রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
উৎসবের রাত
জাতীয় উৎসবগুলোকে বাদ দিলে আমাদের বাকি উৎসবগুলো মূলত ধর্মীয়। সেসব ধর্মীয় উৎসবের পেছনে ধর্মের ব্যাখ্যা যাই থাকুক অনেকের কাছে সেটার লৌকিকরূপটা ছিল মুখ্য। এক সময় কিছু জিনিস বিবেচনায় আমাদের কাছে দুই ঈদের বাইরে বড় ও বিশেষ গুরুত্ব্বপূর্ণ উৎসব ছিল শবে বরাত। কারণ, শবে বরাতে সারা রাত বাড়ির বাইরে কাটানো যেত, আগরবাতি-মোমবাতি-তারাবাতি-রঙমশাল জ্বালানো যেত, হরেক রকমের পটকা ফুটানো যেত, বাসায় বাসায় বিচিত্র সব খাবার বানানো হতো, এবং কিছু নৈশকালীন অপকর্ম করা যেত।
শবে বরাতের প্রস্তুতি শুরু হতো বেশ কয়েকদিন আগে যখন গম ভাঙানোর কলে চাল ভাঙিয়ে গুঁড়ি বানিয়ে, শুকনো মরিচ হলুদ ধনে আরেক কল থেকে ভেঙে গুঁড়ো করে আনা হতো তখন থেকে। শবে বরাতের আগের রাতে পানিতে ডাল ভেজানো, দুধে কিশমিশ-বাদাম-খোরমা ভেজানো, দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করা ইত্যাদি দিয়ে মূল কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যেত। সকাল হতে আম্মু, সুরবানু খালা আর ছোট খালারা মিলে প্রথমে অনেকগুলো আটার রুটি আর বড় এক হাড়িতে 'আওলান' নামে ফিরনীর মতো দেখতে একটা হালুয়া বানাতেন। এগুলো হচ্ছে সারা দিন ধরে যে ভিখেরীরা আসবেন তাদেরকে দেবার জন্য। আব্বু আগের দিন ব্যাংক থেকে টাকা ভাঙিয়ে ঝকঝকে নতুন কয়েন করে নিয়ে আসতেন। ভিখেরী আসলেই তাকে দুটো রুটি, এক থাবা আওলান আর একটা করে নতুন কয়েন দেয়া হতো। কয়েনের মান দু-তিন বছর পর পর বাড়াতে হতো। সারাদিন পাড়ার সব বাসার গেট খোলা থাকতো। ভিখেরী, প্রতিবেশী বা আত্মীয়-বন্ধু যার যে বাসায় ইচ্ছে ঢুকে পড়তেন।
পাড়ার নিম্ন আয়ের কিছু মানুষ গেটের ভেতরে ঢুকে 'ও খালা!' বলে আম্মুকে ডাকতেন। আম্মু তাঁদেরকে বসিয়ে খেতে দিতেন, যাবার সময় হাতে কিছু টাকা দিতেন। তাঁদের বেশিরভাগ জন অবশ্য বসে খেতে চাইতেন না, খাবারটা বেঁধে নিয়ে যেতেন। আটার রুটি আর আওলান বানানো সারা হলে চালের রুটি, বুটের হালুয়া, সুজির হালুয়া, মাসকাট হালুয়া, বাদামের বরফি, নারকেলের সন্দেশ এসব বানানো হতো। চালের রুটি বানানো একটু কঠিন বলে সেটা কম পরিমাণে বানানো হতো। চালের রুটি দিয়ে খাবারের জন্য কলিজা ভুনা আর গরুর মাংসের ঘন ঝোল করা হতো। শবে বরাতের দিন স্কুল খোলা থাকতো, বন্ধ থাকতো তার পরের দিন। এটা কেন, সেটা বুঝতে আমার অনেক বছর সময় লেগে গিয়েছিল। আমরা অবশ্য শবে বরাতের দিন স্কুলে যেতাম না। স্কুল থেকেও এটা নিয়ে কিছু বলত না।
বিকেল হতে আমরা ভালো জামা-কাপড় পরে ট্রেতে খাবার সাজিয়ে ক্রুশের কাজকরা সাদা রঙের ঢাকা দিয়ে প্রতিবেশীদের বাসায় বাসায় নিয়ে যেতাম। যেসব বাসায় উঠতি ধনী আর উন্নাসিক লোকজন থাকতো সেসব বাসায় যেতে ইচ্ছে করতো না, তবু নিয়ম রক্ষার্থে খাবারের ট্রে নিয়ে যেতাম। প্রতিবেশীদের বাসা থেকেও এভাবে খাবার আসতো। আম্মু প্রতিবেশীদের কারো বাসা থেকে নতুন ধরনের কোন খাবার এসেছে কিনা দেখতেন। অমন কিছু আসলে আম্মু বুঝতে চাইতেন সেটা কী করে বানানো হয়েছে। আমার কাছে অবশ্য আম্মুর বানানো নারকেলের সন্দেশ বা বাদামের বরফির কাছে অন্য বাসার কোন খাবারকে তুলনীয় মনে হতো না। আমার ছোট ভাইয়ের পছন্দ ছিল আম্মুর বানানো