‘বাঁচলে রাজনীতি’: ছিন্নভিন্ন আওয়ামী লীগের চিন্তায় নেই পুনর্গঠন ও নির্বাচন
কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীর মাথায়ই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা দল গোছানো নিয়ে কেনো ভাবনা নেই। তাদের চিন্তা এখন একটাই—কোনোমতে টিকে থাকা। 'বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের হামলা' এবং জুলাই অভ্যুত্থানের গণহত্যা, হত্যাসহ বিভিন্ন হামলার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
নজিরবিহীন দুর্নীতি ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীই দলের বর্তমান এই ছিন্নভিন্ন অবস্থার জন্য সরাসরি দুষছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
তৃণমূলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী বর্তমান বিশৃঙ্খলার জন্য অপসারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি দায়ী করছেন।
তারা বলছেন, আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের কারও কাছে এখনও কোনো দিকনির্দেশনা পাঠাননি।
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। দীর্ঘ শাসনামলে নির্বাচনে কারচুপি ও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করে কার্যত একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল আওয়ামী লীগ।
জুলাই-আগস্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভ দমনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে শত শত মানুষ নিহত ও হাজার হাজার আহত হয়। সরকার পতনের পর দেশব্যাপী জনসাধারণ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের তীব্র রোষের মুখে পড়ে দলটি।
হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি), দলের নেতাকর্মী, এমনকি সমর্থকদের বাড়িতেও ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
একসঙ্গে বসার মতো কার্যালয়ও নেই বললেই চলে, প্রায় সবগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিষিদ্ধ করা হয়েছে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ বা দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার দাবিও উঠেছে।
কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কেউই দল পুনর্গঠন বা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা ভাবছেন না।
আত্মগোপনে থাকা দলের একজন সাংগাঠনিক সম্পাদক টিবিএসকে বলেন, 'অভ্যুত্থানের সময়কার হত্যা-গণহত্যার ঘটনায় কত হাজার মামলা হয়েছে, তা এখনও জানা নেই। দলের কেন্দ্রীয় থেকে স্থানীয় সব পর্যায়ের নেতা মামলার আসামি। হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে।
'আবার একদিকে পুলিশের গ্রেপ্তারি তৎপরতা, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত অনেক এলাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, এমন অবস্থায় দলের কোনো নেতাকর্মী প্রকাশ্যে বের হতে পারছেন না। এমনকি কোথাও কোনো কথাও বলতে পারছেন না।'
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া বিভিন্ন অডিও রেকর্ডের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ওইসব রেকর্ডে দল গোছানো বা আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং সবাইকে নিরাপদে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।'
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, সময়ই বলে দেবে দলটির নিবন্ধন বহাল থাকবে কি না এবং তারা আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না।
সম্প্রতি সিলেটে এক সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'সময় আসলে দেখা যাবে কোন কোন দলের নিবন্ধন থাকে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা সময় বলে দেবে।'
দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন, অনেকের অবস্থান এখনও অজানা।
এখন দল কীভাবে চলবে—এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের একজন জেলা সভাপতি টিবিএসকে বলেন, 'বাঁচব নাকি মরব, এর কোনো গ্যারান্টি নাই; আপনি আছেন দল নিয়ে। দোয়া করেন, যেন বেঁচে থাকি—তাহলে বহু কিছু করা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন দল নিয়ে নেই; আছে বাঁচা-মরার লড়াই নিয়ে।'
একজন উপজেলা সভাপতিও প্রায় একই সুরে বলেন, 'বাঁচলে রাজনীতি। বাঁচার সুযোগ দেয় কি না, সেটাই এখন বিষয়।"
দলটির এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা যে, ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বার্ষিকীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেউই যেতে পারেননি।
দলের একজন পুরোনো রাজনীতিবিদ টিবিএসকে বলেন, '১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরও বিরুদ্ধ পরিবেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম আর রাজপথের তৎপরতা এভাবে পুরোপুরি থমকে দাঁড়ায়নি।'
দলটির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, 'আগামী অন্তত ১০ বছরের জন্য আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেওয়া হয়েছে।'
অবশ্য দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সাম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তারা আশা ছাড়ছেন না। আর অতীতের অভিজ্ঞতাই এ আশার কারণ।
'১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেও দেশে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম বহু বছর কেউ মুখে আনতে পারত না। জাতীয় চার নেতাসহ বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। কিন্তু দল পরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এবারও দাঁড়াবে।'
তবে এই আওয়ামী লীগ নেতা কোথায় আছেন, সেটি জানাননি।
আইসিটিতে অজস্র অভিযোগ
গত বছরের ১৪ অগাস্ট আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) করার কথা বলেন। সেদিনই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন জমা পড়ে এবং সেই আবেদন প্রসিকিউশন শাখা গ্রহণও করে।
এরপর ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসনিাকে প্রধান আসামি করে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ৬০-এর বেশি মামলা হয় ট্রাইব্যুনালে। এছাড়াও বিভিন্ন আদালত ও থানায় হয়েছে ২০০-র বেশি মামলা।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের যে উদ্যোগ নেন, সে সময় এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর চূড়ান্ত বিচার শেষে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে থাকা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আওয়ামী লীগের বাহাউদ্দিন নাছিম সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, 'নেত্রী জামায়াতের বিচার করেছেন, এখন সুযোগ বুঝে তার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সময়মতো নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়াবে, সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।'
সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠিয়েছে।
৫ আগস্টের পর হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কয়েকদিন কথা বলেন। তবে তার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দলের সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে।
জয় প্রথমে বিবিসিকে বলেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না।
হামলার মুখে সারা দেশেই পালিয়ে বেড়ানো নেতাকর্মীরা জয়ের এই বক্তব্যে আরও হতাশ হয়ে পড়েন।
পরে অবশ্য জয় বলেন, হাসিনা রাজনীতিতে ফিরতে এবং দলের নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের ঘোষণা দিলেই হাসিনা দেশে ফিরবেন এবং তিনি ভারত যাওয়ার আগে পদত্যাগও করেননি।
তবে জয়ের একেকদিন একেক বক্তব্যে নেতাকর্মীরা আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
এই মুহূর্তে দলের কোনো তৎপরতা নেই কেন—এমন প্রশ্নে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান সাম্প্রতিক বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'নেত্রী আমাদের কোনো দিকনির্দেশনা দিয়ে যাননি, করণীয় কিছু বলেননি।'
দলের দায়িত্ব কে পালন করবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কোনো নির্দেশনা নেই।'