৩৬,০০০ কোটি টাকায় কর্ণফুলী পেপার মিলকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা
কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) সর্বশেষ লাভের মুখ দেখেছিল ২০০৮-০৯ অর্থবছরে। ওই বছর ২৪ হাজার ২০০ টন কাগজ উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছিল ৬.৩৮ কোটি টাকা। এর পরের বছরগুলো কেবলই লোকসানের গল্প।
গত দেড় দশকে সেকেলে যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যায়—যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট—কর্ণফুলী পেপার মিলের উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতিও চরম আকার ধারণ করে।
এখন এই কাগজকলটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কারখানাটি সম্পূর্ণ মেরামত এবং ছয়টি নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে।
প্রস্তাবিত নতুন স্থাপনাগুলোর মধ্যে থাকছে একটি সমন্বিত কাগজকল, বন পুনর্বাসন প্রকল্প, একটি কাগজভিত্তিক কেমিক্যাল কারখানা, বিভিন্ন মৌলিক কেমিক্যাল উৎপাদনের কারখানা এবং একটি সিন্থেটিক পলিয়েস্টার ফাইবার প্ল্যান্ট।
কর্ণফুলী পেপার মিলের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশনস) মো. মাহিদুল ইসলাম জানান, কাগজকলটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে এই বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
এছাড়া বিসিআইসি বাশঁ ও পাল্পউড থেকে কাগজ উৎপাদনকারী ফরেস্ট রিপ্রডাকশন ম্যাটেরিয়াল প্ল্যান্ট ফের চালু করতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এই প্ল্যান্টটি গত আট বছর ধরে বন্ধ আছে।
মাহিদুল ইসলাম বলেন, 'এই উদ্যোগ কেপিএমকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবে এবং মুনাফায় নিয়ে আসবে। নতুন প্ল্যান্ট চালু হলে কারখানাটি নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কাঁচামাল রপ্তানিও করতে পারবে।'
১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কাগজকলে এমন এক সময়ে নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে, যখন বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যাওয়ায় গোটা কাগজ শিল্পই সংকটে পড়েছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় স্থানীয় চাহিদা পূরণ এবং রপ্তানি করা অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এখন সংকটে আছে।
নতুন এমডি নিয়োগের পর তৈরি করা হয় পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা
গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর বাঁশ ও পাল্পউড বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শাহীদ উল্লাহকে কর্ণফুলী পেপার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেনারেল ম্যানেজার (কেমিক্যাল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কর্মকর্তারা জানান, শহীদ উল্লাহর নিয়োগের পর শ্রমিক ও কর্মচারীরা নতুন ব্যবস্থাপনার আওতায় কারখানার পুনর্গঠনের দাবি তোলেন এবং আগের প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানান।
শাহীদ উল্লাহ বলেন, 'কেপিএম অনেক পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী কাগজকল। আমি যোগদানের পর দেখি, বেশিরভাগ পুরনো যন্ত্রপাতিই প্রায় অকেজো। কিছু তো মেরামতেরও উপযোগী নেই। পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে বিসিআইসির মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে কেপিএম।'
তিনি আরও বলেন, 'এই প্রস্তাবে কাগজকলের সম্পূর্ণ পুনর্গঠন, ছয়টি নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন এবং সাতটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
'প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া পেলে কারখানাতে বছরে ১ লাখ টন কাগজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।'
কর্মকর্তারা জানান, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের অভাবে এখন কাগজকলটির বার্ষিক উৎপাদন ঠেকেছে মাত্র ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টনে।
বর্তমানে কর্ণফুলী পেপার মিলে ৪১ জন কর্মকর্তা, ৩৯ জন কর্মচারী ও ১৮০ জন শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। অথচ এক দশক আগেও এখানে মোট ৫ হাজার জনবল ছিল।
কারখানার দুরবস্থার কারণে অনেক শ্রমিককে বিসিআইসির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়েছে।
উৎপাদন খরচ কমানো বড় চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতি টন কাগজ উৎপাদনে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা লোকসান গুনছে।
এর কারণ, প্রতি টন কাগজ উৎপাদনের খরচ ১.৪ লাখ টাকা, অথচ বিক্রয় মূল্য ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় বাঁশ ও গাছ সংগ্রহ বন্ধ থাকায় পুরনো কাগজ এবং ব্যয়বহুল আমদানি করা ব্যয়বহুল পাল্পের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।
