তিস্তার জল গড়িয়ে যায়, চুক্তি নিয়ে চলে আশ্বাসের পর আশ্বাস
তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করবে না এমন কথা ভারত এ যাবত বলেনি, সেটাই ভালো দিক। ভারতের নেতারা নিশ্চয়ই এটা ভালোভাবে জানেন যে, অভিন্ন কোনো নদীর পানি একতরফা আটকে রাখা রীতিমতো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপস্থী।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সদস্যসমাপ্ত ভারত সফরেও নয়াদিল্লিতে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রসঙ্গ এলে অন্যপক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ চুক্তি হবে।
গত দশ বছর ধরেই এরকম আশ্বাসবাণী শুনে আসছি আমরা।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর সেদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে যে যৌথ বিবৃতি দেন তাতে বলা হয়েছিল, দু’দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনায় একটি সন্তোষজনক সমাধানে আসা উচিত।
এক বছর পর মনমোহন সিং ঢাকা সফরে এলেন, অনেক আশার কিরণ নিয়ে যে, এবার প্রত্যাশা পূরণ হবে— চুক্তি হবে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে। কিন্তু নয়াদিল্লি হঠাৎ তিস্তা নিয়ে আলোচনাই বন্ধ করে দিল।
যৌথ বিবৃতিতে উভয় নেতা আবারও নিশ্চিত করলেন যে, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তিটি অগ্রসর হচ্ছে। ‘নিজ নিজ দেশের কর্মকর্তাদের বলে দেওয়া হল যেন তাঁরা ‘যত দ্রুত সম্ভব’ চুক্তি সম্পন্নের কাজ করেন।
‘যত দ্রুত সম্ভব’ চুক্তিতে উপনীত হবার আশ্বাসবাণীতে তারপরও কাজ হল না।
তিন বছর পর ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেন একই প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে উভয় দেশের সরকার তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে যৌথ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, সে বিষয়ে দ্রুত সমাধানে আসতে তাঁকে এবার অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা।
মোদি জানালেন, চুক্তিটি ‘যত দ্রুত সম্ভব’ করার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে কাজ চলছে।
সময় বয়ে গেল। ‘যত দ্রুত সম্ভব’, এই আশ্বাসটি এবারও রয়ে গেল কাগজে-কলমে।
বছর দুয়েক পর, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান। তিনি আবারও তিস্তা চুক্তির কথা তুললেন।
দু’নেতার যৌথ বিবৃতিতে একই সংলাপের পুনরাবৃত্তি-- ২০১৫ সালে যা বলেছিলেন তাঁরা।
সে ঘটনার দু’বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সদ্যই ভারত সফর করে এলেন। মোদি এবারও তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ তিস্তা চুক্তিটি হবে।
এত বছর ধরে দিল্লির এই ‘কেবলই আশ্বাস প্রদান’ বাস্তবতা পাল্টে দিতে পারেনি। উজানে ভারতের অংশে পানি প্রত্যাহারের ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার অংশটি শুকিয়ে যায়। সেচ কাজ চালাতে সমস্যা হয় কৃষকদের। পানির প্রাকৃতিক প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটার ফলে নদীর বাস্তসংস্থানও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নয়াদিল্লিতে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফরে ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই সরকারপ্রধান এ নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এবার চুক্তি সাক্ষর হয়। অথচ এখন পর্যন্ত বহুলআকাঙ্ক্ষিত তিস্তা চুক্তি নিয়ে অগ্রগতি দেখা যায়নি।
আশ্বাস পূরণের পালা এবার ভারতের। মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আশ্বাসবাণীর এই দুষ্ট চক্র কি তখন ভেঙে ফেলা যাবে? নাকি চুক্তিটি আবারও আশ্বাসের দোলাচলে দুলবে?
শীর্ষনেতারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসলে দু’দেশের বন্ধুত্বের মধুর চিত্রটাই তুলে ধরা হয়। কিন্তু বন্ধুত্বে আদান-প্রদান তো দু’তরফেই হওয়া উচিত।