রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
অঘ্রাণের দিন
একটা সময়ে আমাদের কাছে ডিসেম্বর শুরু হওয়া মানে ছিল আনন্দের দিন শুরু হওয়া। যেমন, ক্লাস-পরীক্ষা শেষ সুতরাং দিনের বেলা হাতে অফুরান সময়, দিনমান খেলা, সন্ধ্যায় একটু দেরি করে ঘরে ফেরা। পরীক্ষার ফলাফল দিতে দিতে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ হয়ে যেতো। পাশ-ফেল নিয়ে আমাদের কারো বিশেষ কোন মাথাব্যথা ছিল না। ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া নিয়ে খুব বেশি পরিবারে চাপ ছিল না। বেশিরভাগ জনের বাবা তার কোন সন্তান কোন ক্লাসে পড়ে এবং সে কেমন শিক্ষার্থী তার কিছুই জানতেন না। মায়েরা এরচেয়ে একটু বেশি জানতেন তবে সেটা খুব বেশি কিছু না। ক্লাসে কী পড়ানো হয়, সেখানে নিজের বাচ্চা কেমন করছে, স্কুলে পড়ানোর বাইরে আর কিছু হয় কিনা, বাচ্চার কার কার সাথে বন্ধুত্ব আর কার কার সাথে শত্রুতা হল এসবের কিছুই বাবা-মা জানতেন না বা জানার চেষ্টা করতেন না। আসলে এগুলো যে ভাবার বিষয় সেটা নিয়ে খুব কম বাবা-মা ভাবতেন।
ডিসেম্বর মানে সারা দিন পাড়ার পেছন দিকের ফাঁকা প্লটগুলোতে ক্রিকেট খেলা, বিকেল-সন্ধ্যায় যে বাড়ির আঙিনায় বাতাসের ঝাপটা কম সেখানে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা। যে বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো সে বাড়ি থেকে বিদ্যুতের লাইন টেনে নেটের দুপাশে দুটো বোর্ডে চারটা চারটা করে আটটা দুইশ ওয়াটের লাইটবাল্ব লাগানো হতো। উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ ভেসে যেতো আর তার মাঝখানে শাটলকক্ পেটানো, উল্লাস বা আক্ষেপের অর্থহীন শব্দের পাশাপাশি শোনা যেতো টুয়েলভ অল, হোপ-টুয়েলভ, লাস্ট-টুয়েলভ, সেট আপ! ছোটদের ব্যাডমিন্টন র্যাকেট হতো পুরো কাঠের শক্তপোক্ত যেন ভেঙে না যায়। বড়রা কাঠের বা প্লাস্টিকের হাতলে স্টিল ফ্রেমের। আবার একেবারে বাচ্চাদের র্যাকেট, শাটলকক্ সবই হতো প্লাস্টিকের। আমাদের র্যাকেট হতো 'ডানলপ', 'উইলসন' বা 'স্ল্যাযিংগারের'। আশা করতাম কিছু টাকা পেলে 'ইয়োনিক্স'-এর র্যাকেট কিনবো। আমরা জানতাম দামি র্যাকেটের স্ট্রিংগুলো গরু বা ছাগলের নাড়ি শুকিয়ে বানানো হয়, যদিও তার সত্যতা জানতাম না। গাঢ় সবুজরঙের সিলিন্ডারাকৃতির কাগজের বাক্সে রাখা দুধ সাদা পালক লাগানো শাটলকক্গুলোকে দেখলে আমার মনে হতো এক একটা পরী। খেলে খেলে ওগুলো যখন মলিন হয়ে পড়তো, পালক খসে পড়তো সেটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো। মনে হতো একটা পরীর নির্মম মৃত্যু হলো।
