কী ঘটতে যাচ্ছে জাবি উপাচার্যের ভাগ্যে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার ছিনতাই থেকে শুরু করে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্যবিদায়ী সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের মধ্যেকার ফোনালাপ-- প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস-পরিস্থিতি।
৯ আগস্ট উপাচার্যের বাসভবনে শাখা ছাত্রলীগকে ‘ঈদ সালামি’ হিসেবে এক কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সে থেকে আন্দোলনের শুরু। ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তোলা কল রেকর্ডে উঠে আসে টাকা দেওয়ার তথাকথিত ‘সত্যতা’।
ছাত্রলীগের তিন অংশের একটি এখন প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন টাকা নেওয়ার কথা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি বিষয়টি অস্বীকার করে চলছেন। প্রশাসন ও উপাচার্যপন্থী শিক্ষক ও শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কল রেকর্ডটি বানোয়াট বলে দাবি করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে গোপন অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রয়োজনে তদন্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সেখানে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা গেছে।
তদন্তে উপাচার্যের দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মঙ্গলবার সাংবাদিকদেরও জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
কল রেকর্ডটি সম্পর্কে সাদ্দাম হোসেন বলছেন,“আগস্ট উপাচার্যের বাসায় অনুষ্ঠিত সভায় আমিসহ চারজন উপস্থিত ছিলাম। আমি তো সব বলেছি কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে। তারপরও সন্দেহ থাকলে টাকা দেওয়ার আগে ও পরের দিন পর্যন্ত উপাচার্যের ছেলে প্রতীক তাজদীক হুসাইনের ফোন কল চেক করলেই সব বেরিয়ে আসবে। সেখানেই দেখা যাবে কে সত্য আর কে মিথ্যা।”
শিডিউল ছিনতাই থেকে শুরু করে সবখানে উপাচার্যের ছেলে ও স্বামী সরাসরি এবং উপাচার্যের ব্যক্তিগত সচিব ছানোয়ার হোসেন ও প্রকল্প পরিচালক নাছির উদ্দিন অন্য সব কিছুতে জড়িত বলে জানান সাদ্দাম।
ওদিকে ছেলে প্রতীকের উপর তাঁর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে জানিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, “আমি জানি আমার ছেলে সম্পর্কে। আমাকে পাশ কাটিয়ে সে টাকা লেনদেন করবে এটা আমি বিশ্বাস করি না।”
তাঁর পরিবারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতেই এসব বলা হচ্ছে অভিযোগ করে উপাচার্য ড. ফারজানা বলেন, “আমি তো তদন্ত করতে বলেছি। তদন্ত হোক, সেখানেই সব প্রমাণ হবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রতীক ছাত্রলীগ নেতাদের পরামর্শ দিয়ে থাকে। সে হয়তো প্রকল্প নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু সেখানে টাকা লেনদেনের কোনো বিষয় ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না।”
এদিকে ‘সভাপতি গ্রুপ অডিও প্রকাশের সঙ্গে জড়িতদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ এমন খবর জানা যায় গত সোমবার। এরপর সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে শাখা ছাত্রলীগের একটি পক্ষ নিজেদের অবস্থান জানান দিতে দিনব্যাপী ক্যাম্পাসে শোডাউন করে।
অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়া ওই কল রেকর্ডটি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হামজা রহমান অন্তরের মুঠোফোন থেকে করা হয়েছিল। অডিও প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান ফোন করে তাকে ‘হুমকি’ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর।
তিনি দাবি করেন, শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেকেই এ টাকার ভাগ পেয়েছেন। যেহেতু ছাত্রলীগ টাকা নিয়েছে, তাই বিষয়টি জানানো দায়িত্ব বলে মনে করেছেন তিনি।
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে অন্তর জানালেন যে, তিনি এখন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকছেন।
তবে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা একে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করতে ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় একটি চক্র এমনটি করছেন। দ্রুতই ছাত্রলীগের হাই কমান্ডের কাছে ওই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করে সুপারিশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান মনে করেন, ফোনালাপটি পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে।
কে সত্য কে মিথ্যা?
এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটি এবং শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও তাঁর সমমনা শিক্ষকরা সেটি অস্বীকার করতে থাকেন।
উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা সংবাদ সম্মেলন করে ‘অধ্যপক ড. ফারজানা ইসলামকে সৎ এবং আন্দোলনকারীদের বক্তব্য অযৌক্তিক’ বলে দাবি করেন। পরে তাঁরা উপাচার্যের পক্ষে মানববন্ধনও করেন।
এদিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আন্দোলন জোরদার হলে ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও, টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।
আবার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই উপাচার্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ‘উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কেন্দ্র্রীয় ছাত্রলীগ চার থেকে ছয় শতাংশ চাঁদা দাবি করেছে এবং চাঁদা না দেওয়ায় খারাপ আচরণ করছে’ বলে অভিযোগ করেন। যার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতৃত্ব রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে সরে যেতে হয়।
তার আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্যবিদায়ী সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে একটি খোলা চিঠি দেন। যেখানে তিনি দাবি করেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নয়, শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন জাবি উপাচার্য।’
রাব্বানীর এ বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হলে উপাচার্য শোভন-রাব্বানীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তাদের বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ দেওয়ার কথা বলেন।
ওই দিনই উপাচার্য জানান যে, শোভন-রাব্বানীর সঙ্গে তার সৌজন্য-সাক্ষাত হয়েছে। টাকার বিষয়ে কথা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগও ‘টাকার লেনদেন হয়নি’ দাবি করে রাব্বানীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ করেন।
এর মধ্যেই ছাত্রলীগের একটি অংশ প্রকাশ্যে টাকা নিয়েছেন বলে ঘোষণা দিচ্ছে।
অভিযোগের তীর উপাচার্যের পরিবারের দিকে
উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের পরিবার বিলাসী জীবনযাপন করেন এমন অভিযোগ শুরু থেকেই রয়েছে। তাঁর জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও তিনি বর্তমানে পরিবারের জন্য অতিরিক্ত দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এসব গাড়ির তেল খরচ বিশ্ববিদ্যালয়কেই বহন করতে হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে ২০১৭ সালে নেত্রকোনায় উপাচার্যের স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে সেই গাড়ি মেরামত বাবদ পরিবহন অফিসকে দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়া নতুন যুক্ত হওয়া দুটি অ্যাম্বুলেন্সে উপাচার্য ছাত্রদের না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ক্যাম্পাস-সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের একটি সবসময় নষ্ট থাকে। ফলে দুটি দিয়ে চাপ সামাল দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। কিন্তু উপাচার্যের বাসায় থাকা দুটি অ্যাম্বুলেন্স সবসময় বসে থাকে, জরুরি প্রয়োজনেও তা পাওয়া যায় না। তবে একটি অ্যাম্বুলেন্স শিক্ষকরা উপাচার্যের অনুমতিক্রমে ব্যবহার করতে পারেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনের মাঠ তাঁর ছেলে প্রতীক হোসেন নিজের দখলে রেখেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ওই মাঠে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতে পারেন না। কিন্তু তাঁর ছেলে ওই মাঠে নিয়মিতই ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে থাকেন বলে জানা গেছে।
সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের স্ত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা ক্লাবের সভাপতি হয়ে থাকেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজে নারী বলে তাঁর স্বামী আখতার হোসেনকে মহিলা ক্লাবের সভাপতি বানানো হয়েছে।
বিষয়টি ‘অস্বস্তিকর’ বলে মনে করেন শিক্ষকরা। তাদের মতে উপ-উপাচার্যের স্ত্রীদের কেউ মহিলা ক্লাবের সভাপতি হতে পারতেন।