সার সংকট: সর্বোচ্চ উৎপাদন মৌসুমে বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে কৃষকদের
পর্যাপ্ত পরিমাণে সারের মজুদ গড়ে তুলতে না পারায় দেশে কৃষি পণ্য উৎপাদনের সর্বোচ্চ রোবো মৌসুমে সারের সরবরাহ সংকটের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের বেশিরভাগ জেলায় বাড়তি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এমন একটি সময়ে কৃষকদের সারের পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, যখন চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুমের শুরু। বোরো মৌসুমে ২ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়— যা সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখে।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বীজতলা তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় বোরো ধানের মৌসুম। এ মৌসুম সেচের পানির ওপর নির্ভরশীল। বীজতলা তৈরির পর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে রোপণ করা হয় চারা; এরপর ফসল কাটা হয় এপ্রিল-মে মাসে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নওগা, বগুড়া, গাইবান্ধা, খুলনা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, কেজিপ্রতি ২–১১ টাকা পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে কৃষককে।
সার বিক্রেতারা টিবিএসকে জানান, চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বোরো মৌসুমের শুরুতে দাম বাড়ছে, একইসঙ্গে এ বছর মজুদের পরিমাণও কম। যদিও এরসঙ্গে একমত নন কৃষি কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে কোনো ঘাটতি নেই। কর্মকর্তাদের দাবি, কিছু ডিলার মজুতদারি ও সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছেন।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ধানের সঙ্গে এই মৌসুমে সারাবছরের জন্য পেঁয়াজ, আলু, সরিষা, গম উৎপাদন হয়। প্রচুর পরিমাণে সবজি উৎপাদনের এই সময়টাতে বাজারের বিভিন্ন সবজির দাম থাকে নাগালের মধ্যে। এজন্য ডিসেম্বর-মার্চ পর্যন্ত সময়কে সর্বোচ্চ পিক সিজন বা সর্বোচ্চ মৌসুম ধরা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া টিবিএসকে বলেন, "বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কঠোরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবে একেবারে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত ম্যানেজ করাটা কঠিন। আবার অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সার কেনার জন্য ভিড় করছেন, এটাও একটা কারণ।"
তিনি বলেন, "সারের কোনো সংকট নেই। কোথাও সরবরাহটা এক-দুদিন দেরি হলেই সেখানে একটা ক্রাইসিস তৈরির চেষ্টা হয়। কেউ যদি সারের দাম বেশি নেন এবং সেটা কৃষক ভাইরা কৃষি অফিসে এসে অভিযোগ করেন, তাহলে সাথে সাথেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের বর্তমান মজুদ
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) নন ইউরিয়া— টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের যোগান দিয়ে থাকে। বিএডিসির পাশাপাশি নন-ইউরিয়া সারের একটা যোগান আসে বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নন-ইউরিয়া ও ইউরিয়া সারের মজুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নন-ইউরিয়া হিসেবে পরিচিতি টিএসপি সারের ডিসেম্বর-মার্চ পর্যন্ত চার মাসের চাহিদা ৩.৬১ লাখ মেট্রিক টন, ডিএপি সারের চাহিদা ৭.৪৪ লাখ মেট্রিক টন এবং এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে ৪.১৩ লাখ মেট্রিক টন।
এর বিপরীতে বিএডিসির গুদাম ও পরিবহনাধীন সারের মোট মজুদের মধ্যে টিএসপি ১.০২ লাখ মেট্রিক টন, ডিএপি ১.৩৯ লাখ মেট্রিক টন এবং এমওপি সার রয়েছে ২.২৯ লাখ মেট্রিক টন। এটি প্রতিষ্ঠানটির গত ১০ ডিসেম্বরের হিসাব।
এছাড়া, ডিসেম্বর মাসের চাহিদার একটি অংশ সরবরাহ করবে বেসরকারি আমদানিকারকরা। বিএডিসির বাইরে মোট চাহিদার ২৫.৬৮ শতাংশ টিএসপি, ৩০.৪৩ শতাংশ ডিএপি এবং ১৮.৩৭ শতাংশ এমওপি সার সরবরাহ করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
সারের চাহিদার অধিকাংশই সরবরাহ করে থাকে বিএডিসি, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সেভাবে মজুদ গড়ে তুলতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএডিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, "আমদানির পাইপলাইনেও পর্যাপ্ত পরিমাণ সার নেই, যা দিয়ে পিক সিজনের চাহিদার পুরোটা সামাল দেওয়া যাবে।"
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) স্থানীয় উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে ইউরিয়ার যোগান দিয়ে থাকে। তবে ইউরিয়া সারের টানাটানি শুরু হয়েছে এ বছরের শুরু থেকেই।
সারা বছরে ইউরিয়ার চাহিদা ৩২ লাখ মেট্রিক টন, যেখানে ব্যবহারযোগ্য ইউরিয়ার চাহিদা ২৭ লাখ মেট্রিক টন এবং নিরাপত্তা মজুদ থাকার কথা ৫ লাখ টন। এরমধ্যে শুধু এই চার মাসেই ইউরিয়ার চাহিদা সাড়ে ১৪ লাখ টনে পৌঁছেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে যে মজুদ তৈরি হয়েছে, তা নিরাপত্তা মজুদ বাদে কেবল ডিসেম্বর মাসের চাহিদা পূরণ করবে।
ডিসেম্বরে সারের চাহিদা ৩.১৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে বিসিআইসির হাতে আছে ৭.২৫ লাখ মেট্রিক টন (নিরাপত্তা মজুদসহ)। এ মজুদ দেখানো হয়েছে ডিসেম্বরে দেড় লাখ মেট্রিক টনের সম্ভাব্য আমদানি ধরে, যেটা এখনো দেশে এসে পৌঁছায়নি। অর্থাৎ, ডিসেম্বরে সার ব্যবহার করলেই হাত পড়বে নিরাপত্তা মজুদে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য আমদানি ধরেও আগামী মার্চে গিয়ে প্রায় দেড় লাখ টন ইউরিয়া ব্যবহার করতে হবে নিরাপত্তা মজুদ থেকে। যেটা উৎপাদন বৃদ্ধি করে বা বর্তমান আমদানি চুক্তির বাইরে গিয়ে সংগ্রহ করতে হবে।
এদিকে, চলতি ডিসেম্বরে দেড় লাখ মেট্রিক টন, আগামী জানুয়ারিতে ২.১০ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে প্রায় দেড় লাখ এবং মার্চে ৩০ হাজার মেট্রিক টনের সম্ভাব্য আমদানি ধরেই ইউরিয়ার মজুদ হিসেব করা হয়েছে।
সংশ্লিস্টরা বলছেন, কোনো কারণে যদি আমদানি হওয়া সার ঠিক টাইমে দেশে না আসে, তাহলে সংকট বড় হবে।
সংকট কেন?