আমরা ক্রিকেট খেলতাম সাধারণত টেনিস বল আর পাড়ার কাঠমিস্ত্রীর দোকানে তক্তা দিয়ে বানানো ব্যাট দিয়ে। কারো কারো সত্যিকারের ক্রিকেট ব্যাটও ছিল, তবে সেটা সবসময় পাওয়া যেত না। বলের বাউন্স নিয়ন্ত্রণের জন্য তাতে লাল রঙের ইলেকট্রিক টেপ প্যাঁচানো হতো। বেশিরভাগ সময়ে ব্যাটের উলটো দিকে ইটের টুকরো দিয়ে দাগ দিয়ে লটারি করে একজন ব্যাট করতো বাকিরা পালাক্রমে বোলিং আর ফিল্ডিং করতো। অপেক্ষাকৃত দক্ষ কেউ উইকেটকিপারের ভূমিকায় নামতো। এই প্রকার ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারের বালাই ছিল না, এলবিডব্লিউ বলে কিছু ছিল না, আমাদের গ্লাভস-প্যাড-অ্যাবডোমেন গার্ড-হেলমেট ছিল না, ওভার মেপে ইনিংস খেলার ব্যাপার ছিল না। আমরা যার যা কিছু আছে তাই পরে খেলতাম। কেউ কেউ স্টাইল করার জন্য রিস্ট ব্যান্ড, হেড ব্যান্ড বা ক্যাপ পরতো। এই খেলায় একটা ব্যতিক্রমী বাউন্ডারি ছিল – দুই! বলটা যদি ধারেকাছের ডোবা, ময়লার স্তুপ বা পাশের বাড়ির সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে চলে যেত তাহলে বল খুঁজে আনতে যত সময় লাগুক রান দুই হতো। মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটত কেউ উড়িয়ে বল মারলে সেটা কাছের কোন ঝাকড়া গাছের ডাল-পাতায় আটকে যেত। তখন একজন গাছে উঠে গাছ ঝাঁকাতো আর ব্যাটসম্যান ছাড়া বাকিরা বল 'ক্যাচ' ধরার জন্য দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকতো। বল 'ক্যাচ' ধরতে পারলেই ব্যাটসম্যান 'আউট'। খেলোয়ার সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে দুই দলে ভাগ হয়ে খেলা হতো যেখানে এক দলের সবাই আউট না হওয়া পর্যন্ত ইনিংস চলত। সেই ইনিংসে সব মিলিয়ে পঞ্চাশের উপরে রান উঠলেই আমরা 'হাফ সেঞ্চুরি আপ' বলে খুশিতে নাচানাচি করতাম। কারণ, বেশিরভাগ সময়ে দল পঁচিশ থেকে ত্রিশ রানের মধ্যে অলআউট হয়ে যেত। মাঝে মাঝে ছক্কা হাঁকানো বল উড়ে গিয়ে এমন বাসায় গিয়ে পড়তো যে বাসার 'খালাম্মা' সর্বদা আমাদের ওপর খেপে থাকতেন। বল তাঁর হাতে পড়লে আর কথা নেই – বঁটি দিয়ে কেটে দুভাগ করে ছুঁড়ে মারতেন। এমন ঘটনা ঘটলে ছক্কা হাঁকানো খেলোয়ারকে 'আউট'ঘোষণা করা হতো।
ক্রিকেট নিয়ে দেশজুড়ে উন্মাদনা শুরু হতে তখনো অনেক বছর বাকি। বাংলাদেশ তখন আইসিসি'র সহযোগী সদস্য। বড় দলগুলোর সাথে খেলার সুযোগ প্রায় নেই। কালেভদ্রে ইংল্যান্ড থেকে এমসিসি, ভারত থেকে হায়দরাবাদ ব্লুজ আর পাকিস্তান থেকে ওমর কোরায়েশী একাদশ খেলতে আসতো। ঢাকায় যখন প্রথম এশিয়া কাপ হলো তখন মতিঝিলে ব্যাংকের সামনে খুব সকাল থেকে টিকিট কেনার জন্য আমরা দুই ভাই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হুঁশ ছিল না রাস্তার উলটো দিকের ভবনে আব্বুর অফিস। সাত তলা থেকে আমাদেরকে দেখতে পেয়ে নিজেই নিচে নেমে আসেন। আমরা বমাল গ্রেফতার! সেই টুর্নামেন্টের ফাইনাল দেখার জন্য আমাদের কয়েক প্রতিবেশি অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িভরে বিরিয়ানী রান্না করে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা