পুরুষ কে?
সমাজে পুরুষত্বের নির্মাণ ও পিতৃতন্ত্র
দু'দিন আগেই গেল 'বিশ্ব পুরুষ দিবস'। পুরুষ কে? প্রতিদিন উপাসনার সময় 'পুরুষ' হিসেবে সৃষ্টির জন্য ইহুদি পুরুষেরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান। এটাই প্রমাণ করে সমাজে পুরুষের বিশেষ গৌরবজনক বা সুবিধাভোগী অবস্থান। ঐ যে সংস্কৃত শ্লোকে 'পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতা হি পরমন্তপ:' বলে আওড়ানো হয়, রোমক আইনে পরিবারের প্রধান যে 'প্যাট্রিয়া পটেস্টা'- পুরুষ বুঝি পরিবার-রাষ্ট্র-সমাজের সেই বৃহত্তম ক্ষমতার প্রতিভূ?
ফ্রয়েড তো মনেই করতেন যে পুরুষের মতো দেহের অধিকারী নয় বলেই বাড়ির বালিকা বা কন্যা শিশুর হিংসা শুরু হয় তার ভাই বা বাবার প্রতি। এই 'পেনিস এনভি'কে সে ভুলে থাকতে চায় পুতুলপ্রিয়তা দিয়ে। পুরুষ না হতে পারার হীনম্মন্যতা সে পোষাতে চায় 'মা' হয়ে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানের মূল কাঠামোই আজ অবধি ফ্রয়েডের এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে। বাস্তবেই কি পৃথিবীর প্রতিটি নারীই 'পেনিস এনভি' বোধে ভুগে কাতর? পিতা মানেই কি স্বর্গ? যে পিতা কোনো কুমারী নারীর বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেন, অনাগত সন্তানের দায় না নিয়ে পালান বা যে পিতা স্ত্রী-পরিবার রেখে অন্য নারীর সাথে ঘর বাঁধেন, তিনিও কি পরম তপস্যার আধেয়?
আবার, সব পিতাই মন্দ- এমনও নয়। আজীবন সংসারে ছেলে-মেয়ের জন্য কঠোর শ্রম ও উপার্জনের দায় যুগিয়ে শেষ জীবনে পিতা যখন দুর্বল বা অবসরপ্রাপ্ত, তখন ব্যস্ত ছেলে-মেয়েদের মা'র সাথে যদি বা দু'দণ্ড কথা বলার অবকাশ হয়, বাবা যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির রীতি-নীতি মান্য করে ছেলে-মেয়ের সাথে কখনোই অত ঘনিষ্ঠ হননি বা দূরত্ব রেখে চলেছেন, শেষ জীবনে তাঁর সাথে কথা বলারও ফুরসত পায় না সন্তান-সন্ততি।
তবে কি পিতা বা পুরুষ মানেই নিপীড়ক? সদ্যই সংবাদমাধ্যমে হাসপাতালের শবাগারে এক ডোম যুবক মৃত নারীদেহ ধর্ষণ করে বলে খবর এসেছে। প্রতিদিনই অসংখ্য মেয়ে ও ছেলে শিশু ধর্ষণ বা গণধর্ষণ থেকে নানা ধরনের নিপীড়নের খবর আমরা পড়ি। আবার ফরাসি বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব, ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের প্রথম কাতারে অসংখ্য পুরুষ আত্মদান করেছেন দেশমাতৃকা বা বড় কোনো আদর্শের জন্য।
পুরুষ তবে কে বা কেমন? 'জেমস বন্ড' বা 'টারজান' থেকে মুম্বাই বা ঢাকাই ছবির একাই একশো নায়ক যে কি না খালি হাতে তিনশো সশন্ত্র গুন্ডার হাত থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে, রূপকথার 'ঘুমন্ত রাজকন্যা'কে সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি ছুঁইয়ে জাগায় নাকি সে পুরাণের রাবণ যে সীতাকে হরণ করে? সে কি নায়ক না খলনায়ক? পিশাচ অথবা ত্রাতা?
