লিসোটো রাজ্যের অলিম্পিক ভিলেজ
প্রচুর পর্বত ও হাল্কা বনানীতে পূর্ণ আফ্রিকার ছোট্ট রাজ্য লিসোটো-তে কিছুদিন হলো আমি বাস করছি। লিসোটোর রাজধানী হচ্ছে মাসেরু। কিছু দিন আগে আমি মাসেরুতে বেড়াতে আসি। তখন খুঁজে বের করি বছর দুয়েক আগে জিম্বাবুয়ের কবি সন্মেলনে পরিচয় হওয়া এক তরুণী-- কবি নাকাতুলে মোপালেসাকে। নাকাতুলের সাথে আমার জানাশোনা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাই এ যাত্রায় তার দরাজ হাতে সঙ্গদানের উপর ভরসা করেছিলাম। কিন্তু নসীব খারাপ, ইতিমধ্যে লিসোটোতে কর্মরত জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির এক বিপত্নীক কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. সাইমন ইনগ্রাম হিলের সাথে তরুণী কবিটির জোরালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। মাসেরুতে এসে আমি নাকাতুলের সঙ্গ পেয়েছি সল্প, তবে সে একটি উপকার করেছে, ড. ইনগ্রাম হিলের সাথে আমার যোগসূত্র ঘটিয়ে দিয়ে কনসালটেন্ট হিসাবে ছোটখাট কিছু কাজ পাইয়ে দিয়েছে।
এ ধরনের একটি কনসালটেন্সি জাতীয় কাজের হিল্লা ধরে আমি এ মুহূর্তে মাসেরু শহরের একটি হোটেলের লবিতে বসে আছি। লবির দেয়াল জুড়ে ঝুলছে চমৎকার সব চিত্রিত বস্ত্র। কোন কোন কাপড়ে ছাপ দিয়ে করা নকশা। অন্যগুলোতে আছে সুইসুতা দিয়ে আঁকা ছবি। আমি নোটবুকে এসবের একটি ডিটেল বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছি। ইউএনডিপির কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিছভ ড. ইনগ্রাম-হিল আমাকে এ কাজের অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি কয়েকদিনের জন্য জোহানেসবার্গে গিয়েছেন। আগামি বুধবারের ফ্লাইটে তার ফিরে আসার কথা। গেলো বছরের প্রচুর সময় তিনি কাটিয়েছেন স্থানীয় একটি বস্তিতে হস্তশিল্পের প্রকল্প বাস্তবায়নে। বস্তির মানুষজনরা সকলে এক সময় বাস করতেন মাসেরু শহরের প্রান্তিকে বেশ উঁচু পাহাড়ের পাদদেশ। তারপর ব্যাপক ভূমিধ্বশে তারা বাস্তুহারা হয়ে শহরের অন্য একটি বস্তিতে আশ্রয় নেন। ড. ইনগ্রাম-হিল এদের মাঝে যে সব নারী খানিকটা হাতের কাজ জানেন, তাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন এ প্রকল্প। ইউএনডিপি সচরাচর এ ধরনের মাইক্রো প্রজেক্টে জড়ায় না। পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে তার নিজের উদ্যোগে। তবে তিনি ইউএনডিপির কানেকশন ব্যবহার করে বস্তির হস্তশিল্প প্রকল্পের ফান্ডের সংকুলান করে দিচ্ছেন। উইকএন্ডের ছুটিতে তিনি নিজে বস্তিতে এসে কাজের তত্ত্বাবধান করেন। আজ মাসেরুর একটি হোটেলে বস্তি প্রকল্পের হস্তশিল্পের নমুনার প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে। আরো ঘন্টা দেড়েক বাদে দাওয়াতী দেখনেওয়ালারা হাতের কাজ দেখতে আসবে। উদ্যোক্তারা দেয়ালে সূচিকর্ম ও চিত্রিত বাটিক ঝুলিয়ে বিরতি নিয়ে বাইরে গেছেন লাঞ্চ সারতে।