বুটের হালুয়া। এক শবে বরাতের বিকেলে ড্রয়িং রুমে একা বসে কী যেন পড়ছিলাম, হঠাৎ ট্রে-প্লেটের টুংটাং শব্দে মুখ তুলে চাইতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আরও অনেক পরে যখন সমুদ্র মন্থনে জল থেকে ঊর্বশীর উঠে আসার বর্ণনা পড়েছিলাম তখন মনে হয়েছে সেদিন বিকেলে আমাদের ড্রয়িং রুমে ট্রে হাতে ঊর্বশী উঠে এসেছিল। বিমুগ্ধ বিমূঢ় কিশোর সেদিন ঊর্বশীকে কিছুই বলতে পারেনি। পরে বন্ধুমহলে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তিনি পাড়ায় নবাগতা এবং আগেই বুকড! তাছাড়া বিজন ভাইয়ের হাতে মার খাবার ইচ্ছে ছিল না।
সন্ধ্যা হতে যারা সারা দিন রোজা ছিলেন তারা ইফতারের আয়োজন করতেন। আমরা সকালে, দুপুরে, বিকেলে খাবার পর ইফতারও খেতাম। মাগরেবের পর থেকে শুরু হতো আমাদের আসল কর্মকাণ্ড। দেশী 'মোহিনী দরবার' আর 'মোহিনী গোলাপ' আগরবাতি, ভারতীয় 'শিব-পার্ব্বতী' ধূপকাঠি, আর মোমবাতি পাড়ার মুদি দোকানে সারা বছরই পাওয়া যেত। আগরবাতিকে যে হিন্দীতে ধূপকাঠি বলে সেটা 'শিব-পার্ব্বতী'র প্যাকেটের গায়ে হিন্দীতে লেখা দেখে জানতে পারি। ভিসিআরে গোটা কয়েক হিন্দী সিনেমা দেখলেও তখনো আমরা হিন্দী জানতাম না। সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপিতে দেয়া দেবনাগরী বর্ণমালা থেকে আমরা আগরবাতির প্যাকেটের গায়ের ঐটুকু লেখা পড়তে পারতাম। শবেবরাতে দুদিন আগে থেকে আগরবাতি-মোমবাতির সাথে যোগ হতো সারস মার্কা তারাবাতি, পটকা, আর বাজি। কাঠি বোমা, ঢিল্লা পটাশ, সলতে বোমা, রঙ মশাল, রকেট বা হাউই, ছুঁচোবাজি বা মরিচাবাজি। একেবারে ছোটদের কাঠি বোমা আর তারাবাতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ঢিল্লা পটাশ ফাটানোর জন্য বোমা সজোরে দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে হতো, সেটা ছোটরা পেরে উঠতো না। সলতে বোমাতে ছোট করে কাটা আগরবাতি লাগিয়ে 'টাইম বোমা' বানানো হতো।
আগরবাতি জ্বলে জ্বলে সলতে ছুঁলেই বোমা ফাটতো। টাইম বোমা বানানো হতো তাদের জন্য যারা সারা বছর আমাদের ওপর নানারূপ অত্যাচার করেছেন। অত্যাচার মানে বাউন্ডারির ভেতরে বল বা শাটল কর্ক পড়ায় সেটা ফেরত না দেয়া, গাছ থেকে ফুল পেড়ে নেয়ায় গালাগালি করা, কারণে-অকারণে বাবামায়ের কাছে নালিশ করা। এগুলো ছিল আমাদের কাছে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। যেসব বাসায় সুন্দরী কিশোরী কন্যা থাকতো সেসব বাসার অভিভাবকেরা খামাখাই পাড়ার ছেলেদের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। অপরাধীদের তালিকায় এরাও থাকতেন। অসীম সাহসী একজন দেয়াল টপকে টাইম বোমা অপরাধীদের বাসার বারান্দায় বা জানালার সানশেডের উপরে রেখে আসতো, আর আমরা সবাই অধীর আগ্রহে ভয় মেশানো চাপা আনন্দ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য লুকিয়ে থাকতাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে প্রতিপক্ষ ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলে মিশন সাকসেসফুল! কখনো কখনো কেউ যে বমাল ধরা পড়েনি এমনটা নয়। সেসব অপমানের গল্প নাইবা করলাম। অন্য অনেক পাড়ায় ডাব, পেঁপে, আম বা মুরগী চুরি করে খাবার গল্প শুনলেও আমাদের পাড়ায় সেসব হতো না। অবশ্য আমাদের পাড়ায় ডাব-পেঁপে-আম গাছ বিশেষ ছিল না। আর যাও ছিল সেগুলোতে চড়ার মতো দক্ষতা কারো ছিল না। মেয়েদের কেউ কেউ একটা পানিভর্তি ছোট গামলায় মোমবাতির গলন্ত ফোঁটা ফেলে ছোট ছোট সাদা, চ্যাপ্টা, গোল দানা বানাতো। পরে সূঁচ গরম করে সেটা দিয়ে দানার মাঝখানে ফুটো করে ছোট মালা বা রাখি গাঁথা হতো।