সমাজে 'জেন্ডার' ভাবনার গঠন ইতিহাসের নানা প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশে বা সমাজে বিভিন্নভাবে হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, 'ম্যাসক্যুলিনিটি' বা 'পৌরুষে'র ভাবনা সব সমাজে কিন্তু একরকম নয়। যেসব সমাজে নারী ও পুরুষকে মেরু দূরত্বের মানুষ মনে করা হয় না, তেমন সমাজে কিন্তু পুরুষের 'ম্যাসক্যুলিনিটি'র যে প্রথাগত রূপ সচরাচর আমরা দেখে থাকি, তেমন রূপ সেসব সমাজে দেখা যায় না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের বাংলাদেশেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো সমাজে গেলে দেখতে পাবেন, সেখানে ম্রো তরুণেরা বরং যৌবনে চুলে ফুল গোঁজে, চোখে ও ঠোঁটে হাল্কা প্রসাধন ব্যবহার করে এবং বহিরাগত নারীদের দেখলে লাজকু হাসে। অথচ ম্রো নারীরা একদমই প্রসাধন করে না এবং অনেকসময়ই তাদের দেহের উপরিভাগ অনাবৃত থাকে। অথবা, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-সিলেটের গারো-খাসিয়া সমাজে আজো মাতৃসূত্রী সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত এবং সন্তান সেখানে মায়ের বংশনাম বা পদবী ধারণ করে।
আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে অবশ্য পৌরুষের এক অজেয়, কঠোর ভাবমূর্তি রয়েছে। সে হলিউড-বলিউডের 'অ্যাভাটার,' 'সিং ইজ কিং' বা ব্রুস লির 'এন্টার দ্য ড্রাগনে'র কুশলী, মারমুখী যোদ্ধা।
আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে 'পৌরুষ' মানেই যেন নারীত্বকে পরিহার, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ, জীবনে সব অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতা অর্জনের দৌড় বোঝাচ্ছে। পুরুষ যেন সবসময়ই নারীর বিপরীত কিছু একটা। নারী দূর্বল হলে পুরুষ সবল, নারী ভীরু হলে সে সাহসী, নারী আবেগপ্রবণ হলে সে যুক্তিপরায়ণ ইত্যাদি।
আসুন, সমাজে 'পুরুষত্ব (ম্যাসক্যুলিনিটি)' বা 'পিতৃতন্ত্রে'র বিকাশের পেছনের কিছু ঐতিহাসিক-নৃ-তাত্ত্বিক-প্রত্নতাত্ত্বিক কারণ খুঁজে দেখা যাক।
পিতৃতন্ত্রের উন্মেষ
মানব সভ্যতার একদম শুরুতে এক-একটি সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠিতে কারোরই কোনো একাধিপত্য বা নেতৃত্ব বলে কিছু ছিল না। সবাই মিলে খাবার, পরবর্তী প্রজন্মের জন্মদান ও লালন-পালন ও পশু বা অন্য কোনো গোষ্ঠির হাত থেকে আত্মরক্ষার কথাই ভাবতেন। তবে সেই আদিম সমাজেও 'পুরুষত্বে'র ধারণার বিকাশ ঘটল যখন কি না সেই সমাজেও দেখা দিল শ্রম বিভাজন।
