাবার বাড়ি ফেরা কিংবা জীব ও পরম পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার জন্য ভাব সাধনার ক্ষেত্রে উকিল মুন্সির মাধ্যম ছিল বিস্তীর্ণ হাওড়ের কিনারবিহীন জল। এই হাওড়ের অথৈ পানিতে শূন্য হৃদয় খড়ে আন্দোলিত হতো উকিলের মানস। তাঁর লেখা অসংখ্য গানের মধ্যে প্রায় দুই শত গান খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু গান মানুষের মুখে মুখে রয়েছে কিন্তু সুনির্দিষ্ট ভাবে সংগৃহীত নয়।
তাঁর বিরহ বিচ্ছেদ গুলোর মধ্যে সুজন বন্ধুরে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে, নিলুয়া বাতাসে প্রাণ না জুড়ায়, বন্ধু আমার নির্ধনিয়ার ধন রে, তুমিনি আমার বন্ধু আমিনি তোমার বন্ধুরে, আমার মনে মানে না মানা, সখী রে প্রাণ বন্ধুরে আনিয়া দেখা না, বন্ধুরে আমি মইলে কী লাভ হবে তোর, আমায় যে দুঃখ দিয়েছো কলিজায়, সংবাদে অঙ্গ জুড়ায় না গো সখী, আমার প্রাণ বন্ধুয়া আসিয়া আমার দুঃখ দেখিয়া, তোমারে দেখিবার মনে লয় সুজন বন্ধুরে, পিরিত কইরা আমার সুখ হইলো না, যার লাগি যার প্রাণ কান্দে দিবা নিশি প্রভৃতি খুবই জনপ্রিয়।
ছয়
মরমী সাধকদের প্রেম সাধারণ কোনো মানুষের প্রেমের মতো নয়। সাধকদের প্রেম সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মনীতি, বিশ্বাস, কূল, প্রথা, আচার-বিচার এগুলোকে প্রাধান্য দেয় না। এই প্রেম মূলত মননের সাথে প্রকৃতির, উপলব্ধির সাথে সৌন্দর্যের, জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার।
জীব-পরমের মিলনের সহজিয়া ভাবই হলো সাধকদের ধ্যান-জ্ঞান। অধরাকে ধরার, অজানাকে লব্ধ করার, অপ্রাপ্তিকে বশ্য করার, বিহনের বন্ধুর সাথে মিলনের প্রবল আকুতি ও হাহাকারই ছিল উকিল মুন্সির গানের প্রধান ভাব।
তিনি কখনও তত্ত্বজ্ঞানে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং কখনো তত্ত্ব খুঁজতে যাননি কিংবা তত্ত্বের দাসত্ব করেননি। তিনি মগ্ন থাকতেন তাঁর ভাব-সাধনা নিয়ে, তার সুর ও সংগীত নিয়ে। তাই উকিলের গানে মানবসত্ত্বা ও পরমসত্ত্বার মধ্যে প্রেমের যে ভেদ, তার সন্ধান করতে যাওয়া অবান্তর। বৈষ্ণব, বাউল কিংবা সহজিয়া মতে, মানুষই সব কিছুর আধার। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মানুষের মাঝেই পরমেশ্বরের বাস। তাই তাঁরা অকপটে প্রচার করেন খ্রিষ্টান ধর্মে আছে মানুষ ঈশ্বরের পুত্র, পুরাণে আছে মানুষই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ অবতার, বৌদ্ধ ধর্মে আছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা হলো মানুষ।
আর আল-কোরআনে আছে 'আশরাফুল মাখলুকাত' অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হলো মানুষ। তাঁরা আরও বলেন, 'কুলবিল মোমেনিন আরশে আল্লাহ' অর্থাৎ, মুমিনের কলব বা অন্তর হলো আল্লাহর আরশ স্বরূপ। তাই বাউলদের গানে জীবাত্মা- পরমাত্মা, রাধা-কৃষ্ণ, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ প্রভৃতি কেবল রূপক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। উকিল মুন্সি তাঁর গানে বন্ধুয়া, সুজন বন্ধু, শ্যামচান প্রভৃতি পরমাত্মার রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সাত