অবশ্য কেবল পানির ফ্লাস্ক আর বাদ্য-বাজনা নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্রিকেটের বড় দেশগুলোর খেলা শোনার জন্য লোকে শর্টওয়েভ রেডিওতে নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলতি ধারাবিবরণী দিচ্ছে এমন স্টেশন খুঁজে বের করতেন। অবশ্য ভারতীয় রেডিও আকাশবাণীর সম্প্রচার মিডিয়াম ওয়েভেই শোনা যেত। আমরা রেডিওতে শুনে পয়েন্ট-গালি-স্কয়ার-ফাইনলেগ ইত্যাদির অবস্থান বুঝতে গলদঘর্ম হয়ে যেতাম বলে পরদিন ইত্তেফাকের সপ্তম পাতায় খেলার খবর পড়ে সন্তুষ্ট থাকতাম। কালেভদ্রে বিটিভিতে ক্রিকেট খেলার সম্প্রচার হতো। অবশ্য তখন সপ্তাহের দিনগুলোতে টিভি খোলা থাকত বিকেল পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তাতে ক্রিকেটের মতো কেবল দিনের বেলা খেলে, দিনমান ধরে চলে এমন খেলা কী করে দেখাবে!
ডিসেম্বরে অনেকেই নানা বাড়ি বা দাদা বাড়ি বেড়াতে যেত। আমাদের দাদাবাড়ি বলে কিছু না থাকায় এবং নানা বাড়ি একই পাড়ায় হওয়ায় এটা নিয়ে খুব মন খারাপ হতো। এই মন খারাপের আংশিক ক্ষতিপূরণ হতো কখনো আম্মুর নানা বাড়িতে বড় মা'র কাছে যেতে পেলে। বড় মা যেখানে থাকতেন সেটা ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তে। এখন বাসে বা গাড়িতে করে সেখানে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া গেলেও তখন পৌঁছাতে এক বেলা লেগে যেত। কারণ, যেতে হতো সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে। লঞ্চ সদরঘাট থেকে।ছাড়ার পর প্রথমে ফতুল্লা তারপর একে একে সাপের চর, রামকৃষ্ণদী, গাবের পাড়া, সৈয়দপুর, আলমপুর হয়ে কলাকোপা, বান্দুরা যেত। বড় মা'র বাড়ি যাবার জন্য গাবের পাড়াতে নামতে হতো। গাবের পাড়া থেকে স্টপেজটা পরে কুচিয়ামোড়াতে চলে যায়। স্টপেজগুলোর একটাতে উঠানামা করার জন্য পন্টুন থাকলে ঠিক তার পরেরটাতে পন্টুন থাকত না। যেমন, ফতুল্লাতে পন্টুন ছিল কিন্তু সাপের চরে না, রামকৃষ্ণদীতে ছিল কিন্তু গাবের পাড়ায় না। লঞ্চ ছিল প্রতি ত্রিশ মিনিটে একটা করে। সবচে' বড় লঞ্চ এম ভি মুন্নি ১ আর ২, ছোট লঞ্চগুলোর নাম কোনটা এম ভি মামুন, কোনটা এম এল গাবের পাড়া, আবার কোনটার নাম নেই। সেই লঞ্চে চড়ে আমার সবচে' বেশি দূর যাওয়া হয়েছে সৈয়দপুর পর্যন্ত। অথচ আমার খুব ইচ্ছে করত কলাকোপা বান্দুরা পর্যন্ত যেতে। কলাকোপা বান্দুরা নাকি খুব সুন্দর জায়গা, যেখানে নদী সরু হয়ে বাড়ির ঘাটের খালের মতো গৃহপালিত, নিজস্ব হয়ে গেছে। ঐ এলাকা রোমান ক্যাথলিক অধ্যুষিত যেখানে দুইশ বছরের পুরনো গীর্জা আছে, ছায়াঢাকা গ্রামের পথ আর অবারিত ফসলের মাঠ আছে। কিন্তু সেখানে তো আমার কোন আত্মীয়স্বজন থাকে না তাই শুধু শুধু বেড়াতে যাবার জন্য কেউ কখনো আমাকে কলাকোপা বান্দুরা নিয়ে যায়নি।
