মহামারিতে ‘জৌলুস হারিয়েছে’ ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং তার পুরোনা ঐতিহ্য হারালেও এখনো অনেক চলচ্চিত্রকার, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা সময় পেলেই সেখানে চলে যান। হৈ-হুল্লোড় আর আড্ডায় মেতে উঠেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ স্থানটি তার পুরানো 'জৌলুস' হারিয়েছে। এখন আর সেখানে আগের মত আড্ডার চিত্র দেখা মেলে না।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বিউটি বোর্ডিং গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এরপর গত ৭ জুলাই থেকে ফের এটি চালু করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেখানে এখনো ভোজনরসিকদের পদচারণা খুবই কম।
বিউটি বোর্ডিংয়ের পরিচালক সমর সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। কবি-সাহিত্যিকরা এখন খুব কম আসেন। ব্যবসাটা কিভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সেটাই ভাবছি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরাও এখন আর আসেন না। বর্তমানে মাসে দু-একটা টিভি অনুষ্ঠানের দৃশ্য হয় এখানে। আগে যেখানে সাত-আটটা হতো।
সমর সাহা জানান, করোনার সংকটে পড়ে তিনি সাধারণ ছুটি শেষে ব্যবসা চালু করার জন্য ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। ছয় জন কর্মী ছাঁটাই করেছেন। বাকি যারা রয়েছেন, তাদের অর্ধেক বেতন দিচ্ছেন। এ ছাড়াও সংকটে পড়ে বন্ধুদের কাছ থেকে তিনি ৫০ হাজারেরও বেশি টাকা ঋণ করেছেন।
'করোনার আগে দৈনিক ১০০ এর মত লোকজন আসতেন। এখন ১৫-২০ জন আসেন। মাঝেমধ্যে সংখ্যা দশে নেমে আসে। খুব নাজুক অবস্থায় আছি। যাদের ছাঁটাই করেছি, তোমরা আপাতত অন্য কাজ করো। কোনোরকমে বাঁচো। পরিস্থিতি ভালো হলে আমিই তোমাদের আবার ডাকব,' যোগ করেন সমর।
বিউটি বোর্ডিং আধুনিকতার উত্থানে পিছিয়ে পড়া এক ঐতিহ্য। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে লোকসান গুণতে হচ্ছে জানিয়ে সমর সাহা বলেন, দিনের পর দিন লোকসান দিয়েও শুধু ঐতিহ্য ধরে রাখতেই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রেখেছি। অনেকেই জানেন আমাদের সমস্যার কথা। কিন্তু কেউ একটি টাকা দিয়েও আমাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি।
সম্প্রতি এক দুপুরে বিউটি বোর্ডিং গিয়ে দেখা হয় সেখানে খেতে আসা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ রহমানের সঙ্গে। তিনি তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সে সময় দুপুরের খাবার খেতে এসেছেন।
তিনি মনে করেন, পুরান ঢাকার শ্রীশচন্দ্র লেনের হলুদ রঙা দোতলা বাড়িটি শুধু আবাসিক হোটেলই নয়। আর বলেন, 'এদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির ইতিহাসের সাক্ষী এই বিউটি বোর্ডিং। কালের স্রোতে ঢাকার বিস্তৃতি বেড়েছে, বিপরীতে নিষ্প্রাণ হয়েছে বিউটি বোর্ডিং।'
বোডিং ঘুরে দেখা গেছে, খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে প্রাচীন আড্ডার কয়েকটি ছবি। এরপর শোবার ঘর, পেছনে সিঁড়িঘর-অনেকটা প্রাচীন জমিদার বাড়ির বর্ণনার মতো। আঙিনার এক কোণে কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতিফলক। একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধে ১৭ জন শহীদের নামফলক।
গত শতকের চল্লিশের দশকে বাংলাবাজারকে ঘিরে গড়ে উঠে প্রকাশনা শিল্প। সেখানকার নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের বাড়িটিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগে সাপ্তাহিক 'সোনার বাংলা' পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়ই। ভারত ভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়িতে গড়ে তোলেন আবাসিক ও খাবার হোটেল।
বিউটি বোর্ডিংয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে কক্ষ রয়েছে ২২টি। একমাত্র বড় রুমের ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা আর সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে।
স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বেশির ভাগ কক্ষই এখন খালি থাকে জানিয়ে সমর সাহা টিবিএসকে বলেন, 'রুম তো ২২ টা তারমধ্যে ১০টা অকেজো। না খুলতে খুলতে ওই ১০টি রুম থেকে এখন বাজে গন্ধ বের হচ্ছে। এই জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও কোনো এক কারণে আমাদের পাশে কেউ নেই।'
মূলত চল্লিশের দশকেই পুরান ঢাকায় খ্যাতি লাভ করে বিউটি বোর্ডিং। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ এখানে আসতেন। এসেছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন আর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান এখানে বসেই লিখেছিলেন বাংলার প্রথম সবাক ছবি 'মুখ ও মুখোশ'-এর পাণ্ডুলিপি। জাদুকর জুয়েল আইচের সূচনাও এখানেই। আর সুরকার সমর দাস বহু গানের সুর তৈরি করেছেন এখানে বসে। ১৯৫৭ সাল থেকে ৬২ সাল পর্যন্ত এখানে বসেই লেখালেখি করতেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।