কেনিয়ার বিমানবন্দর-আদানি গ্রুপের বিতর্কিত চুক্তি ফাঁস করেন যে শিক্ষার্থী
কেনিয়ার শিক্ষার্থী নেলসন আমেনিয়া আদানি গ্রুপের সঙ্গে তার দেশের প্রস্তাবিত একটি চুক্তি ফাঁস করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকারীদের কাছে বর্তমানে তিনি নায়ক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন।
সম্প্রতি কেনিয়ায় বড় চুক্তিগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আইন থাকা সত্ত্বেও, এগুলো থামানো সম্ভব হয়নি।
৩০ বছরের আমেনিয়া ফ্রান্সে এমবিএ করছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি কেনিয়ার বৃহত্তম বিমানবন্দর জোমো কেনিয়াটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (জেকেআইএ) লিজের নথি পেয়েছেন।
আমেনিয়া বিবিসিকে বলেন, "প্রথমে নথি পেয়ে মনে হয়েছিল, এটা আরেকটা সাধারণ সরকারি চুক্তি… এর গুরুত্ব বা গভীরতা বুঝতে পারিনি।"
নথিতে বলা হয়, ভারতের আদানি গ্রুপ ৩০ বছরের জন্য জেকেআইএ পরিচালনা ও আধুনিকীকরণের জন্য ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
নথি পড়া শুরু করার পর আমেনিয়ার মনে হয়, চুক্তি কার্যকর হলে "কেনিয়ার অর্থনীতির ক্ষতি হবে" এবং সব লাভ যাবে ভারতীয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে।
নথি পড়ে তার মনে হয়, চুক্তিটি কেনিয়ার জন্য অন্যায় কারণ, সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করলেও দেশটি আর্থিক লাভ পাবে না।
আমেনিয়া জানান, নথি আসল মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল, যেহেতু "যারা নথি দিয়েছিলেন, তারা সরকারের বৈধ বিভাগের লোক।"
আদানি গ্রুপ বিশ্বব্যাপী পরিকাঠামো, খনন এবং জ্বালানি প্রকল্পে কাজ করে। ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং গ্রিসের মতো দেশেও তাদের প্রকল্প রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি ভারতের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ।
নথি বিস্তারিত পড়ে আমেনিয়া দেখতে পান, আদানি গ্রুপের প্রস্তাবিত চুক্তি কার্যকর হলে কেনিয়ার লাভ না হলেও কোম্পানির বিনিয়োগের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হত।
তিনি বলেন, "এটি জনগণের সঙ্গে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। প্রেসিডেন্ট, কেনিয়া বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং মন্ত্রী– সবাই জনগণকে ঠকিয়েছেন।"
তবে হাতে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তিনি দোটানায় ছিলেন। নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি থাকলেও ফ্রান্সে থাকার কারণে তিনি তুলনামূলক নিরাপদ ছিলেন। কেনিয়ায় দুর্নীতিবিরোধী কর্মীরা হামলা ও হত্যার শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, "আমি কিছুটা ভয়ে ছিলাম। জানতাম না কী হবে। নিজের পেশা ও জীবন ঝুঁকিতে ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত মনে হলো, চুপ থাকা সম্ভব নয়।"
"শুধু কাপুরুষরাই বেশি দিন বাঁচে," তিনি মন্তব্য করেন।
নথি বিশ্লেষণে কয়েক সপ্তাহ ব্যয় করার পর, জুলাই মাসে তিনি নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (পূর্বের টুইটার) পেজে নথি ফাঁস করেন। এতে কেনিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
জোমো কেনিয়াটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মীরা চুক্তি বাতিলের দাবিতে ধর্মঘট করেন।
নেলসন আমেনিয়া মনে করেন, "দেশের জন্য এটা ছিল আমার দায়িত্ব। দূরে থাকলেও, নিজের দেশকে দুর্নীতি মুক্ত ও উন্নত দেখতে চাই।"
তিনি মনে করেন, বিমানবন্দর চুক্তি ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
আমেনিয়ার অভিযোগ, চুক্তির শর্ত ও স্বচ্ছতার অভাব ছাড়াও কেনিয়ার আইন উপেক্ষা করা হয়েছে। "সরকারি কর্তৃপক্ষ কোম্পানির জন্য যথাযথ যাচাই প্রক্রিয়া মানেনি এবং ক্রয় প্রক্রিয়ার নিয়ম মানা হয়নি।"
তার অভিযোগ, সরকারি কর্মকর্তারা আইনি প্রক্রিয়া ও জনগণের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা এড়াতে চেয়েছিলেন।