আমি এখানে--লবির নিরিবিলিতে নোটবুক নিয়ে একটি টেবিলে বসেছি। লিসোটো খুবই ছোট্ট দেশ। পথঘাট দুর্গম, মাসেরু শহরে পর্যটক আসে অল্প। তাই বস্তির হস্তশিল্প চড়া দামে বিক্রি হাওয়ার সম্ভাবনা কম। ড. ইনগ্রাম-হিল চাচ্ছেন এসব পণ্য সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ বা কেপ টাউন এর মতো বড় শহরে বাজারজাত করতে। ওখানে আছে হস্তশিল্পের ওপর বেশ কয়েকটি পর্যটকভোগ্য ম্যাগাজিন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন, 'ভূমিধ্বসে বাস্তুহারা মানুষের হাতের কাজ' শিরোনামে বর্ণনাত্মক স্টোরী তৈরী করে দিতে; যা তিনি একটি ম্যাগাজিনে ছাপাবেন। আমাকে অনুরোধ করার পেছনে কারণ হচ্ছে, কয়েক দিন আগে তার সক্রিয় সাপোর্টে আমি মাসেরুর কেন্দ্রীয় কারাগারে 'অলটারনেটিভ টু ভায়োলেন্স' এর ওপর একটি প্রশিক্ষণ করেছি। অই সময় কিছু কয়েদিদের সাথে কথাবার্তা বলে কারাগারে কীভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে, সে বিষয়ে বর্ণনাত্মক রিপোর্ট তৈরী করে দিয়েছি। বর্ণনা তার পছন্দ হয়েছে, তাই তিনি আমাকে বস্তীর বস্ত্রশিল্পের ওপর স্টোরী তৈরী করে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি অপেক্ষা করছি-- লাঞ্চের পর প্রদর্শনীর উদ্যোক্তারা সাথে করে নিয়ে আসবেন বস্তির কয়েক জন নারীকে, যারা মূলত নিজ হাতে এ কাজগুলো করেছেন; আমি তাদের সাথে একটু কথাবার্তা বলবো।
হাতে সময় আছে, তাই আমি নোটবুকে অন্য একটি বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করি। এ ঘটনায় জড়িয়ে ছিলাম গতকাল ও তার আগের দিন। যার সাথে মাসেরু শহরের বাইরে গিয়েছিলাম, তার সঙ্গ চিকন কাজ করা কোর্তায় লেগে থাকা বাসি আতরের মতো এখনো মনে ছড়াচ্ছে মৃদু মৃদু সৌরভ। কোন প্রস্তুতি ছিলো না। কবি নাকাতুলে মোপালেসার অপেক্ষায় সকালবেলা দাঁড়িয়ে ছিলাম গুড টাইম ক্যাফের সামনে। ঝকঝকে একখানা সাদাটে ক্রিমকালারের ভেসপা চালিয়ে সে আসে। অফ হোয়াইট জিন্সের সাথে একই কালারের জ্যাকেট ও হেলমেট পরাতে মেয়েটিকে খানিকটা নভশ্চরের মতো দেখাচ্ছিলো। সে ড. ইনগ্রাম-হিলের ভেসপাটি চালিয়ে এসেছে। তিনি তো এখন জোহানেসবার্গে। নাকাতুলে ভেসপাখানা ক্যাফে-মালিকের গ্যারাজে নিরাপদে পার্ক করে অতঃপর আমাকে বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ি এলাকায় আউটিংয়ে যাওয়ার তথ্য দেয়। শহরের বাইরে যেতে আমার আপত্তি আছে, তা নয়। তবে আমি তো বাইরে যাওয়া প্রস্তুতি নিয়ে অভার-নাইট ব্যাগ ইত্যাদিসহ আসিনি। সে তার ব্যাকপ্যাক দেখিয়ে বলে, 'ম্যান নো প্রবলেম, এতে সব ব্যবস্থা আছে।' একটু খটকার মাঝে পড়ি।
