তারা মিয়া: অপরের জন্য যার পথ চলা
ত্রিশের ওপর বয়স তার, রিকশা চালান। সকাল আটটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। প্রায় প্রতিদিন। এ থেকে যা আয়, তাতে স্ত্রী-সন্তানসহ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনোরকমে দিন কেটে যায়।
এই টানাপড়েনের সংসার নির্বাহ করেও তিনি অবিশ্বাস্য রকমের এক বিরল কাজ করেন। প্রতিদিনের আয়ের অর্ধেক ব্যয় করেন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পেছনে।
নিজে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেননি, প্রায় নিরক্ষর; কিন্তু শিক্ষার মর্যাদা হৃদয় দিয়ে বোঝেন। যে কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ হয়েও শিক্ষার জন্য অফুরান মমতায় এলাকার সবার কাছে তিনি এখন অনুকরণীয়।
ব্যতিক্রমী এই মানুষের নাম তারা মিয়া, বয়স ৩৩। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলার চকলেঙ্গুরা গ্রামে। দিনমজুর বাবা আব্দুল সেলিমের ছেলে তারা মিয়া শৈশবে পরিবারের অসচেতনতা, সর্বোপরী অভাব-অনটনের জন্য লেখাপড়া করতে পারেননি। তাই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই বেদনা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন।
সাত বছর ধরে রিকশা চালান তারা মিয়া। আগে পা-চালিত রিকশা চালাতেন। এখন চালান ব্যাটারিচালিত। এতে দৈনিক গড়ে ৭০০ টাকা আয় হয় তার।
আয় যেমনই হোক, প্রতিদিন অর্ধেক খরচ করেন সংসারের জন্য। আর বাকি অর্ধেক রেখে দেন। এভাবে মাস শেষে কিছু টাকা জমা হলেই তা দিয়ে খাতা, কলম, স্কুল ব্যাগ, পেনসিল বক্স, টিফিন বক্স, খেলাধুলার সরঞ্জাম কিনে ছুটে যান পূর্ব নির্ধারিত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের সহযোগিতায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বাছাই করে নিজ হাতে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন তিনি। আর উৎসাহ দেন মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার।
দুর্গাপুর উপজেলার অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসায় সাত বছর ধরে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে আসছেন তারা মিয়া। এসব শিক্ষার্থীর একটা বড় অংশ গারো, হাজং প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর। এর বাইরে চকলেঙ্গুরা গ্রামের একটি কবরস্থানও নিজ খরচে এবং শ্রমে রক্ষণাবেক্ষণ করেন তিনি।
নলুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমিয় কুমার গুপ্ত বলেন, 'তারা মিয়া প্রায় সময়ই আমার স্কুলে এসে গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন। করোনাভাইরাস বাস্তবতায় স্কুল বন্ধ হওয়ার কিছুদিন আগেও আমাদের স্কুলে ৯০টি খাতা, সাতটি টিফিন বক্স, ৩০টি বলপেন ও একটি ফুটবল দিয়েছেন।'
ধানশিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সাজেদা বেগম জানান, তার স্কুলে কিছুদিন আগে ৫৭২টি খাতা বিতরণ করেছেন তারা মিয়া।
চকলেঙ্গুরা গ্রামে অবস্থিত বায়তুল কোরান ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক নূর মোহাম্মদ জানান, 'মাসখানেকের মধ্যে তারা মিয়া দুই দফায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে কোরআন শরীফ, খাতা, কলম ও ফুটবল বিতরণ করে গেছেন। এ রকম তিনি প্রায়ই করেন।'
চকলেঙ্গুরা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক বলেন, 'তারা মিয়া একজন গরিব মানুষ। রিকশা বেয়ে সংসার চালান। কিন্তু মনের দিক দিয়ে তিনি অনেক বড়। প্রতিদিন তার আয়ের টাকার একটি অংশ জমা করে রাখেন। মাস শেষে তা দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে স্কুলে স্কুলে বিতরণ করেন। অথচ আমাদের চোখের সামনে অনেক বিত্তবান মানুষ রয়েছেন, যারা সমাজের জন্য একটি টাকাও খরচ করেন না।'
জানা গেছে, তারা মিয়ার এমন শিক্ষাসহায়ক কর্মকাণ্ডের খবর পেয়ে 'ইস্টল্যান্ড ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড' নামে রাজধানীর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে তাকে এক লাখ টাকা পুরস্কৃত করেছিল। তারা মিয়া সেই টাকার পুরোটাই এলাকার দরিদ্র মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। একটি টাকাও রাখেননি নিজের জন্য।