উকিল মুন্সি তাঁর আমলে যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তা নিঃসন্দেহে গ্রামীণ জনপদে একটি ধনাঢ্য পরিবার। তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর সমসাময়িক কালে তিনি পুরো ভাটিবাংলার একজন প্রখ্যাত বাউল সাধক ছিলেন। কিন্তু তাঁর শিশুকাল থেকে শেষজীবন অব্দি যদি একটি সরল রেখাপাত করি, তাহলে আমরা কী দেখতে পাই? আমরা দেখতে পাই এক অনাথ কিশোর, মাতৃ-পিতৃ স্নেহবঞ্চিত এক উঠতি যুবক, প্রেমবঞ্চিত এক পূর্ণ যুবক, ভিটে-মাটি জমি-জমা খোয়ানো এক দিশেহারা মানুষ, অসময়ে অকস্মাৎ সন্তান হারানো এক শোকাতুর পিতা, প্রিয়তম স্ত্রী হারানো এক বিবাগী ডাহুক।
উকিলের বয়স যখন দশ বছর, তখন তাঁর পিতা গোলাম রসুল আকন্দ মারা যান। অতঃপর তাঁর মা উকিলেন্নাসা সমসাময়িক বাস্তবতায় পাশের থানায় দ্বিতীয় বিয়ে করে ছোট ভাই মজিদ আকন্দসহ উকিলকে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হন। তারপর তাঁর আশ্রয় হয় কিশোরগঞ্জের ইটনার ঠাকুর বাড়িতে তাঁর ফুফুর কাছে। এর মধ্যে আকস্মিকভাবে মারা যান উকিলের ছোট ভাই।
পিতৃ-মাতৃ ছায়াহীন উকিলকে এসময় ঘরহীন-বন্ধনহীন বহেমিয়ানাপনায় পেয়ে বসে। তিনি তখন উনিশ-বিশ বছরের উঠতি যুবক। বন্ধনহীন উকিল পার্শ্ববর্তী মোহনগঞ্জের জামালপুর গ্রামের সাধারণ এক গরিব কৃষকের মেয়ে হামিদা খাতুন/বাণুর প্রেমে পড়েন।
হামিদার প্রেমে পাগল প্রায় উকিল মুন্সি। তাঁর ফুফা ছিলেন গ্রামের নামজাদা ব্যক্তিত্ব। তিনি এ খবর শোনার পর উকিলকে গ্রাম ত্যাগের নির্দেশ দেন এবং উকিল মুন্সি গ্রামত্যাগী হন। উকিল মুন্সি তখন দিশেহারা হয়ে এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তিনি মোহনগঞ্জ, জৈনপুর, শ্যামপুর, পাগলাজোর, আটবাড়ি নানান এলাকায় ছন্নছাড়া জীবনযাপন করতে থাকেন। এ সময় তিনি আবার নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং তাঁর পিতৃকূলের জমিজমা পানির দরে বিক্রি করতে থাকেন। উকিল মুন্সি এবং হামিদা খাতুন দুজনের অবস্থাই তখন পাগল প্রায়। হামিদা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে উকিল মুন্সি গান লিখেন-
"ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে
সোনার জামালপুর।
সেইখানেতে বসত করে
উকিলের মনচোর।"
একপর্যায়ে মেয়ের পাগল প্রায় দশা দেখে হামিদা খাতুনের বাবা লবু হোসেন উকিল মুন্সিকে খুঁজে বের করে সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিঃশর্তে উকিল মুন্সির সাথে হামিদা খাতুনের বিয়ে দেন। সেই থেকে উকিল মুন্সি জামালপুর গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। এখানে তাঁর ছেলে আব্দুস সাত্তারের জন্ম হয়। এরপর তিনি মদন থানার কুলিয়াটি গ্রামে চলে যান।
সেখানে মসজিদে ইমামতি করেন, মক্তবে ছেলে-মেয়েদের আরবি পড়ান, মসজিদে আযান দেন, জামাতে মুসুল্লিদের নামাজ পড়ান। নির্জনে একা থাকা উকিল মুন্সি নিজেই গজল রচনা করতেন এবং উচ্চস্বরে সুমধুর কণ্ঠে গাইতেন। গভীর রাতে তাহাজ্জুত নামাজ শেষে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করতেন ও গজল গাইতেন, রাত পার করে দিতেন।