তারা জানান, শাহীদ উল্লাহর নেতৃত্বে কাগজকলের জন্য বিদেশি পাল্প সংগ্রহে সাত ধাপের একটি দরপত্র প্রক্রিয়া চালু করা হয়। সর্বনিম্ন বিডারের সঙ্গে প্রতি টন পাল্পের দাম ৮৫ হাজার টাকা ধরে চুক্তি করা হয়েছে, যেখানে আগে প্রতি টনের দাম ছিল ১ লাখ ৫ হাজার টাকা।
বর্তমানে কারখানায় কোনো পাল্প মজুত নেই। সাময়িকভাবে চালু রাখতে স্থানীয় ঝুট কাগজ ও খোলাবাজারের পাল্প ব্যবহার করা হয়েছে।
নতুন পুনর্গঠন প্রকল্পের আওতায় কাগজকলটি নিজস্ব কাঁচামাল উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এতে উৎপাদন খরচ কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে নিজস্ব কারখানায় উৎপাদিত এই কাঁচামাল বেসরকারি কাগজকলগুলোর কাছে বিক্রির লক্ষ্যও রয়েছে কেপিএমের।
বছরে লোকসান ৪৫ কোটি টাকা লোকসান
কেপিএমের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বেতন-ভাতা বাবদ কারখানাটি মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ করে।
বেতন-ভাতা, রক্ষণাবেক্ষণ, উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মিলিয়ে বছরে গড়ে ৪৫ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিসিআইসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ বছরে কেপিএম লোকসান দিয়েছে ৪৫৩.৬৮ কোটি টাকা।
র্তমানে বিসিআইসির কাছে কেপিএমের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ আছে।
একসময়ের লাভজনক কাগজকলের পতন
১৯৫৩ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন কর্ণফুলী নদীর তীরে কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় ১.২৭ লাখ একর জমিতে কেপিএম প্রতিষ্ঠা করে। বছরে কারখানাটির ৩০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল।
প্রায় ২৫-৩০ বছর কাগজকলটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়। এ সময় মানসম্পন্ন কাগজ উৎপাদন করে প্রচুর লাভ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কাগজকলের কর্মকর্তারা বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রতিষ্ঠানটি সংকটে পড়ে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কাগজকলটি ব্যাপক লোকসান দেয়।
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ২০১৬ সালে কাগজকলটির কেমিক্যাল প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০১৭ সালের মধ্যে কাগজ উৎপাদনের সবগুলো প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে যায়।
পাল্প সংকট, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে কাগজকলটির কার্যক্রম অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই বন্ধ রাখতে হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলেছে, কেপিএমের যন্ত্রগুলো পুরোনো। বড় সংস্কারের কাজ তিন দশক ধরে হয়নি। ঠিকমতো হয় না রক্ষণাবেক্ষণের কাজও। এ কারণে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম ঘন ঘন ব্যাহত হয়েছে।
কেপিএমের এমন দুরবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকেরা। তারা বলছেন, যন্ত্রগুলো যখন সংস্কারের দরকার ছিল, তখন সে কাজ করা হয়নি। দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়েছে।
সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএমএ কাদের টিবিএসকে বলেন, শুধু পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে কেপিএমের এমন দুরবস্থা হয়নি। দক্ষ জনবলের সংকটের কারণেও প্রতিষ্ঠানটি আজ এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এর পেছনে প্রশাসনের অব্যবস্থাপনাই দায়ী।
আইএমইডির তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে কাগজের চাহিদা ১৫-১৬ লাখ টন। এর মধ্যে ১০-১২ লাখ টন দেশেই উৎপাদিত হয়, বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
সংকটে বেসরকারি কাগজকলগুলো
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা বেসরকারি খাতের অনেক কোম্পানিও এখন সংকটে পড়েছে।
তারা বলেন, ডলার না থাকায় অনেক ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। আর কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান কাগজ, টিস্যু ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে। এই খাতের সঙ্গে ৩০০টিরও বেশি লিঙ্কেজ ব্যবসা জড়িত।
বাংলাদেশ পেপার মিলস এসোসিয়েশনের সদস্য প্রায় ১২৮টি।
অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'পেপার শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ, যা গত ৩০-৪০ বছরেও দেখিনি। পেপার শিল্পের প্রধান কাঁচামাল পাল্পের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত দামেও কাঁচামাল আনতে এলসি খোলা যাচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'এই দুই সমস্যা মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সংকটকে উসকে দিয়েছে। ইউটিলি সেবার দাম বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়ে গেছে। খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের দাম বাড়ানোর কারণে চাহিদা কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে।'