শিকারি-সংগ্রাহক সেই সমাজে পুরুষ করত শিকার বা পশু শিকারের মাধ্যমে মাংস যোগাড়ের কাজ আর নারী করত ফল কুড়ানোর কাজ বা সংগ্রাহকের কাজ। এই শ্রম বিভাজনের আগেই অবশ্য আদিম মানব খেয়াল করেছে যে পৃথিবীতে নতুন মানবশিশু আনার কাজটি মেয়েরা করতে পারে এবং ছেলেরা পারে না। প্রসবের সময় লম্বা অক্রিয়তার দরুণই পুরুষকে আরও বেশি বেশি যেতে হয়েছে শিকারে। গোষ্ঠিতে খাবার যোগানোর মূল কাজ করতে গিয়ে আপনিই তার হাতে চলে এসেছে ক্ষমতা। ধীরে ধীরে সূচিত হলো নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য স্থাপণ ও শোষণের প্রক্রিয়া।
নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, লিপি বা লিখন কৌশল এবং পিতৃতন্ত্রের উন্মেষের আগে পৃথিবীতে 'রাষ্ট্র' বলে কিছু ছিল না। নৃ-তাত্ত্বিকেরা আরও জানান, পৃথিবীতে মানব প্রজাতি বা 'হোমো স্যাপিয়েন্সে'র শুরু যদি-বা হয়েছে দুই লক্ষ বছর আগে, সে হিসেবে রাষ্ট্রের শুরু হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগে।
নিওলিথিক বিপ্লব
রাষ্ট্র ব্যবস্থার পত্তনের আগে মানব সভ্যতার অন্যতম সন্ধিক্ষণ ছিল কৃষির সূচনা। মূলত: ভাষার সৃষ্টির সময় থেকেই সমাজে মানুষকে 'নারী' বা 'পুরুষ' এমন ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় চিহ্নিত করা শুরু হয়েছিল। কৃষির শুরুর আগে মূলত: পশুচারণভিত্তিক যাযাবর সমাজেই মানুষ প্রথমে নারীর সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা ও পুরুষের এ বিষয়ক অক্ষমতা বুঝতে পারে।
সন্তান জন্মদানের সেই শুভক্ষণ ছিল অনেক উদযাপনের উপলক্ষ্যও বটে। আঁতুড়ঘরে নতুন মা ও শিশুর যত্নে নিরত নারীদের মাঝে এক ধরনের 'ভগিনী সুলভ' বন্ধুত্বও গড়ে উঠত। পুরুষ যখন শিকারে বেড়িয়ে পড়ত, শিশুর যত্নে নিরত মেয়েরাই লক্ষ্য করেছে কীভাবে একটি ফলের বীজ থেকে গজিয়ে উঠেছে নতুন চারা, দেখা দিয়েছে নতুন কিশলয়। প্রকৃতির এই ফসলচক্র বুঝতে শেখার পর মানুষ গড়তে সক্ষম হয়েছে নতুন যত গ্রাম ও শহর, থিতু হতে পেরেছে পরিযায়ী মানুষ, গড়েছে সভ্যতা।
প্রত্নতাত্ত্বিক নানা ধ্বংসস্তুপ লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব যে, একদম শুরুর মানব গ্রামগুলোয় কোনো দেয়াল থাকত না। নিছক কঠিন আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং বীজ ও ফসল রক্ষার কাজেই দেয়ালহীন ঐ গ্রামগুলো গড়ে উঠেছিল।
কৃষিকাজ শেখার ফলেই মানুষ প্রথম উদ্বৃত্ত সম্পদ কী জিনিস তা বুঝতে পারে। শুরুতে এই বীজ ও শস্য সংরক্ষণ ও সঞ্চয়ের দায় নারীর কাঁধেই ছিল। কৃষির পাশাপাশি পশুপালনও শিখল মানুষ আর সেটাই সুগম করে পিতৃতন্ত্রের পথ। পুরুষ দেখতে পায়, মানবেতর প্রাণীদেহে নানা কৌশল অবলম্বন করলে পশুদেহে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এভাবেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পিতৃত্বের ধারণা পুরুষের কাছে প্রতিভাত হয়। প্রাণীদেহে যৌনতা, গর্ভধারণ ও প্রসবের বিষয়গুলো লক্ষ্য করে একইভাবে মানবীদেহেও সেই নিয়ন্ত্রণ অর্জনের চেষ্টা করে পুরুষ। একটি অশ্বিনী বা গাভিকে নিয়ন্ত্রিত করার মতোই মানবীকেও নিয়ন্ত্রণের কৌশল শিখে নেয় পুরুষ আর এভাবেই প্রথম পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠির সূচনা।
