যুক্তরাষ্ট্রে মামলা দায়েরের পর টালমাটাল হয়ে উঠেছে ভারতের ‘সফট পাওয়ারের’ প্রতীক আদানি গ্রুপ
কিছুদিন আগে মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী গৌতম আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা দায়ের করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট আদানির কোম্পানির সঙ্গে নাইরোবির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং দেশের বিদ্যুৎ গ্রিড সংস্কারের আকর্ষণীয় চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
এর কয়েকদিন পর ইউরোপের বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানি টোটালএনার্জিস ঘোষণা দেয়, তারা আর আদানির প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে না।
এখন বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা—যেখানে ভারত ও চীন প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা লিপ্ত—আদানির সঙ্গে তাদের বিভিন্ন চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছে।
গত এক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী ভারতের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছে আদানি গ্রুপ। শিল্পগোষ্ঠীটি ভারতে বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, খনি, বিমানবন্দর, এমনকি একটি টিভি চ্যানেলেরও মালিক। বাজারমূল্যে ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানি। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণ, অর্থায়ন ও পরিচালনা করার সক্ষমতা আদানিকে ভারতের কর্পোরেট আইকনে পরিণত করেছে।
বিশ্ব অঙ্গনে ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার এই প্রচেষ্টার সুবাদে আদানি হয়ে ওঠেন বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। তার ব্র্যান্ড বিস্তৃত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে। খুব কম ভারতীয় কোম্পানিই এখনও পর্যন্ত সাফল্যের দেখা পেয়েছে।
কিন্তু এখন আদানির এই সাম্রাজ্যের সবই ভেঙে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
গত ২০ নভেম্বর নিউইয়র্কের প্রসিকিউটররা আদানির বিরুদ্ধে ঘুষপ্রদান এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। আদানিসহ তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। প্রসিকিউটররা বলেন, আদানি ও তার সহযোগীরা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি পেতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ২৬৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছেন; তারপর ওয়াল স্ট্রিটে এই ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে মিথ্যা বলেছেন।
আদানি গ্রুপ এই অভিযোগকে 'ভিত্তিহীন' আখ্যা দিয়ে আইনি পথে এর মোকাবিলা করার ঘোষণা দিয়েছে।
আদানির বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগের রেশ এখনও রয়ে গেছে ভারতের শেয়ারবাজার, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও আদানি গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসা করা দেশগুলোর সরকারের মধ্যে। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে গ্রুপটির সম্পর্ক ক্রমশ চাপের মুখে পড়ছে।
মোদি নিজে আদানির সংকট নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মুখপাত্ররা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে স্পষ্ট করেছেন, আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপকে তারা ভারতের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও মার্কিন 'ডিপ স্টেট' বিজেপিএর রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে 'ভারতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা' চালাচ্ছে।
নয়াদিল্লিতে মার্কিন দূতাবাস এই অভিযোগকে 'হতাশাজনক' বলে উল্লেখ করেছে।
ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিজেপির এই অভূতপূর্ব আক্রমণই বলে দিচ্ছে, শাসক দল কতটা গভীরভাবে আদানির স্বার্থকে তাদের নিজস্ব স্বার্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত দেখছে।
টাফটস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুলের গ্লোবাল বিজনেসের ডিন ভাস্কর চক্রবর্তী বলেন, মোদির সরকারকে 'প্রচুর সফট সাপোর্ট' দিয়েছেন গৌতম আদানি।
২৫ বছর আগে গুজরাতে কর্মজীবন শুরু করার পর থেকেই তারা মিত্র। ভাস্কর চক্রবর্তী বলেন, আদানির বড় চুক্তি ও জনহিতৈষী প্রকল্পে কাজ করা ট্র্যাক রেকর্ড ভারতকে 'বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন কমিউনিটির' অংশ হতে সাহায্য করেছে। ১০ বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মোদি ভারতের এ ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন।
চলতি বছরের ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মামলার খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো নাইরোবিতে পার্লামেন্টে ভাষণ দেন।
রুটো আগে থেকেই চাপে ছিলেন। ক্রমবর্ধমান কর, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ অপহরণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক জনঅসন্তোষের মুখোমুখি তার প্রশাসন। কেনিয়ার বিদ্যুৎ গ্রিড উন্নয়ন এবং দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর আধুনিকীকরণ—আদানি গ্রুপের এ দুটি প্রকল্প চুক্তি করতে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ও তার মিত্রদের। সমালোচকেরা বলছেন, এ দুটি প্রকল্প স্রেফ দুর্নীতির জন্য এবং টাকার অপচয়।
নিউইয়র্কের খবর রুটোকে সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগ দেয়। তিনি কেনিয়ার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, অবিলম্বে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলোর জন্য বিকল্প অংশীদারের খোঁজ শুরু করতে।