পার্কিংলটে হর্ণ বাজিয়ে এসে দাঁড়ায় বেজায় বড় লাল রঙের একটি গাড়ি। ভ্যান গাড়িটি যিনি ড্রাইভ করছেন, তিনি গায়ে-গতরে বিশাল এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। ভদ্রসন্তান কম্বল কেটে তৈরী একটি হুডওয়ালা কানমাথা ঢাকা কালচে লোমশ জ্যাকেট পরে আছেন, তাই তাকে কেমন যেন আধবুড়ো গরিলার মতো দেখায়। তার পাশের সিটে লাল টিশার্ট পরে বসে আছেন আরেক ব্যক্তি। তার গলা থেকে ঝুলছে সাদা পুতির সাতনরী হার, তাতে গাঁথা জানোয়ারের দুটি শিং। তিনি নেমে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেকে মাকগথলা মাবই নামে পরিচয় দেন। পেশায় তিনি জাংগোল গাইড। ছুটখাট্ কথায়বার্তায় বুঝতে পারি, আমার আন্দাজ বেঠিক নয়, ভ্যানখানা এক সময় ফায়ার ব্রিগেডের অগ্নি নির্বাপক গ্যাস বহন করার গাড়ি ছিলো। ইঞ্জিন বিকল হলে তা নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়। এখন যিনি ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন, তিনি ছিলেন মাসেরু ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। মাইনা যথেষ্ট নয় বলে তিনি সার্ভিসে ইস্তেফা দিয়ে জাংগোল ট্যুরের কোম্পানি খুলেছেন। নিজের শরীর-গতর বেমক্কা কিসিমের ওজনদার, তাই সচরাচর পর্যটক নিয়ে তিনি বনজংগলের আশেপাশে গাড়ি পার্ক করে তাতে বসে বসে ঝিমান। মাকগথলা মাবই দেখনেওয়ালাদের পায়ে হাঁটিয়ে পাহাড়-পর্বত, হ্রদ-গন্ডার, হাতি ও জিরাফ দেখান। গাড়িতে চড়ার সময় দেখি, তার দরোজায় লালের উপর কালো আলকাতরা দিয়ে সৃজনশীল বানানে লেখা 'জ্যংগোল ট্যুর লিমিলেড'। পাশে মাথা হেট করা দুটি জেব্রার ছবি।
নাকাতুলের সাথে আমি পেছনের দিকে বসি। ভ্যান গাড়িটির এদিকে খোলা জায়গা প্রচুর। তাতে রাখা-- খনিতে পাথর ভাঙ্গার হাতিয়ার, তীরধনুক, বল্লম, দোনলা বন্ধুক, ও বোধ করি পর্যটকদের ভয় দেখানোর জন্য কোন জানোয়ারের দাঁতমুখ খিঁচানো খটখটে করোটি। আমি হাতিয়ারগুলোর দিকে কৌতূহলি নজরে তাকাই। অতীতে আমি আফ্রিকার ট্যুর কোম্পানির গাড়িতে বনে জানোয়ার দেখার সুবিধার জন্য বাইনোকুলার রাখা দেখেছি, তীরধনুক ও বল্লমের অভিজ্ঞতা এই প্রথম হতে যাচ্ছে। তবে কী আজকের কর্মসূচীতে বন্যপশুর সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহের সম্ভাবনা আছে?
যাই হোক, প্যাত প্যাত করে হর্ণ বাজিয়ে ভ্যান স্টার্ট দিতেই আমি জাঁকিয়ে নাকাতুলের পাশে বসি। পেছনে সিট বলতে যে সুপরিসর কাঠামোটিতে আমরা বসেছি, তা বোধ করি কাঠমিস্ত্রি দিয়ে তৈরী করা। তাতে জাজিমের মতো পুরু গদি পাতা। বালিশ, কুশন ও কম্বলের ঢালাও বন্দোবস্ত আছে। চাইলে পা ছড়িয়ে শোয়া যায়। সিটটি এমনই আরামদায়ক যে, মওকা পেলে এখানে সঙ্গমাদি সেরে নেয়া যায়।
নাকাতুলের সাথে আউটিংয়ে আমি আগেও গিয়েছি। তখন অবশ্য ট্যুর কোম্পানি বা ড্রাইভারের সাথে কথাবার্তা বলে দাম-দর, কোথায় যাবো, কি করতে বাসনা হচ্ছে--এসব আমিই ঠিক করেছি। এবারের আয়োজনে সে উদ্যোগ নিয়েছে। তা নিক, পুরুষ হিসাবে বিল তো আমাকে পে করতে হবে। লিসোটোতে ক্রেডিট কার্ডের চল কম। তাই মাসেরু শহর থেকে তোড়ে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে--আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বলি,'তুলিকা--সুইট লিটিল গার্ল, ড্রাইভারকে বলো গাড়ি ঘোরাতে। শহরের মধ্যিখানের স্কোয়ারে আছে সাউথ আফ্রিকান নেড ব্যাংক, ওখানকার