পিতৃতান্ত্রিক সহিংসতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ
যেহেতু মূলত: পুরুষেরাই দলবদ্ধভাবে শিকারে যেত এবং শিকারে অনেক সময় কোনো না কোনো পুরুষ আহত বা নিহত হতো, গোষ্ঠির জন্য পুরুষের এই ঝুঁকি গ্রহণকে মহিমান্বিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি দলবদ্ধ লড়াইয়ে শিকারি পুরুষ যখন বন্য পশুর ওপর জয়ী হতো, তখন শিকারি পুরুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ, আদি রণকৌশল প্রণয়ন করা ও সমাজে নানা আধিপত্য কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।
খাদ্যের সংগ্রহ যত বাড়ে, ততই গ্রামগুলোয় দেয়াল তোলার প্রচেষ্টা দেখা দেয়। বিরোধী গোষ্ঠির হাত থেকে নিজ গোষ্ঠির সঞ্চয় বাঁচাতে দেয়াল তোলাই পুঁজিবাদের ভেতরের প্রথম 'দখলদারিত্ব' বা 'সম্পত্তিরক্ষার মনোভাব' হিসেবে হালে নৃ-তাত্ত্বিকেরা মনে করেন। পাশাপাশি বন্য পশু ও বিরোধী গোষ্ঠির সাথে লড়াইয়ে জেতার জন্য সামরিক কৌশলের নতুন নতুন সব সৃষ্টিও চলতে থাকে।
তবে নারী কি না নতুন মানবশিশু পৃথিবীতে আনে, তাই যুধ্যমান সব মানবগোষ্ঠিতেই তাকে সম্পদ হিসেবে দেখা হয়। তাকে নিয়ে কাড়াকাড়িও চলে। এক গোষ্ঠির পুরুষ আর এক গোষ্ঠির সাথে যুদ্ধ করে বা হামলা করে মাঝেমাঝেই তাদের মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। এভাবেই নিওলিথিক বিপ্লব নাগাদ সমাজে নতুন 'জেন্ডার ভূমিকা' দেখা দেয় যেখানে পুরুষ মূলত: সন্ত্রাসী- শিকারি বা লুটকারী, আর নারী তার অতীতের বীজ সংরক্ষণ বা শিশু পালনের জন্য সমাজের সম্মানের কেন্দ্রবিন্দুর জায়গা থেকে সরে গিয়ে হয়ে ওঠে 'বস্তু' বা 'ভোগ্য।'
আর যবে থেকে 'সম্পদ' ও 'সন্তানে'র 'মালিক' ও 'পিতা' হবার বাসনা দেখা দিল পুরুষের ভেতর, এক পুরুষের প্রতি অপর পুরুষের ভয়ানক যৌন হিংসা ও ঘৃণাও চূড়ান্ত রূপে দেখা দিল। সঙ্গীনীর সন্তানটি তারই সন্তান কি না, এই সন্দেহে মরো মরো পুরুষের সাহিত্য তাই ইতালির ডেকামেরন থেকে আরব্য রজনী, পঞ্চতন্ত্র বা জাতকে সবখানেই নারীর অবিশ্বস্ততার কথনে ভরপুর। প্রতীচ্যে যদিবা রাজা মেনিলাস প্রেমিক প্যরিসের সাথে স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগী স্ত্রী হেলেনকে ফিরিয়ে নেন, ভারতে নিরপরাধ সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার পরেও বিশ্বাস করেন না রাম ও বনবাসে পাঠান।
প্রাচ্যে নারীর সতীত্ব একেবারেই 'পদ্মপাতায় জল/ করিছে টলোমল' হাল! শেক্সপীয়রের 'ওথেলো'ও ভুল সন্দেহে গলা টিপে হত্যা করে ডেসডিমোনাকে যে কি না তার জন্য সব ছেড়েছিল।
মূলত: অনাগত সন্তানের পিতৃত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হবার কাতরতা থেকেই পুরুষ তার সঙ্গীনী যেন অন্য কারও সাথে কথা না বলে, না মেশে এমন অস্থির নানা মনোবিকলনে ভোগে। সঙ্গীনীর চলাচল বা কাজের স্বাধীনতাও সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এভাবেই সন্তানের মা হিসেবে যোদ্ধা-পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সঙ্গীনী নারীটি। তাদের দাম্পত্যের ভিত্তি হলো পুরুষকে প্রদেয় নারীর দাম্পত্য সেবা ও সন্তান। বদলে মেয়েটি পাবে সামাজিক নিরাপত্তা। এভাবেই পুরুষের নিয়ন্ত্রণে একগামী বা বহুগামী বিবাহ ব্যবস্থার সূচনা হয়।
সময় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যেসব জনগোষ্ঠির সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, তারা অন্য নানা ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং জয় করে যুদ্ধে অপটু জাতিগুলোর নারীদেরও। ট্রয়-গ্রিস যুদ্ধে এটা যেমন দেখা গেছে, দেখা গেছে রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর বিজয়ী শ্বেতকায়দের ক্ষেত্রে। হস্তীবাহিনী নির্ভর ভারতীয় সেনাবাহিনী বারবার হেরেছে অশ্ববহুল মধ্যপ্রাচ্যের দ্রুতগতি সামরিক কৌশলের কাছে। আত্মরক্ষায় অক্ষম ভারতীয় যোদ্ধারা অনেক সময়ই নিজ নারীদের তখন ঠেলে দিয়েছেন 'জহরব্রত' বা গণ আত্ম-আহুতিতে।
ভাবাদর্শিক যুদ্ধ
আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে প্রাপ্ত 'দ্য ভেনাস অফ উইলেনডফ' নামের যে দেবীবিগ্রহের ছবি দেখা যায়, সেই দেবী-মাতৃকার রূপ-কল্পনা গোটা ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়ানো। পিতৃতন্ত্রের সূচনার আগে নারীকেই দেখা হতো নতুন শিশু পৃথিবীতে আনার ক্ষমতাসম্পন্ন তথা জীবন ও মৃত্যু, ফসল তোলা, যুদ্ধ, পৃথিবী, আকাশ, অগ্নি বা জলের উপাদানসম্পন্না হিসেবে। এছাড়াও চাঁদের কলা, বছরে অয়নান্ত ও বিষুবরেখার পথ ধরে পৃথিবীর পরিক্রমণের সময়সহ প্রকৃতি ও কৃষির সাথে সংযুক্ত নানা আচার-আচরণকেও মেয়েলি নানা উপকথা বা ব্রতের সাথে যুক্ত করা হতো। ভারতে নারী তার প্রজনন শক্তির কারণেই 'আদ্যা শক্তি' হিসেবে বিবেচিত।
যতদিন সমাজে নারীর এই মাতৃকা সম্মান ছিল, ততদিন তাঁকে 'পূজার যোগ্য' হিসেবে মনে করা হয়েছে। কিন্ত গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে যখন সংঘাত বেড়েছে, বহিরাগত যোদ্ধাদের কাছে নারী হয়ে উঠেছে 'লুটের মাল'। এছাড়াও গত এক সহস্রাব্দ ধরে মানুষের যৌনতা ক্রমাগতই প্রাণি ভুবনের অন্যদের যৌনতার থেকে পৃথক হয়ে উঠেছে। মানুষ যৌনতার সাথে পাপ-পূণ্য, নীতিবোধ, লজ্জাসহ নানা কিছুকে জড়িত করেছে- যা অন্যরা করেনি।
একদিকে পৃথিবীর সব সম্প্রদায়ই যৌনতাকে কম-বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় আর অন্যদিকে বিজ্ঞাপন শাসিত আজকের পুঁজিবাদে যৌনতার লাগামছাড়া উপস্থাপনা দেখা যায় যা নারী-পুরুষের প্রশ্নকে আরও জটিল করে তোলে।