লঞ্চ ফতুল্লা ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে বড় বড় কোল্ড স্টোরেজগুলোর পালা শেষ হয়ে নদীর দুপাশ সুন্দর হয়ে উঠত। সাপের চর স্টপেজে লোকজন বড় বড় স্টিলের বালতিতে করে দুধ নিয়ে উঠত যার মুখে কচুরিপানা দেয়া থাকত যেন দুধ ছলকে পড়ে না যায়। হকাররা ঝালমুড়ি, সেদ্ধ ডিম, চা, পান আর সিগারেট বিক্রি করতে উঠত। ঝালমুড়িওয়ালার গলায় গামছা দিয়ে ঝোলানো জাদুর বাক্সের মতো সামনে কাচদেয়া টিনের বাক্সের চেয়ে আমাকে বেশি আকর্ষণ করতো ধনেপাতা, টমেটো, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর সর্ষের তেলের মিলিত সুঘ্রাণ। ঝালমুড়ি বানানো একটা অতি উঁচু দরের আর্ট – এক হাজার জনের মধ্যে একজনও ঠিকঠাক ঝালমুড়ি বানাতে পারেন কিনা সন্দেহ হয়। গাবের পাড়া বা সৈয়দপুর স্টেশনে যখন লঞ্চ থেকে নেমে যেতে হতো তখন আমার ভারি মন খারাপ হতো। মনে হতো লঞ্চটা আমাকে ছেড়ে কলাকোপা বান্দুরার স্বপ্নের দেশে চলে যাচ্ছে। আমি একদৃষ্টে পশ্চিম পানে লঞ্চটার চলে যাওয়া দেখতাম।
একবার দেখি এক গোটা লঞ্চ ভাড়া নিয়ে বরযাত্রী যাচ্ছে। লঞ্চে মাইক লাগিয়ে উচ্চস্বরে বাজানো হচ্ছে –
চন্দন পালঙ্কে শুয়ে
একা একা কী হবে
জীবনে তোমায় যদি পেলাম না
অথবা,
আমি তার ছলনায় ভুলব না, না না
কাজ নেই আর আমার ভালোবেসে
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ নদীর বুকে প্রতিধ্বনিত হয়ে চারদিকটাকে যেন আনন্দ আলোয় উদ্ভাসিত করে ফেলেছিল। আমার খুব ইচ্ছে করেছিল ঐ বরযাত্রীর সাথে চলে যাই। পরে একবার সত্যি সত্যি অমন লঞ্চে করে ঐ রুটেই বরযাত্রী যাবার সুযোগ হয়েছিল। হাবিবউল্লাহ মামার বিয়েতে আমরা লঞ্চে সৈয়দপুর পর্যন্ত লঞ্চে করে গিয়েছিলাম। আমরা অবশ্য গোটা লঞ্চ ভাড়া নিতে পারিনি। তবে আমাদের ফূর্তির অত্যাচারের চোটে লঞ্চের বাকি যাত্রীদের কেউ কেউ আমাদের সাথে সম্মিলিত গানবাজনায় যোগ দিয়েছিলেন, বাকিরা শাপশাপান্ত করেছেন। সেবার সৈয়দপুর পৌঁছাতে শেষ বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সৈয়দপুরে পৌঁছে ক্ষিধেয় কাতর বরযাত্রীর দল দেখল আশেপাশে বনরুটি আর কলা ছাড়া খাবার কিছু নেই। অগত্যা তাই সই। আমরা রুটি-কলা খাবার সময় একদল কাক আমাদেরকে আক্রমণ করল। একটা কাক আমার হাত থেকে রুটি ছিনিয়ে নিতে আমি চীৎকার করে উঠলাম। সদাশয় বড় মামা তাঁর ভাগের রুটিটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেবার লঞ্চ থেকে নেমে কালীগঙ্গা নদী ধরে নৌকায় কিছু দূর গিয়ে তারপর অন্ধকারে আলপথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে আমার বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। কুয়াশার মোড়কে মোড়া অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎ হ্যাজাকের আলোয় উদ্ভাসিত উৎসবমুখর এক বিয়ে বাড়ি আমাদের সামনে হাজির হয়।
