ভেষজ গুণসম্পন্ন বাসকের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু
বরেন্দ্র অঞ্চলে এই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ উদ্ভিদ বাসকের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালিগ্রামে জাহাঙ্গীর আলম শাহ নামে একজন ব্যক্তি তার কৃষি জমিতে বাসক চাষ শুরু করেছেন।
এসিআই, স্কয়ারসহ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছে ভেষজ গুণসম্পন্ন এই গাছের পাতার চাহিদা রয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম শাহ রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক। এর বাইরে তিনি কৃষি বিষয়ক গবেষণা ও বই লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত।
তিনি জানান, গত জুলাই মাসে গাইবান্ধার রফিক নামে এক কৃষকের কাছ থেকে বাসকের চারা কিনে এনে লাগিয়েছেন। সাড়ে সাত বিঘার জমিতে আম গাছের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে মোট সাত হাজার বাসকের চারা লাগিয়েছেন তিনি। প্রতিটি চারা গাছের দাম পড়েছে পাঁচ টাকা। তার সাত বিঘায় বারি-৪, আম্রপালি ও খিরসাপাতসহ আমের গাছ রয়েছে ৪০০টি।
বাসক চাষের উপযোগী করার জন্য জমির বড় আম গাছ কেটে ফেলে নতুন আম গাছ ও বাসকের চারা একসঙ্গে লাগিয়েছেন তিনি। আম গাছ বড় হয়, কিন্ত বাসক তেমন বড় হয় না; তাই একসঙ্গে দুই ধরনের গাছ লাগানোতে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই।
বাসক গাছ লাগানোর পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, তিনি রাজশাহীতে থাকেন। গ্রামে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করেন। যেহেতু বাসক গাছ গরু-ছাগলে খায় না, আবার পরিবেশবান্ধব, দেখভাল করতে সুবিধা, তাই এ গাছ লাগানো হয়েছে। তবে বাসক গাছ উঁচু জমিতে লাগাতে হয়। জমিতে পানি জমে থাকলে চারা মরে যায়। এজন্য বরেন্দ্র অঞ্চলে বাসকের চাষাবাদ সহজ।
বাসকের বাণিজ্যিক মূল্যের বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম শাহ জানান, এ গাছের পাতা শুকিয়ে বিক্রি করা যায়। যেসব কোম্পানি ভেষজ গুণসম্পন্ন ওষুধ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে, তাদের কাছে বাসক গাছের বেশ চাহিদা। এসিআই, স্কয়ারসহ বিভিন্ন বড় কোম্পানিও বাসকের পাতা কিনে নেয়।
একটি গাছ থেকে বছরে তিনবার পাতা তোলা যায়। শুকানোর পর একটি গাছ থেকে এক কেজি পাতা পাওয়া যায়। এক কেজি শুকনো পাতার মূল্য ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। সে হিসেবে সাত হাজার গাছ থেকে বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
একবার চারা গাছ লাগানো হলে বহু বছর পর্যন্ত সেই গাছ থেকে পাতা পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।
কোনো রকম রাসায়নিক ছাড়াই সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন জাহাঙ্গীর আলম শাহ। একজন সহকারী তার এই আম বাগান ও ফসল দেখাশোনা করেন।
জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, 'জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার ফলে কীভাবে পোকা দমন করা যায়, সেটা দেখাও বাসক চাষের আরেক লক্ষ্য। যেহেতু আমি কৃষি বিষয়ক বইপত্র লেখি, কৃষি নিয়ে গবেষণা করি, বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি কৃষি বিষয়ক গবেষণাও আমার একটি উদ্দেশ্য। জৈব পদ্ধতিতে পোকা দমন করার উদ্দেশ্যেও বাসক চাষ করছি।'
রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এটাই প্রথম বাসকের বাণিজ্যিক চাষ। তবে বাসাবাড়িতে কিংবা বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে অল্প গাছ লাগান হয়।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল হক জানান, অল্প খরচে বাসক গাছ চাষ করা যায়। লাভজনক। ফলে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করলে ভালো লাভ করা সম্ভব। আর আম গাছের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে উপযুক্ত।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বাসক পাতাকে নানা রোগ সারাতে ব্যবহার করা হয়। কাশি, কফ বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় বাসক পাতার ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে দেশে। বাসকের বৈজ্ঞানিক নাম 'Adhatoda vasica'। লোকালয়ের কাছেই আর্দ্র ও সমতলভূমিতে এটি বেশি জন্মায়।
বাসক অর্থ সুগন্ধকারক। গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়ির আনাচে-কানাচে কিংবা ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠে এই বাসক। বাসকের পাতায় 'ভাসিসিন' নামে ক্ষারীয় পদার্থ ও তেল থাকে। শ্বাসনালীর লালাগ্রন্থিকে সক্রিয় করে বলে বাসক শ্লেষ্মানাশক হিসেবে প্রসিদ্ধ। এ পাতার নির্যাস, রস বা সিরাপ শ্লেষ্মা ও সর্দি কাটে, কাশি এবং শ্বাসনালীর প্রদাহমূলক ব্যাধিতেও বিশেষ উপকারী, সরকারি কৃষি বাতায়ন থেকে জানা যায় এইসব তথ্য।
এর বাইরেও বাসক বহু যুগ ধরে গ্রামীণ চিকিৎসায় পানি জীবাণুমুক্ত করতে, হাত-পা ফুলে গেলে, চামড়ার রঙ উজ্জ্বল করতে ব্যবহার হয়।
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি হারবাল ওষুধ তৈরিতে বাসক ব্যবহার করছে। এটি পরিচিত ভেষজ ওষুধ।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারাদেশেই বিভিন্ন জেলায় রাস্তার পাশে বা বাড়ির চারপাশে বাসক গাছ লাগানো হচ্ছে। বাসক পাতা চাষে কোনো আলাদা যত্নের প্রয়োজন নেই। লাগে না সার বা বিষ। গবাদি পশুও বাসক পাতা খায় না। যে কারণে গ্রামের দরিদ্র নারীরা প্রতিদিনই সংগ্রহ করছেন শত শত বাসক পাতা। পরিচ্ছন্নভাবে রোদে শুকিয়ে তা বিক্রি করছেন ওষুধ কোম্পানির কাছে। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
এছাড়া, একবার বাসক চারা রোপণের পর, নতুন চারা পেতে ১-২টি গিটযুক্ত কাটিং পুরনো গাছ থেকে কেটে নিয়ে গর্তে রোপন করলেই চারা গজায়। গর্তে পর্যাপ্ত গোবর সার দিতে হবে এবং ছয় মাস থেকে পাতা সংগ্রহ করা যায়।