এটিএম মেশিন থেকে একটু টাকাপয়সা তুলতে হচ্ছে যে।' সে গোলাপি রঙ মাখানো পূর্ণ ঠোঁট খানিক বাঁকা করে বলে,'হোয়াই? এ ট্যুরের জন্য তোমাকে কিছু পে করতে হচ্ছে না, অল আর এডভান্স পেইড ফর।' আমি না বলে পারি না,' তুমি হঠাৎ করে এতো টাকাপয়সা পেলে কোথায়?' সে মাথা ঝাঁকায়, তাতে তার কিন্তিলি চুলের মৌচাকাকৃতিতে যেন মধুভুক পতঙ্গরাজির ভেতর মৃদু আলোড়ন শুরু হয়। সে দুহাতে চুলের শেইপকে অগোছালো হতে না দিয়ে বলে,'ড. ইনগ্রাম-হিল পেইড ফর এভরিথিং, আমার বার্থ-ডে গিফ্ট হিসাবে তিনি এ ট্যুরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।' কোথায় দূরের কোন তেপান্তরের মাঠে আমার উড়ানো ঘুড়িটিকে অদৃশ্য কেউ যেন মাঞ্জা দেয়া সুতোয় কেটে নেয়। আমি কান্নি খেয়ে পড়ে যেতে থাকা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে ফাস্টট্রেটেড হয়ে বলি,'তুলিকা, আমাকে জিঞ্জেস করবে তো আমি ড. ইনগ্রাম-হিলের তোমাকে দেয়া ট্যুরে যেতে চাচ্ছি কিনা?' সে চোখমুখে কপট কঠিন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলে,'তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছো, আমি জন্মদিনে মার্বেল পাথরের টেবিল চাই কি না? গতকাল ফার্নিচারের একটি কোম্পানী থেকে পিকাপ ট্রাকে করে টেবিলটি আমার দিদিমার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে, লুক হোয়াট হেপেনড? ভারি টেবিলটি টানাটানি করতে গিয়ে..।' নাকাতুলে ডিজাইনার স্নিকার খুলে মোজা গুটিয়ে তার পা-টি বাড়িয়ে তুলে দেয় আমার ঊরুর উপর। চামড়া খানিক ছড়ে গিয়ে পায়ের গুছিতে বেগুনি হয়ে আছে। আমি ওখানে মৃদু আংগুল বুলিয়ে বলি,'এ ট্যুর ছাড়া ড. ইনগ্রাম-হিল তোমাকে জন্মদিনে আর কিছু দেয়নি?' সে কুশনে আধশোয়া হয়ে ঝুঁকে, ব্যাকপ্যাকের জিপার খুলতে খুলতে ফিচেল হেসে বলে,'আর ইউ শিওর ইউ ওয়ান্ট টু সি দিস?' আমি 'লেট মি সি' বলে হাত বাড়াই। খুব বড় না, এ-ফোর সাইজের সেলোফোনে মোড়া সাদা কাডবোর্ডে পেন্সিল দিয়ে আঁকা...প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় পালকে ঠোঁট-মাথা গুঁজে বসা দুটি কপোতের ছবি। তার নিচে সিসোটো ভাষায় লেখা 'লেবা লা-কা', বা 'মাই পিজিওন'। আমি কার্ডবোর্ডটি ঘুরিয়ে অন্য পারসপেক্টিভ থেকে তাকাই। তখনই বিষয়টা পরিষ্কার হয়, যা দেখছি তা কিন্তু আদপে জোড়া কবুতরের চিত্র নয়, আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ওঠে পরষ্পরের সাথে সন্নিবেশিত হয়ে থাকা যুগল স্তনের দৃশ্য। আমি তার দিকে তাকাই। সে আধশোয়া হয়ে কিন্তিলি চুলে দুহাতে বিলি কাটে, তাতে তার ভরাট বুক তীব্রভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে শরীরের ভঙ্গি বদলিয়ে, তা আড়াল করার চেষ্টা না করে বোধ করি নীরবে আমার রিএকশন শোনার জন্য অপেক্ষা করে। তো আমি বলি,' সো, আই আন্ডারস্ট্যান্ড ড. ইনগ্রাম-হিল লাভস্ ইউ।' সে ফিনকি দিয়ে হেসে বলে,' হি ইজ মাই সুগার ড্যাডি। সে আমাকে নিয়ে কী ভাবে, আই