হেক্টরপ্রতি বছরে সার ব্যবহার সাড়ে ৮ কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ কেজিতে: রিজওয়ানা
কৃষি উৎপাদনে ভয়ংকর মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, একসময় যেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে বছরে সাড়ে ৮ কেজি রাসায়নিক সার ব্যবহার হতো, এখন তা বেড়ে ৭০০ কেজিতে পৌঁছেছে।
'এ রাসায়নিক আবার ঘুরে ফিরে আমাদের শরীরেই প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে ৯৮ টাকার কীটনাশক লাগার কথা, বর্তমানে তা ৮৮২ টাকার লাগছে,' বলেন এ উপদেষ্টা।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএআরএফ) আয়োজিত 'কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা আরও বলেন, ২০০৫ সালে ১২ হাজার মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল, কিন্তু ২০২০ সালে তা বেড়ে ২৭ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ, আমরা দ্বিগুণের বেশি কীটনাশক আমদানি করছি।
তিনি বলেন, 'এসব রাসায়নিক খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে যাচ্ছে। তাই শুধু খাদ্য উৎপাদন করলেই হবে না, বরং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে।'
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, 'আমরা হাইব্রিড যুগে পৌঁছে গেছি। খাদ্যসহ সবকিছু আমাদের বেশি করে উৎপাদন করতে হবে। তবে অধিক খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনেও মনোযোগ দিতে হবে।'
তিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় জলবায়ু সহিঞ্চু জাত, যেমন ব্রী ধান-৫২ ও বীনা-১১ ধান উৎপাদন করা হচ্ছে। স্মার্ট প্রযুক্তি এবং যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এর প্রভাব মোকাবিলার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় 'খামারি' নামক একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে। দ্রুতই এ অ্যাপটির কার্যক্রম শুরু হবে।
'এ অ্যাপের মাধ্যমে জমির পরিমাণ অনুযায়ী মাটির উর্বরতা বিবেচনা করে কোন ফসল ভালো ফলবে, কতটুকু সার লাগবে এবং কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে—এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।'
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ হারে জমি কমছে। আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এজন্য সব অংশীদার মিলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্যও ধরে রাখতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর দুটি উপায় রয়েছে—জমির পরিমাণ বাড়ানো এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। যেহেতু জমি বাড়ানোর সুযোগ নেই, তাই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ সীড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. আলী আফজাল মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত বনাঞ্চল উজাড়, লবণাক্ততা, পানি দূষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জমির অবক্ষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং শিল্পবর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে।
তিনি জানান, বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ হেক্টর বা ৩০ শতাংশেরও বেশি উপকূলীয় ভূমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ধানের ফলন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এতে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি তিন হাজার ৮৪০ থেকে পাঁচ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।
ড. আফজাল আরও বলেন, রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুরসহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার কারণে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় হঠাৎ বন্যায় তিন লাখ ৩৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এতে গবাদি পশু ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ১৫.৬ কোটি মার্কিন ডলার।
এ বন্যায় আউশ ও আমনের প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রবন্ধ উপস্থাপনায় জানান ড. আফজাল।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত 'কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট' অনুযায়ী, সাইক্লোনের প্রভাবে বাংলাদেশ প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়ে।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশগত ঝুঁকি, হঠাৎ বন্যা এবং সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের কারণে কৃষি জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।