দৈবীশক্তির পুরুষায়ণ
কৃষি ও পশুপালনের ফলে মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানবগোষ্ঠিগুলোর ভেতর যুদ্ধ-সংঘাত বাড়ে। আর তখনই দেবী-মাতৃকাদের বদলে দেখা দেন যোদ্ধা পুরুষ দেবতারা। গ্রিক পুরাণের অ্যাপোলো যেমন বা ভারতের সংহার দেবতা শিব যিনি প্রলয়ের নৃত্য নাচেন। এই যোদ্ধা দেবতারা, রক্ত ও আগুনে পরিবৃত হয়ে (নর্স পুরাণের 'থর' বা জিউস কি ইন্দ্র এরা সবাই বজ্রধারী) গোষ্ঠির আত্ম-রক্ষার নামে প্রচণ্ড যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিপক্ষের জনগোষ্ঠির আমূল ধ্বংস সাধিত হয়। পুড়ে যায় ট্রয় বা সিংহল দেশ।
দেবী-মাতৃকাদের পালিকা রূপের বদলে পুরুষ দেবতারা সবাই যোদ্ধা। পুরুষের এই সমরপ্রিয়তা বিকাশ ঘটায় ধাতু শিল্পেরও। দেখা দেয় যুদ্ধে জয়ী ও বিজিত, দাস ও দাসমালিক শ্রেণির। এক পক্ষের যোদ্ধারা অন্য পক্ষের যোদ্ধাদের হারালে প্রমাণিত হতো যে বিজয়ীদের দেবতা বিজিতদের দেবতাদের চেয়ে শ্রেয়তর।
বিজয়ীদের এই অহমবোধই কালক্রমে জন্ম দেবে জাতীয়তাবাদের। পরাজিত জাতিসত্ত্বার প্রতি এই আধিপত্য ও সন্ত্রাস দু'ভাবে দেখা দিত। প্রথমত: পরাজিত শত্রুদের দাস হিসেবে নেওয়া ও দ্বিতীয়ত: পরাজিতদের ওপর তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কর বা খাজনা চাপানো।
এভাবেই যুদ্ধের ফলে দেখা দেওয়া সামাজিক নানা আধিপত্য বা স্তর-বিন্যাসই আজকের রাষ্ট্র-কাঠামোকে সম্ভবপর করে তুলেছে। যোদ্ধা পুরুষ দেবতারা নারী দেবতাদের পরিসর সঙ্কুচিত করেছেন। বিজিতদের বিশ্বাস ও দেবতা আত্মীকৃত হয়েছে বা বিলুপ্ত হয়েছে বিজয়ীদের প্রবাহে। হোরাস, মারদুক, তেশুব, জিউস বা জুপিটারের মতো পুরুষ দেবতারা প্রধান হলেন আর নারী দেবতারা হারিয়ে যেতে থাকলেন। এদিকে অন্ত্য প্রাচীন বা মধ্যযুগের অভিজাতেরা যতই নানা দেব-দেবীর বিচিত্র উপাসনায় সময় দিয়েছে, সমাজের দরিদ্র বা দাস শ্রেণি কিন্তু একেশ্বরবাদে বড় আশ্রয় ও প্রতিরোধ খুঁজে পেয়েছে। এক ও অদ্বিতীয় কোনো স্রষ্টা যিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বত্র বিরাজমান, তিনি সব মানুষকে এক চোখে দেখেন।
পুরুষের রাজনৈতিক সত্ত্বা
রাজনীতি যেহেতু রক্তহীন যুদ্ধ, সেহেতু নগর ও বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে সমাজে রাজনীতির গুরুত্বও বাড়ে। ক্রিতদাস নয় এমন স্বাধীন পুরুষেরা শুধু রণক্ষেত্র নয়, বাজার বা চত্বর, প্রশাসনিক ও সরকারি নানা কেন্দ্রে রাজনীতিতে ব্যাপৃত হলেন। গ্রিসের মন্দিরগুলোয় বহুদিনের নারী পুরোহিতদের সরিয়ে পুরুষদের নিয়োগ দেওয়া হলো। মেয়েদের ঠেলে দেওয়া হলো ঘরে। তাদের মূল কাজ প্রজনন ও গৃহশ্রম। তবে কিছু নারী অবশ্য বাবা, স্বামী বা পুত্রের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অংশ নিয়েছেন।