সিম্পলি ডোন্ট কেয়ার। তাকে যে পছন্দ করি না, তাও না। হি ইজ মাই টুথসিওটসি বাটার কাপ। এক্সপেনসিভ গিফ্ট দেয়াই তো তার কাজ।' বলে সে আমার সিনিওর সার্ভিসের প্যাকেট থেকে একটি সিগ্রেট বের করে তাতে লাইটারে আগুন দেয়। আমি 'সুগার ড্যাডি' টার্মটি নিয়ে মনে মনে তর্পণ করি। সুগার ড্যাডি হচ্ছে-- মূলত মাঝবয়সি বা বয়োবৃদ্ধ বিত্তবান পুরুষ, যিনি অল্পবয়সী কোন মেয়েকে সঙ্গদান ও দৈহিক ভালোবাসার বিনিময়ে প্রদান করেন দরাজ হাতে গিফ্ট ও কোন কোন ক্ষেত্রে টাকাপয়সা। ধোঁয়ার রিং ছুড়তে ছুড়তে নাকাতুলে যেন স্বগতোক্তি করে,' হি ইজ ভেরি গুড, বাট অ্যা বিট অব অ্যা সেক্স ডেভিল।' আমি সাবধানে সেলোফোনের র্যা পার মুড়িয়ে, পেন্সিল স্কেচটি তার ব্যাকপ্যাকে রাখতে রাখতে, কল্পনায় জুতা দিয়ে আধপোড়া সিগ্রেটকে পিষে নেভানোর মতো প্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করি।
কিছুক্ষণ আমরা কোন কথাবার্তা বলি না। ফায়ার ব্রিগেডের ভ্যানটি অনেকক্ষণ হয় পাড়ি দিয়েছে উপত্যকার দিগন্তে ছাড়ানো প্রান্তর। এখন আঁকাবাকাঁ সড়ক বেয়ে ভ্যানটি ছুটে যাচ্ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। পর্বতগুলোতে গাছপালা বৃক্ষলতা তেমন কিছু নেই। কী রকম যেন খাঁ খাঁ শূণ্যতার ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে শিলা পাথরের মন্সস্টারগুলো। দেখতে দেখতে পাথরের কালচে খয়েরি শরীর ধূসর হতে হতে ভরে ওঠে শুভ্রতায়। মাসেরু শহর থেকে যখন এ ভ্যানে চাপি, তখন নগরীর জনপদে ছলকে যাচ্ছিলো ঝকঝকে রোদ। এখন ঘুম ভাঙ্গতে দুস্বপ্নের মতো তা উপে গিয়ে আকাশ হয়ে এসেছে ভারি মেঘলা। আর গুড়ি গুড়ি তুষারের শুভ্র হাল্কা পালকে ভরে যাচ্ছে গিরিকন্দর। নাকাতুলে গাড়ি স্লো করতে বলে। আমরা মালিবামাটসো নদীর সাদা ফেনায় জলচর পাখিদের সাঁতার কাটতে দেখি। সামনের সিট থেকে জাংগোল গাইড মাকগথলা মাবই ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চান, আমি 'পিডিপিডি' বা বেলেহাঁসের ছবি তুলতে চাই কি না? আমার ভেতরে কেন জানি উৎসাহ মরে আসছে, তাই কোন জবাব দেই না। ভ্যান স্পীড পিক করে আবার ছুটে চলে । পাহাড়ের ঠিক কার্নিশে ঝুলে আছে টেনিস কোর্টের সমান একটি শিলাপাথরের সমতল চাকলা। ওখানে ভ্যান পার্ক করলে আমরা নেমে আসি। জায়গাটি অনেকটা লুক আউটের মতো। দূরে পরিষ্কার দেখা যায় কাটসে ড্যাম। টারবাইনে চূর্ণিত হয়ে জলবিদ্যুতের এ প্রকল্প থেকে পানি নেমে আসছে প্রপাতের ধারা প্রবাহে। তুষার ঝরা তীব্র শীতে কাবু হয়ে আমরা ফিরে আসি গাড়িতে।
ড্রাইভার তীব্র দক্ষতায় মিনিট পনেরোর ভেতর আরেকটি বাঁক ঘুরে আমাদের নিয়ে আসেন কাটসে ড্যামের বেশ কাছাকাছি। বাঁকানো ব্রীজের মতো করে তৈরী একটি সিমেন্টের সড়ক লিসোটো হাইল্যান্ড ওয়াটার প্রজেক্টের বিখ্যাত বাঁধটিকে ঘিরে আছে। তার ওপর দিয়ে একজন মানুষকে অলস পায়ে হেঁটে যেতে দেখি। এদিকে কোন তুষারপাত কিছু হচ্ছে না, ঘাসপাতা সমস্ত কিছু খটখটে শুকনা দেখে বড় অবাক লাগে!