কেনিয়া এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের এপ্রিল মাসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, প্রস্তাবিত চুক্তি নিয়ে অংশীজনদের কোনো পরামর্শের পরিকল্পনা নেই।
আমেনিয়া বলেন, "এপ্রিলের সময়ও কোনো জনমত গ্রহণ করা হয়নি, আর জুলাইয়ে আমি যখন এটি ফাঁস করি, তখনো কোনো জনসম্পৃক্ততা ছিল না। পুরো চুক্তি ছিল খুবই গোপন এবং তখন তারা চুক্তি সই করা থেকে মাত্র এক মাস দূরে ছিল।"
তিনি বলেন, চুক্তি ফাঁসের পর তড়িঘড়ি করে জনগণের অংশগ্রহণ দেখানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তা ছিল "ছলচাতুরীর মতো।"
কেনিয়ার সরকারি কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে এবং আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত আরেকটি চুক্তি সই করে।
আদানি গ্রুপ আমেনিয়ার অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও ক্ষতিকর বলে দাবি করেছে। তাদের মতে, প্রস্তাবটি কেনিয়ার নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, একটি বিশ্বমানের বিমানবন্দর গড়া।
তারা জানায়, কোনো বাধ্যতামূলক চুক্তি সই হয়নি এবং তারা সব ধরনের আইন মেনেছে।
নেলসন আমেনিয়া প্রথমে আদানি গ্রুপের সঙ্গে কেনিয়ার প্রস্তাবিত চুক্তি ফাঁস করেন। কিন্তু এই নথি ফাঁস কেনিয়ার সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল না। আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ গৌতম আদানিকে অভিযুক্ত করার পর কেনিয়া সরকার পদক্ষেপ নেয়।
আদানি গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে।
কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো গত মাসে জাতির উদ্দেশে ভাষণে আদানি গ্রুপের দুটি চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, "দুর্নীতির বিরুদ্ধ তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পর আমি কঠোর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করব না।" সংসদে এই বক্তব্য উল্লাসের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়।
কেনিয়াবাসীরা রুটোর এই সিদ্ধান্ত উদযাপন করেন। অনুসন্ধানী সংস্থা এবং সহযোগী দেশগুলোর নতুন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
আমেনিয়া বলেন, "যখন এই ঘোষণা এল, তখন আমি ক্লাসে ছিলাম । বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথম এক ঘণ্টা আমার চোখে পানি ছিল। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।"
তবে তিনি নিজেকে নায়ক হিসেবে দেখেন না। পৃথিবীজুড়ে তার প্রতি সমর্থন জানানো হয়, এমনকি ভারতের কাছ থেকেও।
ক্লাস শেষে, তিনি তার বিখ্যাত "আদিওস (বিদায়) আদানি!!" টুইটটি পোস্ট করেন।
তবে এই বিজয়ের অনুভূতি এসেছিল আমেনিয়ার মাসের পর মাস ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও চাপে থাকার পর।
এয়ারপোর্ট চুক্তি ফাঁস করার পর, আদানি গ্রুপের একজন প্রতিনিধি ও এক কেনিয়ান রাজনীতিবিদ তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। এই পরিস্থিতি তাকে ভাবিয়েছিল, তিনি কি এগিয়ে যাবেন?
তিনি বলেন, "কিছু লোক সরকার থেকে আমার কাছে এসেছিল। তারা আমাকে টাকা দিতে প্রস্তুত ছিল। তারা বলেছিল, 'এখন সময় এসেছে, এই লড়াই বন্ধ করো।'"
আমেনিয়া বলেন "আমি হাল ছেড়ে দিলে সেটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হতো। কেনিয়ার মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতাম।"
তবে চুক্তি বাতিলের পরেও, প্রেসিডেন্ট রুটো কেনিয়াবাসীর বিরোধিতাকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি বলেন, "আপনারা কখনও বিমানবন্দর দেখেননি, শুধু বিরোধিতা করতে চান।"
এখনো মানহানির মামলা মোকাবিলা করছেন আমেনিয়া। তিনি তার আইনি খরচের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছেন এবং বলেছেন, কেনিয়ায় তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, "আমি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং কেনিয়ার মানুষদের থেকে হুমকি পেয়েছি। তারা আমাকে সতর্ক করেছে, যেন আমি দেশে ফিরে না আসি।"
তবে আমেনিয়া বলেন, "আমরা আসলে আমাদের বাঁচানোর জন্য কারও অপেক্ষা করে বসে থাকতে পারি না ।"