কালক্রমে নারীর ওপর আধিপত্য কায়েমের জন্যই বিয়ের সূচনা হয়। হাম্মুরাব্বির আইনে বা পৃথিবীর প্রথম আইনে বিয়েকে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে বরটি মেয়েটির প্রাক্তন মালিক বাবার কাছ থেকে একটি নিদিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাকে কিনে নেয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম এই বিধি সংহিতার ২৮২টি আইন থেকে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা তথা পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্রের পিতৃতান্ত্রিক চেহারাটি বোঝা যায়।
গ্রিসে স্বয়ং অ্যারিস্টটল নারীর প্রতি পুরুষের শোষণকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর রচিত 'বায়োলজি'তে নারীকে তিনি ফ্রয়েডের মতোই 'অপূরিত মানব' হিসেবে চিহ্নিত করেন। নারীর আত্মা স্বাধীন পুরুষের আত্মার মতো নয়, বরং পশু ও ক্রিতদাসের আত্মার মতো। ভারতে মনুর চোখে শুদ্র ও নারীর অবস্থান যেমন সমান ছিল- দু'টোই পশুতুল্য। এসব মতবাদই শেখানো হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
তবে গ্রিস হোক আর ভারত হোক, প্রাচীন রোমের যুদ্ধ দেবতা মার্সের যে সৈন্য-কৃষক চেহারাটি দেখা যায়, সেটাই যেন আজকের যুগেও 'ম্যাসক্যুলিনিটি'র গৌরবোজ্জ্বল চেহারা প্রতিষ্ঠা করেই চলেছে। রোমক এই সৈনিক-কৃষক পুরুষ দেশের জন্য দূর ভূখণ্ডে গিয়ে যুদ্ধ করে এবং জয়ী হয়ে দেশে ফিরে কৃষি কাজ করার কথা ভাবে- এটাই হলো 'প্যাক্স রোমানা'। রাষ্ট্রের প্রতি পুরুষের এই অবিচল দায়িত্ববোধ ও দাসত্বই বিশ শতকের ইতালিতে ফ্যাসিবাদের বিকাশে ভূমিকা রাখবে। রোমক সাম্রাজ্য যারা কি না তিন শতক ধরে সব উপনিবেশের সম্পদ আত্মীকৃত করেছে এবং 'সকল পথই রোমে যায়' নীতির সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে, নারীকে একদম অদৃশ্য করে তুলতে পেরেছিল জনপরিসর থেকে।
ঔপনিবেশিকতাবাদ ও শিল্প বিপ্লব
পনের শতকে রেনেসাঁর পর থেকে বিজ্ঞান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসন নেয়। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় পা রাখা থেকে শ্বেতকায় পুরুষের অশ্বেতকায় জনপদ দখলের শুরু। রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের 'অসভ্য' বলতে এবং তাদের সভ্য করার জন্য পর্তুগাল ও স্পেনের রাজা আর রোমের পোপ এই জনপদগুলোয় ধর্মান্তর করতে অনুমতি দেন। এভাবেই উপনিবেশের প্রথম তরঙ্গ দেখা দেয়। অ-শ্বেতকায়দের আত্মা আছে কি না, এমন প্রশ্নে বিচলিত যাজকেরা আদিবাসীদের গণ ধর্মান্তরের মাধ্যমে উপনিবেশের প্রথম তরঙ্গ শেষ করেন।
উপনিবেশের দ্বিতীয় তরঙ্গে আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং ওশেনিয়ায় সম্পদ লুণ্ঠনের তীব্রতম চেহারা দেখা দেয়। ইংল্যান্ডে এসময় ইঞ্জিন চালিত শিল্প-বিপ্লব দেখা দেয়। এই নব্য পুঁজিবাদী সমাজে পুরুষ হবেন পরিবারের টাকা আয়কারী মূল ব্যক্তি। যে পুরুষ শক্ত-পোক্ত, রোজগেরে নয়, তার এমনকি বিয়ে করার বৈধতা নেই। অলস, দরিদ্র বা বেকার পুরুষ সমাজে সবার হাসি ও উপেক্ষার পাত্র।