ভ্যান গাড়িটি আবার চড়াই উৎরাই ভাঙ্গে। আরো মিনিট তিরিশেক আমরা পথ চলি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি হ্রদের জল, তার অতলে প্রতিফলিত হচ্ছে বিশাল মেঘভাসা আকাশ। আমি গাড়ি থেকে নেমে হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার ভেতরবাগে জেগে ওঠা ছোট্ট দ্বীপাণুর দিকে তাকাই। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে গাড়িতে পোষাক চেঞ্জ করে নীলাভ ট্র্যাকস্যুট পরে বেরিয়ে আসে নাকাতুলে। তার পকেটে বাজছে সিডি ওয়াকম্যান। মৃদু মৃদু সুরধ্বনি শুনে আমি লিরিকটি চিনতে পারি-- 'নো মোর ওয়াক ইন দ্যা উড/ দ্যা ট্রিজ হ্যাভ অল বিন কাট ডাউন।' ১৯৭১ সালে লস এ্যঞ্জেলসে 'দ্যা ঈগলস্' নামে একটি আমেরিকান রক ব্যান্ডের গাওয়া গান। বছর তিন বা চারেক আগে জিম্বাবুয়েতে যখন নাকাতুলের সাথে প্রথম দেখা হয়, তখন আমি তাকে এ সিডিটি গিফ্ট হিসাবে দেই। সে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বলে,'এ জায়গাটি তুমি দেখতে চেয়েছিলে। ডু ইউ রিমেমবার?' বিষয়টি এবার আমার মনে পড়ে। কয়েক বছর আগে আমি ইউরোপীয় এক রাজকুমারের লেখা লিসোটো নিয়ে একটি ট্র্যাভেল একাউন্ট পড়ি। লিসোটোর রাজা গ্রিফিথ লিরোথলি'র মেহমান হয়ে রাজকুমার এখানে তিন দিন তাঁবু খাটিয়ে বাস করেন। তার বর্ণনাতে হ্রদের কোন উল্লেখ নেই। তবে তিনি এখানে প্রচুর কনিফার বৃক্ষের চিরহরিৎ একটি উপবনের দৃশ্য বর্ণনা করেছিলেন। লিসোটোর এ অঞ্চলের পাহাড়ে গাছপালা তেমন কিছু জন্মায় না। তবে এখানে হঠাৎ করে সবুজের বিপুল সমারোহ দেখে রাজকুমার অবাক হয়েছিলেন তীব্রভাবে। তার তাঁবুর চারদিকে ছিলো 'ইরিকাস' নামে এক ধরনের ঝোপ। তাতে উড়াউড়ি করছিলো অজস্র পাখি। তিনি 'টুসোক' বলে এক ধরনের দীর্ঘ ঘাসের উল্লেখ করেছেন, যেখানে লুকোচুরি করছিলো খরগোস। জলবিদ্যুত প্রকল্পের কারণে এখানে ওয়াটার রিজারভার হিসাবে তৈরী করা হয়েছে কৃত্রিম সরোবর। উপবনটি স্রেফ ডুবে গেছে তার তলায়। আমি নিসর্গপটের এ পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভ্যান গাড়িতে ফিরে যাই। নাকাতুলে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলে,'লিসেন, উপবনের জলে নিমজ্জন নিয়ে আমি বাঁধতে চাচ্ছি একটি পালা গান। ঈগল নামে রক ব্যান্ডের করা গানটির স্ট্রাকচার থেকে সুরের অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কিন্তু লিরিকের কথাগুলো ঠিক মতো সাজিয়ে উঠতে পারছি না। উইল ইউ হেল্প মি অ্যা বিট?' আমি নোটবুক খুলে তাতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলি,'জাস্ট ট্রাই টু ডেসক্রাইব ইন প্লেইন এন্ড সিম্পল সিসোটো লেংগুয়েজ..ইউরোপের রাজকুমার আবার যদি ফিরে আসেন, হোয়াট হি উইল সি..।' তখনই জাংগোল গাইড মাকগথলা মাবই ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন,' পিডিপিডি.. পিডিপিডি..।' আমরা জানালা দিয়ে তাকাই, দেখি--সরোবরের জলে ঝাপিয়ে পড়ছে এক ঝাঁক বেলেহাঁস। আমি নাকাতুলের হাতে নোটবুক দিয়ে বলি,'ট্রাই টু ইউজ দিস ইমেজ এ্যজ ইয়োর হুক। সরোবরের জলে বেলেহাঁসের জল ঝাপটানো নিয়ে শুরু করো। তারপর ফিরে যাও আরেকটু পেছনে, বর্ণনা করো উপবনে তাঁবু খাটিয়ে রাজকুমারের বসবাস, আর টুসোক ঘাসে খরগোসের ছুটাছুটি। চাইলে এ গাঁথাতে তুমি মেশাতে পারো খানিক কল্পনা, রাজকুমারের এনগেজমেন্ট রিংটি যে ঘাসের গুচ্ছে হারিয়ে গিয়েছিলো সে কাহিনী।' সে চোখ বড় বড় করে জানতে চায়,'ওয়াজ দ্যা প্রিন্স রিয়েলি লস্ট হিজ এনগেজমেন্ট রিং হিয়ার?' আমি বলি 'তুলিকা, নট রিয়েলি, ইন ফ্যাক্ট হি লস্ট হিজ রোলেক্স ওয়াচ। ঘাসের আড়ালে বসে থাকা খরগোসের ছবি তুলতে গিয়ে তার কব্জি থেকে চেন লুজ হয়ে খসে পড়েছিল ঘড়িটি। নাও ডিসাইড, গানের পালায় তুমি রোলেক্স ঘড়ির ডিটেল ব্যবহার করবে, নাকি জুড়ে দেবে এনগেজমেন্ট রিং হারিয়ে যাওয়ার কাল্পনিক গল্প।'