ওই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক জানালেন তারা মিয়ার এই নিস্বার্থ মহানুভবতার কথা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর প্রথম দিকে তারা মিয়ার এ মানবিক সহায়তা কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার আয়-রোজগার। তবু কারও কাছে সাহায্যের হাত বাড়াননি। বরং নিজের সাধ্যমতো অন্যদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। জমানো ১০ হাজার ২০০ টাকা দুর্গাপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রীর করোনা সহায়তা তহবিলে জমা দিয়েছেন।
একটি বেদেপল্লীর খাদ্যাভাবের কথা জানতে পেরে কয়েকটি চালের বস্তা এবং কিছু নগদ টাকা নিয়ে সেখানেও ছুটে গেছেন তারা মিয়া। ৫০ জন অতি দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীকে বাছাই করে তাদের মাঝেও সাধ্যমতো অর্থ বিতরণ করেছেন।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তারা মিয়ার শিক্ষা-সহায়তা কার্যক্রম চলমান। গত ৯ নভেম্বর চকলেঙ্গুরা বায়তুল কোরআন ইসলামিয়া মাদ্রাসা এবং ১৫ নভেম্বর দেবথৈল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জড়ো করে, তাদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছেন তিনি।
চকলেঙ্গুরা গ্রামের একটি চৌচালা টিনের ঘরে স্ত্রী, ১১ বছর বয়সী ছেলে রিফাত মিয়া ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে তারা মিয়ার বসবাস। তার স্ত্রী নাজমা বেগম আগে সোমেশ্বরী নদীতে কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কিছুদিন ধরে ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করছেন। ছেলে রিফাত মিয়া স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে এ দম্পতি।
তারা মিয়ার কার্যক্রম সম্পর্কে নাজমা বেগম বলেন, 'আমার স্বামীর মন বড়। বড় মনের মানুষ। তা না অইলে রিকশা বাইয়া এমন কাম (কাজ) করতে পারত না। উনি এইভাবে খরচ না করলে হয়তো আমরা আরেকটু ভালাভাবে খাইতে-পরতে পারতাম। কিন্তু তা নিয়া কোনো দুঃখু নাই আমরার। তার মাধ্যমে অনেক গরিব-ছেলেমেয়ে লেহাপড়ার উৎসাহ পাইতাছে, এইটা শুনলে আমার খুব ভালা লাগে।'
নিজের নিত্য অভাব-অনটনের মধ্যেও এমন মানবসেবার প্রনোদণা কোত্থেকে পান, জানতে চাইলে তারা মিয়া বলেন, 'পরিবারের অভাব-অনটন আর অসচেতনতার কারণে ছোডু বেলায় লেহাপড়া শিখতাম পারি নাই। বড় অইয়া যখন বুঝতাম পারছি নিরক্ষর জীবন মূল্যহীন। তহন আর কিছুই করার ছিল না। তাই আমি চাই, টেহা-পয়সার লাইগ্যা যাতে কোনো বাচ্চার লেহাপড়া বন্ধ না অয়। হয়তো আমি সবার অভাব দূর করতাম পারতাম না। কিন্তু সামান্য সহযোগিতা বা একটু উৎসাহ তো দিতাম পারবাম। এইডা চিন্তা কইরাই আমি এইসব কাজ করতাছি। আমি কোনো ইস্কুলে গেলে ছেলে-মেয়েরা খুব আনন্দ পায়। তাদের লেহাপড়ার প্রতি উৎসাহ বাড়ে।'
সরকার বা সমাজের অন্য কারও কাছে কিছু চাওয়ার আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট বলেন, 'কারও কাছে আমি কিছু চাই না। শুধু দোয়া চাই, যাতে সারাজীবন এই কাজডা করতাম পারি।'
তারা মিয়ার মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত দুর্গাপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফারজানা খানম। তিনি বলেন, 'তারা মিয়া একজন মহৎপ্রাণ এবং সাদামনের মানুষ। আত্মপ্রচারের ধার ধারেন না। একজন রিকশাচালক হয়েও দেশ বা সমাজ নিয়ে ভাবেন। শিক্ষা প্রসারের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। কিছুদিন আগে তিনি আমার অফিসে এসে প্রধানমন্ত্রীর করোনা তহবিলে ১০ হাজার ২০০ টাকা দান করে গেছেন। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি আমাদের কাছে একটি বিরল উদাহরণ।'
তারা মিয়াকে দেখে সমাজের বিত্তবান মানুষদেরও এ ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এ কর্মকর্তা।