সব মেশিন নষ্ট, ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে বন্ধ রেডিওথেরাপি, ভোগান্তিতে রোগীরা
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৬টি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে দুটি ভালো ছিল। তবে সে দুটি যন্ত্রও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন রেডিওথেরাপি বন্ধ রয়েছে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসার হাসপাতালটিতে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে রোগীরা। কবে নাগাদ এ সমস্যার সমাধান হবে, তা-ও জানাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন এই হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে চারটি গত কয়েক বছরে নষ্ট ঘোষণা করা হয়। এতদিন অবশিষ্ট দুটি মেশিন দিয়ে দৈনিক ২০০ থেকে ২২০ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছিল। যদিও চাহিদা সক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি।
গত ২১ ডিসেম্বর এক রোগীকে থেরাপি দেওয়ার সময় একটি মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। পরদিন নষ্ট হয়ে যায় সচল থাকা বাকি মেশিনটিও। তারপর থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ আছে রেডিওথেরাপি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের রেডিয়েশন অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের একজন টেকনোলজিস্ট দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় দুই-তিন বছর ধরে বিভিন্ন ধাপে আমাদের হাসপাতালের ৪টি রেডিওথেরাপি মেশিন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। দুটি মেশিন দিয়ে থেরাপি দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু এখন সেই দুটিও নষ্ট হয়ে গেছে।'
ইন্সটিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর কবির টিবিএসকে বলেন, মেশিন ঠিক করার জন্য যন্ত্র কেনা হয়েছে যে প্রতিষ্ঠান থেকে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কোম্পানিটি বলছে, মেশিন দ্রুতই ঠিক করে দেবে। কিন্তু কবে চালু করে দিতে পারবে, তা বলতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। মেশিনগুলো স্থানীয়ভাবে মেরামত করার চেষ্টা করলেও সেটি ফলপ্রসূ হয়নি।
তিনি বলেন, রেডিওথেরাপি বন্ধ থাকায় রোগীদের ভীষণ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে মানুষ।
ইন্সটিটিউট সূত্র জানিয়েছে, গতকাল (২ জানুয়ারি) পর্যন্ত মেশিন মেরামতের বিষয়ে কোনো ইতিবাচক খবর আসেনি।
বাড়ছে রোগীদের দুর্ভোগ
দূর-দূরান্ত থেকে দীর্ঘ ভ্রমণ চিকিৎসা নিতে আসেন অনেক রোগী। চিকিৎসার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করেন অনেকে। এখন তারা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত পটুয়াখালীর রোজিনা আক্তার জানান, তিনি পাঁচটি রেডিওথেরাপি নিয়েছেন ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে। ষষ্ঠ রেডিওথেরাপি নিতে হাসপাতালে আসার পর শোনেন, মেশিন নষ্ট।
রোজিনা বলেন, 'ঢাকায় ঘর ভাড়া করার সামর্থ্য নেই, তাই ক্যান্সার হাসপাতালের পাশের খালি জায়গায় অন্যান্য ক্যান্সার রোগীদের সাথে থাকি। অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থেরাপি দেই। কয়েক মাস অপেক্ষার পর থেরাপি ডেট পেয়ে পাঁচটা থেরাপি নিয়েছি। এখন মেশিন নষ্ট, জানি না কবে বাকি ১০টা থেরাপি নিতে পারবো। আমার পক্ষে তো প্রাইভেট হাসপাতালে বেশি টাকা দিয়ে রেডিওথেরাপি নেওয়া সম্ভব না।'
ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করা হয়, যা প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ করতে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লাগে। সাধারণত সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে ২৫টি রেডিওথেরাপি, ব্রেস্ট ক্যান্সারে ১৫টি এবং মস্তিষষ্কের ক্যান্সারের জন্য প্রয়োজন হয় ২৫টি রেডিওথেরাপির।
দেশজুড়ে ক্যান্সার চিকিৎসার সরঞ্জামের ঘাটতি
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় আরও বড় একটি সংকট সামনে নিয়ে এসেছে—দেশজুড়েই রেডিওথেরাপি সরঞ্জামের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, রোগীদের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে ৩০০টি রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন। অথচ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে দেশে মাত্র ৩৭টি মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই আবার নষ্ট।
গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরির (২০২০) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১.৫৬ লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয় এবং ক্যান্সারে বছরে ১.০৮ লাখ মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্যানুসারে, দেশে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী আছে। এই সংখ্যাই বলছে, দেশে রেডিওথেরাপি সুবিধা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
সরঞ্জাম কেনায় ফাস্ট ট্র্যাক নীতি প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা সংকট মোকাবিলায় নীতিগত সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন। গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়ক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ক্যান্সারের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারের গতানুগতিক ক্রয়প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে চলবে না।
'এখনই ফাস্ট ট্র্যাক পলিসি অবলম্বন করে যেসব হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়, একসঙ্গে সেইসব হাসপাতালের জন্য ১৫-২০টি রেডিওথেরাপি মেশিন কেনা প্রয়োজন। বিদ্যমান মেশিনের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগেই নতুন মেশিন কিনতে হবে, আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পরে নয়। এখন ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের যে মেশিনগুলো নষ্ট হয়েছে, সেগুলো ২০০৫-২০০৬ সালে কেনা, আয়ুষ্কাল ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত,' বলেন তিনি।
ডা. রাসকিন আরও বলেন, সরকারি মেশিন কেনার সময় চুক্তিতে আর্জেন্ট সার্ভিস যুক্ত করতে হবে। বেসরকারি খাতে কোনো মেশিন নষ্ট হলে দুই-তিন দিনের মধ্যে ঠিক করে দেয় কোম্পানি; সরকারিতে দুই-তিন মাস সময় নেয়। ফলে রোগীরা জরুরি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়।
ভবিষ্যতের সংকট
তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য আরও বাড়বে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় ক্যান্সারের রোগীরা ইতিমধ্যেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
ডা. রাসকিন বলেন, 'আমাদের রোগীরা একেবারে লাস্ট স্টেজে হাসপাতালে আসে। লাস্ট স্টেজে আসা এত বিপুলসংখ্যক রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধ ও প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের ওপর জোর দিতে হবে।'
এদিকে রেওথেরাপি সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশের স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত দুর্বলতাকে ফের সামনে নিয়ে এসেছে। হাজার হাজার রোগী এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।