মান বাঁচাতে পরে আদানি গ্রুপ বলে, নাইরোবির বিমানবন্দর প্রকল্প নিয়ে কেনিয়ার সঙ্গে তাদের কোনো বাধ্যতামূলক চুক্তি ছিল না। কোম্পানিটি আরও যুক্তি দেয়, 'ভিত্তিহীন' এই অভিযোগ তাদের কার্যক্রমেও কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এর কয়েকদিন পর, ৩০ নভেম্বর, গৌতম আদানি একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বলেন, 'প্রতিটি আঘাত আমাদের আরও শক্তিশালী করে তোলে।'
তবে কেনিয়ার ঘটনা ছিল কেবল শুরু। এরপর ভারতের কিছু রাজ্য সরকারও—যেগুলো বিজেপির নিয়ন্ত্রণে নেই—আদানির সঙ্গে বড় চুক্তিগুলো পর্যালোচনা বা বাতিল করার হুমকি দিয়েছে। সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে আনা মার্কিন অভিযোগের তদন্ত দাবি করছেন। এ কারণে গত তিন সপ্তাহে বেশিরভাগ সময়ই সংসদের কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হয়েছে।
আদানির বিদেশি অর্থায়নের উৎসগুলোও শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যেতে পারে—যদি ইতিমধ্যেই তা না হয়েও থাকে।
২৫ নভেম্বর প্যারিসভিত্তিক বৃহৎ কর্পোরেশন টোটালএনার্জিস ঘোষণা দিয়েছে, তারা আদানির নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ বন্ধ রাখবে। আদানি গ্রিন এনার্জিতে টোটালএনার্জিসের ২০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
মার্কিন বিশ্লেষকরা আদানির অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী মিয়ামিভিত্তিক জিকিউজি পার্টনার্সকে অবনমিত করার পর কোম্পানিটি এক রাতে ১৩ শতাংশ বাজারমূল্য হারিয়েছে।
আদানির অর্থ সংস্থানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বিভিন্ন দেশের সরকারও আদানির প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
শ্রীলঙ্কায়—যেখানে আদানি কলম্বো বন্দরের পুনর্নির্মাণ ও বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে—নতুন সরকার ইতিমধ্যেই কিছু প্রকল্প পর্যালোচনা শুরু করে দিয়েছে।
একটি মার্কিন বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা গত বছর বন্দরের প্রকল্পে আদানিকে অর্ধ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নিউইয়র্কে মামলা হওয়ার পর সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রকল্পটির যাচাই-বাছাই চলমান থাকায় তারা এখনও কোনো অর্থছাড় করেনি। এর জবাবে ১১ ডিসেম্বর আদানি গ্রুপ জানায়, তারা নিজ উদ্যোগেই প্রকল্পটির কাজ করবে এবং মার্কিন অর্থায়ন ছেড়ে দিয়ে অর্থায়নের অন্য উৎস খুঁজবে।
এদিকে আগস্টে বাংলাদেশে ভারতপন্থি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি মোতাবেক কেনা বিদ্যুতের দাম নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। ১ ডিসেম্বর জ্বালানি উপদেষ্টা রয়টার্সকে বলেন, উচ্চ আদালত যদি বিদ্যুৎ চুক্তিটি সম্পূর্ণ বাতিল না করে, তাহলে আদানিকে তাদের বিদ্যুতের দাম অনেকটা কমাতে হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মামলাটি আইনি পর্যালোচনায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।
মোদি ক্ষমতায় থাকার এক দশকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে আদানি গ্রুপ। মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন গৌতম আদানি মূলত ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় কয়লা খনি এবং কয়লা ব্যবসার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছিলেন। এখন ভিয়েতনাম, কাজাখস্তান ও তাঞ্জানিয়াসহ অন্তত আটটি দেশে আগানি গ্রুপের কার্যক্রম চলমান বা পরিকল্পনায় রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার এক সপ্তাহ পরে আদানি ঘোষণা দেন, তার কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
আদানি গ্রুপ প্রায়ই দাবি করে, তাদের এবং ভারতের স্বার্থের মধ্যে কোনো অস্বচ্ছতা নেই। তবে বিদেশে তাদের নিয়ে ধারণায় পরিবর্তন আসেনি। ফ্লেচার স্কুলের ভাস্কর চক্রবর্তী বলেন, মোদি ও আদানির 'ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক' অনেক দেশের সরকারের সঙ্গে আদানির যোগাযোগ সহজ করেছে।
ভাস্কর চক্রবর্তী বলেন, এরকম একটি চুক্তি করা হয়েছিল ইসরায়েলে। ওই চুক্তির আওতায় আদানি গ্রুপ একটি স্থানীয় অংশীদারের সঙ্গে যৌথভাবে ১.১৮ বিলিয়ন ডলারে হাইফা বন্দর কিনে নিয়েছে। ভারতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতই একাবারে শুরুর দিকে বলেন, আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া মামলার কারণে তাদের সম্পর্কে কোনো সমস্যা তৈরি হবে না।
তবে সমস্যা গজিয়ে উঠছে অন্য জায়গায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কেনিয়ায় প্রেসিডেন্ট রুটো অবস্থান বদলের কারণে তিনি বরং আরও দুর্বল হয়েছেন। নাইরোবির বিমানবন্দরটিতে দ্বিতীয় রানওয়ে প্রয়োজন। এখনও সেটি নির্মাণের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। উচ্চ আদালতের একজন বিচারক সরকারকে আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা সব চুক্তি বাতিল করার প্রমাণ উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন।
বাজেটের স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করা কেনিয়ান অলাভজনক সংস্থা বাজেটি হাবের নির্বাহী পরিচালক আব্রাহাম রুগো বলেন, কোন কোন দরকষাকষি ও চুক্তির ভিত্তিতে অবকাঠামো চুক্তিগুলো করা হয়েছিল, তা নিয়ে আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, 'মোদ্দা কথা হচ্ছে, ভবিষ্যতের এ ধরনের সব চুক্তিতে জনস্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।'