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইউরিয়া সার নিয়ে টানাটানি এই অর্থবছরের শুরু থেকেই। দেশের রাজনৈতিক সংকট, ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণেই ঠিকমতো সার আমদানি হয়নি। আবার গ্যাসের সংকটে ৫টি কারখানার অধিকাংশই ছিল বন্ধ। এর প্রভাবে জুলাই, আগস্ট এবং নভেম্বরে চাহিদার চেয়ে কম সার সরবরাহ করেছে বিসিআইসি।
বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ডলার সংকট কেটে যাওয়ার পর থেকেই সার আমদানিতে কোনো সমস্যা নেই, সবটাই সময়মতো দেশে আসছে।"
তিনি আরও জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত (গত জুলাই থেকে) সার আমদানি হয়েছে ৫.১৫ লাখ মেট্রিক টন এবং উৎপাদন হয়েছে ৫.৪০ লাখ মেট্রিক টন।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, "ডিসেম্বর পর্যন্ত চলার মত সার রয়েছে। তবে সময়মতো যদি বিদেশ থেকে সার না আসে, তবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারীতে সংকট হবে।"
"সারের সংকট হলে উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য সরকারকে আরও দ্রুত সারের মজুদ গড়ায় মনোযোগী হতে হবে," যোগ করেন তিনি।
সারের দাম বাড়তি
ইউরিয়া, নন ইউরিয়া সারে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এজন্য সরকার এই সারগুলোর দামও নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সারাদেশেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
যদিও এ অভিযোগ কিছু ডিলার ও বিক্রেতাকে আইনের আওতায়ও আনা হয়েছে।
গত ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় অবৈধভাবে সার মজুত করে দালালের মাধ্যমে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে এক মধ্যস্বত্বভোগীকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং একজন ডিলারকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কৃষকেরা সরাসরি সার না পেলেও ডিলারেরা বেশি দামে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে সার বিক্রি করছেন।
অনেক ডিলারের বিরুদ্ধেই এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তারা নিজেরা সার বিক্রি না করে খুচরা বিক্রেতাকে দিয়ে দিচ্ছেন। যেখান থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এ অভিযোগের কথা অবশ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করছে।
কুমিল্লা নগরীর চকবাজারের আক্তার ট্রেডার্সের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন (ডিলার) বলেন, "কুমিল্লায় টিএসপি ছাড়া অন্য সব সারের সরবরাহ ভালো। টিএসপি সার জাঙ্গালিয়ার পরিবর্তে কিছুদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। যার কারণে জ্বালানি খরচ বেশি পড়ায় কেজিপ্রতি ২৭ টাকার পরিবর্তে ২৯ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।"
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর বাজারে সাব ডিলার হিসাবে সার বিক্রি করছেন মো. আবদুল মাজেদ। সারের অতিরিক্ত দামে এ বিক্রেতাও চিন্তিত। তিনি জানিয়েছেন, প্রতি মৌসুমের শুরুতে হঠাৎ করে সংকট দেখিয়ে সারের দাম বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, "ইউরিয়া থেকে শুরু করে নন ইউরিয়া সারের বস্তাপ্রতি ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে আমাদের। যে কারণে খুচরায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।"
সদর উপজেলার চর মনসা গ্রামের সবজি চাষী আবুল বারাকাত জানান, তিনি চলতি সপ্তাহে ইউরিয়া সার কিনেছেন প্রতিকেজি ৩৫ টাকা দামে। ডিএপি সার ৪০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে তার। কোনো কোনো দোকানি ডিএপি, টিএসপি 50 টাকাও বিক্রি করছেন।
কৃষকদের অভিযোগ, পরিবেশকরা (ডিলার) কৃষকদের কাছে সার বিক্রি না করে অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। পরে সেই সার খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাদের।
অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুরের কৃষক আবদুজ জাহের এবং খুচরা বিক্রেতা মাজেদ ও বাতেন জানান, ডিলাররা (পরিবেশক) কৃষকদেরকে কোনো ক্যাশমেমো দিয়ে সার বিক্রি করেন না।
এদিক, লক্ষ্মীপুরের সারের ডিলার আক্তার এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মো. আরিফ জানান, বিভিন্ন কারখানায় অগ্রিম টাকা দিয়েও সময়মতো সার উত্তোলন করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু সারে সংকট রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দিন ফিরোজ বলেন, "সারের কোনো সংকট নেই। অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির কোনো অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।"