ভ্যান গাড়িটি আবার ছুটে চলছে বাঁকা হয়ে, তিমি মাছের পেটের মতো ছোট ছোট উপত্যকা মাড়িয়ে ভিন্ন এক পাহাড়ের দিকে। নাকাতুলে উডপেন্সিলে পালাগানের লিরিকের বাক্য সাজাচ্ছে। আর থেকে থেকে পেন্সিলের গোড়ার রাবার দিয়ে কন্ঠার কাছে চুলকাচ্ছে। তাতে লালচে বেগুনি হয়ে উঠছে তার ত্বক। এদিককার একটি পাহাড়ে গড়ে ওঠেছে আধুনিক কেতার অনেকগুলো কটেজ। আমরা গাড়ি থেকে নামি। ড্রাইভারও তার বেমক্কা কিসিমের ভারি শরীর নিয়ে নেমে পড়েছেন। তিনি শরীর বাঁকিয়ে হাতপা ছুড়ে বাতাসে ঘোসাঘুসির ভঙ্গি করে হাতপায়ের খিল ছোটাচ্ছেন। চোখ মুদে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ ব্যাদান করে, হাঁপানি ও শ্লেষা জড়ানো কন্ঠে তিনি গ-র-র-র আওয়াজ করছেন। ভদ্রলোকের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হয়, তিনি গন্ডার ফন্ডারের সাথে মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাকাতুলে ও আমি কটেজগুলোর মাঝ বরাবর তৈরী পিচডালা পথে একটু হাঁটি। সাউথ আফ্রিকার এক তেজারতি কোম্পানি এ গ্রামটি তৈরী করেছে অনেকটা অলিম্পিক ভিলেজের কায়দায়। আমাদের পাশ দিয়ে জগিং করে ছুটে চলে শ্বেতাঙ্গ স্পোর্টসম্যানদের তিন-চার জনের ট্রুপ্। কোন কোন কটেজের সামনের লনে সর্টশ্ পরে স্বর্ণকেশী যুবতীরা খেলছে স্কিপরোপ। বারান্দায় বুকডন দিচ্ছেন মাথা কামানো তিন জন নওজওয়ান কিসিমের সাহেব। তাদের একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লে, তার মুখমন্ডলকে দেখায় প্রচুর মাখন আর গুড়ামরিচ দিয়ে ভাঁজা কাঁকড়ার মতো লালচে। নাকাতুলে বলে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠার আগে এখানে ছিলো দরিদ্র বাসোটো সম্প্রদায়ের মানুষদের টমালেতালি নামে একটি গ্রাম। এরা সকলে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে বাস করছে মাসেরু শহরের বস্তিতে। তাদের সনাতনি কেতার কুটিরগুলো ভেঙ্গেচুরে সাফসুতরা করে গড়ে তোলা হয়েছে অলিম্পিক ভিলেজের রেপ্লিকা। ইউরোপের স্পোর্টস করনেওয়ালা সাহেব-মেমদের সন্তানাদি এখানে আসছে সস্তায় উইন্টার অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিতে। আমি এবার নির্দ্দিষ্টভাবে জানতে চাই,'হোয়াট এলজ্ ডু ইউ নো তুলিকা আবাউট দিজ ভিলেজ? এ গ্রাম সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবে কি?' সে জবাব দেয়,' ড. ইনগ্রাম-হিল একটি স্থানীয় এনজিওকে নিযুক্ত করেছেন, টমালেতালি গ্রামের বাস্তুহারাদের মাঝে ত্রাণ প্রকল্প করার জন্য। তারা ছোট্ট একটা সার্ভে করে রিপোর্ট তৈরী করেছে। তাতে কিছু দুঃখজনক তথ্য আছে, এ গ্রামের কেউ কোম্পানির কাছ থেকে এখনো খেসারত হিসাবে কোন টাকাপয়সা পায়নি। আর তরুনী মেয়েরা প্রায় সকলে শরীর বিক্রি করছে পর্যটকদের কাছে।'