বোমাবাজি পর্ব শেষ হলে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিত। ছেলেরা মসজিদে যেত, আর কোন কোন বাড়িতে আশেপাশের মেয়েরা একসাথে জড়ো হয়ে নামাজ পড়ত, নামাজের ফাঁকে ফাঁকে খাওয়ার জন্য সাথে নানা রকমের খাবার নিয়ে যেত। নামাজ পড়ায় একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিল একশত রাকাত নফল নামাজ পড়ার। অবশ্য এই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা শুরুতে যতোটা থাকত বিশ রাকাতের পর তাতে ভাঁটা পড়তো। পঞ্চাশ রাকাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আর কোন প্রতিযোগী পাওয়া যেতো না। আমাদের চেয়ে একটু বড়রা এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। এভাবে সারা রাতে অনেকগুলো মসজিদে নামাজ পড়া হতো। আমার জ্যেঠতুতো দাদা বাসা থেকে দূরের বায়তুল মোকাররম বা আরও দূরের তারা মসজিদেও চলে যেতেন। আমাদের দৌড় পাড়া আর তার সীমার ভেতরের পাঁচটা মসজিদে সীমাবদ্ধ ছিল। মেয়েরা কিছুক্ষণ নামাজ পড়ে একটু ব্রেক নিতেন, খাওয়া দাওয়া, চা পান, গল্পগুজব করতেন তারপর আবার নামাজ পড়তেন।
কেউ কেউ কোরআন শরীফ পড়তেন– পাঞ্জ সুরা, সুরা দোখান। শেষ রাতে সবাই গোরস্থান মসজিদে চলে যেতাম। দূর দুরান্ত থেকে লোকজন সেখানে মৃত প্রিয়জনের কবর জিয়ারত করতে আসতেন। গোরস্থানের গেটের বাইরে রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার ভিখেরী বসে থাকতেন। এতো ভিখেরী কোথা থেকে আসত বুঝে পেতাম না। কিছু মানুষ দেখতাম কাগজের ঠোঙায় খুচরো পয়সা এনে এক ধার থেকে তাদের সবাইকে দিতেন। ফজরের নামাজের শেষে গোরস্থান মসজিদের ইমাম সাহেব যাকে আমরা 'ওস্তাদজী' বলে ডাকতাম তিনি লম্বা মোনাজাত ধরতেন। সেই মোনাজাত মাইকেও প্রচার করা হতো যেন বাসায় থাকা মেয়েরা একই সাথে মোনাজাত ধরতে পারেন। মোনাজাতে আমাদের আশেপাশের বয়োজ্যেষ্ঠরা বেশ কান্নাকাটি করতেন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই কান্নার অভিনয় করত। আমাদের লক্ষ্য ছিল মসজিদের মূল দরজার কাছাকাছি থাকা যাতে মোনাজাত শেষে 'নেওয়াজ' বা 'তবরুক' হিসেবে কাগজের ঠোঙায় দেয়া তেহারী মিস্ না হয়। শবে বরাতের পরের কয়েক দিন দেখতাম রেল স্টেশনের প্ল্যাটফরমে কিছু মানুষ পাটি বিছিয়ে রুটি শুকোচ্ছেন। রুটি রোদে শুকিয়ে অনেক দিন ধরে যে খাওয়া যায় সেটা সেখান থেকে জেনেছি।
শবে বরাত মানে আর দিন পনের পরে রমজান। আর রমজান মানে ছয় সপ্তাহের জন্য স্কুল বন্ধ, সারা মাস ধরে আনন্দ, নতুন জামাজুতো কেনার পাঁয়তারা, ঈদের প্রস্তুতি। ধর্মীয়ভাবে খাটো করার সাথে সাথে এখন শবেবরাতের লৌকিকতাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। হয়তো খাটো না করলেও আরও দশটা কারণে লৌকিকতাগুলো 'নাই' হয়ে যেতো। এবারের করোনাক্রান্তি কালে কোনদিন শবে বরাত চলে গেছে তা টেরও পাইনি। যেভাবে আমারজীবন থেকে আনন্দের শবে বরাত নিঃশব্দে হারিয়ে গেছে।