অতঃপর তিনি চলে যান হবিগঞ্জের রিচি দরবার শরীফের পির সৈয়দ মোজাফফর আহম্মেদ (র:) এর কাছে। তিনি সেখানে মুরিদ হন। তাঁর পির ছিলেন শরীয়তপন্থী এবং উকিল মুন্সিও ছিলেন শরীয়তপন্থী একমাত্র বাউল সাধক। তিনি জীবনে একটি ছবি পর্যন্ত তোলেননি। একতারা ও চটি বাজিয়ে গান করতেন তিনি।
আট
উদাসী গোছের উকিল মুন্সি কোথাও বেশিদিন মনস্থির করতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনি জৈনপুরে বেতাই নদীর তীরে বাড়ি করেন। আব্দুস সাত্তারের পর উকিল মুন্সির আরো এক ছেলে ও দুই মেয়ে জন্ম নেয়। এর মধ্যে উকিল মুন্সির প্রিয়তমা স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় ছেলের নাম পুলিশ মিয়া আর মেয়েদের নাম সন্তোষের মা ও রাবেয়া খাতুন।
১৯৭৮ সালের ৬ আগস্ট হঠাৎ করে আব্দুস সাত্তারও মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রী বিয়োগের পর পর ছেলের মৃত্যু শোকে উকিল মুন্সি পাগলপ্রায় হয়ে যান। শোকে চোখের পানি আর থামে না উকিল মুন্সির। পুত্রের মৃত্যুর পর উকিল মুন্সি মাত্র কয়েকমাস বেঁচেছিলেন, কিন্তু খুবই এলোমেলোভাবে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি। শোকে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া উকিল মুন্সি এ ধরায় আর বেশিদিন নিজেকে রাখেননি। তিনিও কিছুদিন পর একই বছরের (১৯৭৮) ১২ ডিসেম্বর চিরতরে সবাইকে অশ্রুস্নাত করে নিজের চোখের জল থামিয়ে দেন।
আমরা তাঁর জীবনের লেখচিত্র অঙ্কন করলে দেখতে পাই তাঁর পুরোটা জীবনই আসলে কেটেছে আপনজন হারানো বেদনা, না পাওয়ার আকুতি, বেদনার আর্তনাদ, ভাঙ্গনের আহুতি, স্নেহ-মায়া বিবর্জিত শৈশব-কৈশোরে, প্রেমানলে পোড়া যৌবন, স্ত্রী-সন্তান হারানো শোকাতুর পৌঢ় জীবন।
ছোটবেলা থেকে পিতা-মাতা বিহীন উকিল মুন্সি তাঁর মনের অতৃপ্তি, অনাদর-অবহেলা, প্রিয়জনের ভালোবাসা হীনতা, গভীর শূন্যতা থেকেই নিজের মনে বিরহকে লালন করেছিলেন।
হাওড়ের বিস্তর অথৈ পানি, আকাশ মেঘের লুকোচুরি, সারি সারি হিজলের প্রান্তর, মাঝি-মাল্লাদের উদাস গলার গান উকিল মুন্সির দরদী মনকে উদাস করে তুলতো। তার সাথে এই অনন্ত বিরহ ও বিচ্ছেদই উকিল মুন্সিকে আরও বিবাগী করে তোলে।
তাঁর মনে বিরহের ঢেউ তোলে প্রিয়জন হারানোর ব্যঞ্জনা। এজন্যই তাঁর গানে পাওয়া যায় বিরহ ও নারী হৃদয়ের বিলাপের সুর। এই না পাওয়া, অতৃপ্ত মনের দ্যোতনা, বঞ্চনা তাঁকে বিরহী ও বিবাগী করে তুলেছে। আজ বেতাই নদীর তীরে উকিল মুন্সির ইচ্ছানুযায়ী বাড়ির সাথেই উকিল মুন্সি ও তাঁর ছেলে আব্দুস সাত্তার মিয়ার কবর। এক চালের নিচেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন দুজন পাশাপাশি।
রুবেল সাইদুল আলম একাধারে একজন কবি, বাউল গবেষক এবং লোকশিল্পী। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ কাস্টমসে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে কর্মরত আছেন।