বড় মা'র বাড়ি যেতে গাবের পাড়া নামার পরে কোষা নৌকা করে দুই দফা দুটো নদী পাড় হতে হতো। তারপর ক্ষেতের আল ধরে হাঁটা। নৌকা থেকে নামলে দূরে উঁচু একটা ভিটিতে দুটো ন্যাড়া শিমুল গাছ দেখা যেত। শীতের শেষে গেলে সেই গাছে অল্পস্বল্প ফুল দেখা গেলেও আমরা সাধারণত যে সময়ে যেতাম সেসময়ে গাছদুটো নিষ্পত্র থাকতো। উঁচু ভিটিটা ছিল আসলে একটা ছোট গোরস্থান। সেখানে বড় বাবা শুয়ে আছেন যিনি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, ফিকশন-নন্ ফিকশন লেখক, সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈনিক হয়ে যুদ্ধও লড়েছিলেন। বেড়ানোর নামে আমরা আসলে যেতাম তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। নৌকা থেকে নেমে ক্ষেতের আল ধরে যেতে কোথাও মটরশুঁটি, কোথাও কলাই, কোথাও সর্ষে, কোথাও লাল শাক, কোথাও টমেটো বা কোথাও কাঁচা মরিচের ক্ষেত দেখা যেত। রঙের বৈচিত্র্যে আদিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেতগুলোকে এক বিশাল রঙিন ক্যানভাসের মতো লাগতো। আমরা চলতি পথে এক মুঠো মটরশুঁটি, একটা পাকা টমেটো বা দুটো লাল মরিচ তুলে নিতাম। বড়রা সেটা দেখলে আবার হৈ হৈ করে উঠতেন না বলে অন্যের জিনিস নেবার অপরাধ ঠেকানোর জন্য। কোন কোন ক্ষেতে ফসল থাকতো না, সেখানে গম্বুজের মতো করে খড়ের গাদা বানানো থাকতো আর চারপাশে রাশি রাশি খড় রোদে শুকানোর জন্য রাখা থাকত। এমন ক্ষেত ছিল আমাদের সবচে প্রিয় কারণ, খড়ের গাদায় লাফানো বা ডিগবাজি দেবার সাথে তুলনীয় মজার কোন কাজ ছিল না। সর্ষে ক্ষেত দেখতে ভালো লাগলেও সেখান থেকে ছোট ছোট কালো রঙের পোকা আক্রমণ করত। বিশেষত কারো গায়ে হলুদ বা সবুজ রঙের পোশাক থাকলে তো কথাই নেই।
বড়মা'র বাড়ির অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষণ ছিল বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসা রাবিয়া বু'জি বা জায়েদা বু'জির বলা গল্প। সেই গল্পগুলো হতো হয় খুব দুঃখের অথবা সত্যিকারের ভূতের। মাঝে মাঝে তারা লোক ঠকানো 'ট্যাটনা'র হাসির গল্পও বলতেন। রাত গাঢ় হলে হ্যাজাকের আলোয় খোলা উঠোনে খড় পেতে গানের আসর বসত। গায়ক মূলত বুধাই নানা আর নসু নানা। মারফতী, বিচ্ছেদী আর নৌকাবিলাস গান। এগুলোর মানে কী বা এগুলোর পার্থক্য কী তার কিছু বুঝতাম না। আমার ভারি ইচ্ছে করত দোতারা বাজাতে। কিন্তু দোতারাতে হাত লাগানোর সুযোগই কখনো পাইনি। বড়মা বিশেষ রান্নাবান্না করতে পারতেন না, তবে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা অদ্ভুত খাবার রান্না করতেন। তার একটা হচ্ছে 'জালার জাউ'। নতুন ধানকে মাটির ঘটে আধভেজা অবস্থায় কয়েকদিন ঢেকে রেখে অল্প অঙ্কুরোদ্গম ঘটানো হতো। সেই গেঁজওঠা ধান কাহাইল-ছিয়া দিয়ে কুটে অঙ্কুরসহ আধভাঙা চাল বের করে ভারি, আঠালো, লাল-সাদা রঙের জাউ রান্না করা হতো যা ঝোলা গুড় দিয়ে খেতে হয়। কেউ কেউ আবার গুড়ের বদলে শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, রশুন বাটা ভর্তা দিয়ে খেতেন। সেই জাউয়ের একটা অপার্থিব গন্ধ-স্বাদ ছিল। সেটাকে মোটা দাগে ভালো বা খারাপ বলার উপায় নেই। যার নাকে সেই গন্ধ লাগেনি বা যার জীভ সেই স্বাদ পায়নি তাকে সেটা বোঝানো সম্ভব না। আমার ভালো লাগতো যদি বড়মা কখনো 'চৈ পিঠা' বানাতেন। চৈ পিঠা হচ্ছে চালের গুঁড়ি মাখিয়ে বানানো মোটা মোটা নুডলস যা খেজুরের রস, দুধ আর কোরানো নারকেল জ্বাল দিয়ে বানানো ঘন ঝোলে রান্না করা হতো। রসের সাথে দুধ আর নারকেলের স্বাদ-গন্ধ মিলে আরেক অপার্থিব জিনিস তৈরি হতো। বড়মা'র বাড়ি থেকে ফিরতে বিশেষ কষ্ট লাগতো না। কেন যেন সেখানে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠতাম। আসলে মৃত্যুবার্ষিকী বা ওরসের আয়োজন শেষ হয়ে গেলে একজন নিঃসঙ্গ, অতি বৃদ্ধার জনহীন সংসারে ঐ বয়সী কারো ভালো লাগার কিছু অবশিষ্ট থাকতো না।
এক অঘ্রাণের দিনে হাবিবউল্লাহ মামার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পথে লঞ্চের জন্য সৈয়দপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় ঢাকা থেকে আগত একটা লঞ্চ এলো। হিসেব অনুযায়ী লঞ্চটা মিনিট দশেকের বেশি দাঁড়ানোর কথা না, কিন্তু কী কারণে যেন লঞ্চটা তারচেয়ে বেশি সময় দাঁড়িয়ে রইল। যেহেতু লঞ্চটা আমার অদেখা কলাকোপা বান্দুরার দিকে যাচ্ছে তাই আমি সেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ লঞ্চের একতলাতে নীল ব্রোকেডের জামাপরা এক বালিকা আমার কিশোর বুকে ঘাই মারলো। আমি নির্বাক, নিশ্চল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে কি প্রথমেই আমাকে দেখতে পেয়েছিল? জানি না। সে তার সাথে থাকা গোলাপী ব্রোকেডের জামাপরা আরেকটা মেয়েকে আমার দিকে হাত তুলে কী যেন দেখাচ্ছিল – নিশ্চয়ই আমাকে না! গোলাপী ব্রোকেড সম্ভবত তার ছোট বোন। হঠাৎ তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। আমার মনে হলো সারা পৃথিবীর বিষণ্ণতা যেন তার দু'চোখে ভর করেছে। আমরা কেউই চোখ ফিরিয়ে নিলাম না। ঠিক এই সময়ে লঞ্চটা চলতে শুরু করলো। লঞ্চটা একটু পিছিয়ে ডানে মোড় নিয়ে গতির দিক ঠিক করতে লাগল। নীল ব্রোকেড আমার চোখের আড়াল হতে লাগলো। দেখলাম সে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে স্টেশনের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে। বিষণ্ণনয়না নীল ব্রোকেডকে বহনকারী লঞ্চটা আস্তে আস্তে আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে স্বপ্নের দেশের দিকে চলে গেল।
আজকাল কলাকোপা বান্দুরাতে কোন লঞ্চ যায় না, বাসে করে বা গাড়ি চেপে যাওয়া যায়। আমার আর লঞ্চে করে সেই স্বপ্নের দেশে যাওয়া হলো না - বিষণ্ণনয়না নীল ব্রোকেডের সন্ধানও এই জীবনে আর পাওয়া হলো না।
- ১২ নভেম্বর ২০২০