ভ্যান গাড়ির দিকে হেঁটে ফিরতে ফিরতে আমরা আবার ঘাড় ঘুরিয়ে অলিম্পিক ভিলেজের পিকচারাস্ক দৃশ্যপটের দিকে তাকাই। নাকাতুলে মন্তব্য করে,'ড. ইনগ্রাম-হিল ইজ রিয়েলি কাইন্ড টু দি পুওর হোমলেস পিপুল্ অব টমালেতালি ভিলেজ।' আমি বিরক্ত হয়ে বলি,'উনার প্রসঙ্গ পরে আলাপ করলে হয় না।' সে প্রথমে অবাক হয়, তারপর মুখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে তুলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাকে মোকাবেলা করে,'আই থিংক আই নিড টু ক্লারিফাই মাই রিলেশনশিপ টু ড. ইনগ্রাম-হিল।' আমি জবাব দেই, 'নো, ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু। তুমি তো বলেছো হি ইজ ইয়োর সুগার ড্যাডি। আর সুগার ড্যাডি হলে কি ধরনের সম্পর্ক হতে পারে, এটা আমি বুঝতে পারি।' এবার সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে সে বলে,'আই লাইক ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ইজ আফ্রিকা। লিসোটোতে মেয়েদের মনোগমাস হওয়ার কোন রীতি নেই, শুনেছি ভারতবর্ষে এখনো অনেক মেয়ে একদারনিষ্ট। এমন কি তাদের বিবাহবহির্ভূত একজন প্রেমিক থাকলেও তা নিগেটিভভাবে দেখা হয়।' আমি এবার অসহিষ্ণু হয়ে বলি,'তুলিকা, হোয়াই আর উই টকিং আবাউট দিস?' সে জবাব দেয়,'বিকজ, আই লাইক ইউ টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি, আই অ্যাম অ্যা বাসোটো গার্ল উইথ নো মানি। ড. ইনগ্রাম-হিল হচ্ছেন মাকগোওয়া বা বিত্তবান শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। বিয়ের আগে একটি বাসোটো মেয়ের নিইয়াটসি বা মিসট্রেস হতে সামাজিক আপত্তি কিছু নেই। ১৯০১ সালে আমাদের রাজা মহান লিটসে লিরোথলি এ ধরনের সম্পর্ক অনুমোদন করে ফরমান জারি করে গেছেন।' আমি এবার আলোচনার কনক্লুসনে আসতে চেয়ে পকেট ডিকশনারী বের করে সরাসরি সিসোটো ভাষায় জানতে চাই,'ও থাবিলে' বা 'আর ইউ হেপি তুলিকা?' সে ঠোঁট কামড়ে জবাব দেয়,'আই অ্যাম নট গোয়িং টু আনসার দিস টু ইউ, আন্ডারস্ট্যান্ড?' আমি মাথা হেলিয়ে বলি,'ইয়েস, আই ডু।'
আমরা চলে আসি ভ্যানের পাশে। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের তীব্রটানে দারুণভাবে হাঁপাচ্ছেন। মাকগথলা মাবই দেখি উবু হয়ে বসেছেন পাহাড়ের কার্নিশে। ভাবি, এ ভদ্রসন্তানের বোধ করি প্রক্ষালনের প্রয়োজন হয়েছে। একটু পর তিনি হাঁটু ভাঁজ করা দু পায়ের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে--কানের লতি ছুঁয়ে কোলাব্যাঙের মতো লাফিয়ে ওঠেন। আর থেকে থেকে তার কন্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসে,'কা-ট-ছো পো-লা না-লা' ধ্বনি। ব্যাপার কি জানতে চাই, জবাবে নাকাতুলে বলে,'মাবই প্রার্থনা করছেন যেন ঝরে বৃষ্টি অঝোর ধারায়, জংগল ভরে ওঠে পত্রপল্লব ও ঘাসপাতায়, আর প্রাণীদের যেন অনটন হয়না খাবারের।' এ ব্যাখ্যার পরও আমি তার আচরণ ভালো করে না বুঝলে সে আবার বলে,' একটু পর মাবই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন জংগলে রাজার খাস মহালে। বাসোটো সম্প্রদায়ের মাঝে শিকারে যাওয়ার আগে বনানীর মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করার রেওয়াজ আছে। এতে করে বন্যপ্রাণীর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।' মাকগথলা মাবই এবার তার গলায় ঝোলানো শিঙ্গা বাজিয়ে আমাদের ভ্যানে উঠে পড়ার ইশারা দেন। আমি বিরস বদনে নাকাতুলের পাশে বসতেই সে চোখের পাঁপড়ি কাঁপিয়ে বলে,'তোমার মতো যারা ঘুরে বেড়ায়, ট্র্যাভেল করতে ভালোবাসে, সিসোটো ভাষায় তাদের বলা হয় মোয়েতি। ইউ আর অ্যা ফাইন মোয়েতি, এন্ড আই লাভ টু ট্রাভেল উইথ ইউ ', বলে হাত বাড়ালে আমি তার করতল স্পর্শ করি।