ইতোমধ্যে কার্ল মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাদের সমাজতন্ত্রের বাণী নিয়ে মঞ্চে এলেও সেখানেও নারীর প্রশ্ন উপেক্ষিতই থেকেছে। যখনই নারীবাদীরা নারীমুক্তির কথা তুলেছে, তাদের 'চূড়ান্ত বিপ্লবে'র কথা বলে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নারীবাদ বনাম পুরুষ
আধুনিক শিক্ষা ও কাজের জগতে মেয়েদের টিকিট লাভের পর থেকে এবং সেই সাথে নারীবাদী আন্দোলনগুলোর ফলাফল হিসেবে হালের জমানায় ছেলেরা পড়েছে নতুন প্রশ্নের মুখে। সারাজীবন যে ছেলে বাবাকেই অফিস থেকে ফিরতে দেখেছে আর মাকে রান্নাঘরে, সে যখন বান্ধবী বা স্ত্রীকে দ্যাখে কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি আয় করতে- হয়তো সেই আয় অনেক সময় তাকে অনেক সাশ্রয়ও যোগায়, তবে বহু বছরের 'ট্যাবুগ্রস্ত' পুরুষটা তার ভেতর ধাক্কা খায়। যে মেয়ে তাকে কফির বিল দিচ্ছে, সে কি তাকে মানবে না? পাত্তা দেবে না? আহত হয় তার 'পৌরুষ।' শিক্ষা-যোগ্যতা-কাজে এগিয়ে যাওয়া মেয়েকে শায়েস্তা করতে নানা কৌশল নেয় সে। কখনো যোগ্যতায় বরং কম মেয়েকে সে বেছে নেয়। কখনো পদে পদে সন্দেহ-অপমান-বিদ্রূপে ক্লান্ত করে তোলে সঙ্গীনীর জীবন।
তবে এখানে মেয়েদেরও কিন্তু সময় এসেছে নিজের ভাবনা বদলানোর। নিজের থেকে কম আয় করা বা বেকার ছেলেকেই বিয়ে করুন না। কোনো বর কোটিপতি হলেই বা কি যদি তার সাথে সত্যি সুখীবোধ না করেন? একটি ছেলে কম ডিগ্রি বা কম আয়ের মেয়েকে নিতে পারলে আপনি পারবেন না কেন? আর এই যে আপনি মাচো পুরুষ- পৃথিবীর সব নারী-পুরুষের ভালো বললেও, বান্ধবী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রেই গুরু-গম্ভীর? মনের ভাব বুঝতে দেন না? কথায় কথায় কঠোর আচরণ করে নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে চান? তারপর একদিন সে বিদ্রোহ করে চলে গেলে অশ্লীল গালি দিয়ে নিজেই মদ খান, সিগারেট খান?
এইসব 'দেবদাস' মডেল থেকে বের হয়ে আসুন। একুশ শতকের নারী ও পুরুষ মুখোমুখি হয়ে বলুন একে অন্যের কাছে প্রত্যাশা। আপনার বর ছয় মাস ছবি আঁকতে চাইলে তাকে করতে দিন ও আপনি চাকরিটা রাখুন। স্ত্রী চাকরি থেকে এলে আপনি তাকে এক কাপ কফি করে দিতে পারেন। ছেলে হয়েও মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন না, এটা কেমন কথা? শেষে চল্লিশ না হতেই স্ট্রোক করবেন নাকি?
সমাজের হাজার বছরের প্রচল আর ছাঁচের অচলায়তন ফেলে দুজনেই বের হয়ে আসুন।
- লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক
- কৃতজ্ঞতা: (Reflections about man, masculinity and patriarchal society)