বম নারীদের বোনা শীতের পোশাক ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড় ছাড়িয়ে
কোমড় তাঁতে কাপড় বুনে পরিবারে বাড়তি আয় করে স্বচ্ছলতা ফেরাচ্ছেন বান্দরবানে বম জনগোষ্ঠীর নারীরা। তাদের প্রত্যেক ঘরে কেউ না কেউ কোমড় তাঁতে কাপড় বুনছেন সারা বছর। এখন এই শীতের মৌসুমে নানা রঙের সূতায় কোমড় তাঁতে তৈরি হচ্ছে শীতের কাপড় কম্বল, মাফলার ও চাঁদর।
শীত মৌসুম আসলেই দোকানিরা পাইকারী দরে কাপড় সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করেন। সংগৃহীত কাপড় তারপর চলে যায় বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও শহরের মার্কেটগুলোয়। কিছু চলে যায় ঢাকায়। স্থানীয়ভাবে বিক্রি হলেও, এসব পণ্যের বড় ক্রেতা বেড়াতে আসা পর্যটকরাই, তারাই আগ্রহ নিয়ে কোমড় তাঁতের কাপড় কেনেন।
বান্দরবান সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান লাইমি পাড়া ও ফারুক ফাড়া। এ দুই পাড়ায় মূলত বম জনগোষ্ঠীর দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস। এই শীত মৌসুমে ঘরে ঘরে বম নারীরা বুনছেন কোমড় তাঁত। তৈরি করছেন ছোট বড় সাইজের বিভিন্ন মানের কম্বল, মাফলার ও চাঁদর।
পার্বত্য অঞ্চলে আগে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব আদলে কোমড় তাঁত বুনলেও, শুধু বম নারীরা এর ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন। কোমড় তাঁতে শীতের কাপড় বুনে, পরিবারের বাইরে বিক্রি করে বাড়তি আয়ের পথ করে নিয়েছেন তারা।
লাইমি পাড়ার বাসিন্দা জিংরুন বম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানান, একটি বড় চাঁদর তৈরি করতে দুই দিন লাগে। এ রকম বড় চাঁদর সপ্তাহে ৩টি বানানো যায়। ওই বড় চাদর থেকে আবার দুটা বানানো হয়। পরে পাইকার ব্যবসায়ীরা প্রতিটি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকায় সংগ্রহ করেন।
'এক কেজি সূতাতে দুইটা চাঁদর বানানো যায়। এক কেজির সূতার দাম পড়ে দেড় শ টাকা। সবকিছু মিলে মাস শেষে একটি সংসার চালানোর মতো আয় হয়,' বলেন তিনি।
একই পাড়ার বাসিন্দা জিংলিম ময় বম জানান, কোমড় তাঁত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কম্বল তৈরি করছেন। তার কাছে বড় ও পাতলা দুই ধরনের কম্বলই পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, 'দুই কেজি সূতায় একটি বড় কম্বল হয়। সময় লাগে তিনদিন এবং দেড় কেজি সূতায় দিয়ে হয় একটি পাতলা কম্বল। সেটা বানাতে লাগে দুইদিন। পরে সেগুলো পাইকারী দামে বিক্রি করা হয়।'
অনেক দিন ধরেই ঘরে সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে কোমড় তাঁত দিয়ে মাফলার তৈরি করে আসছেন রোয়াল সিংনেম বম ও ফ্লোরি বম।
তারা জানান, টানা কাজ করতে পারলে দৈনিক তিনটা করে মাফলার বানানো যায়। কাজের ফাঁকে সারা বছরই মাফলার বানিয়ে থাকেন তারা। অন্যান্য সময় মাফলারের চাহিদা কম থাকায় শীতে বিক্রির জন্য জমিয়ে রাখা হয়। শীত এলে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়।
কোমড় তাঁতে বানানো শীতের কাপড়সহ অন্য কাপড় পাইকারী দরে কিনে নিয়ে বিক্রি করছেন বম নারীরাই। তারা নিজেরা কাপড় না বুনে পাইকার হিসেবে কাজ করেন।
এদের অনেকেই আবার পর্যটন কেন্দ্র শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড় ও নীলাচলে খুপরি দোকান সাজিয়ে খুচরাও বিক্রি করেন। এছাড়া কোমার তাঁতের পণ্য কম্বল, মাফলার ও চাঁদর শহরের বিভিন্ন বার্মিজ মার্কেট ও দোকানেও পাওয়া যায়।
শৈলপ্রপাতে দোকানি লিলি বম ও জিংসিয়াম কিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ১৩০ টাকায় কেনা মাফলার ১৫০ টাকা ও ৩৫০ টাকায় কেনা চাঁদর ৪০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। পর্যটক বেশি হলে বিক্রিও বেশি হয়ে থাকে। মূলত পর্যটকদের ঘিরে কোমড় তাঁতে বানানো শীতের কাপড়ের ব্যবসা জমে ওঠে, জানান তারা।
লাইমি পাড়ার ৮৬ পরিবারে প্রত্যেকের ঘরে কেউ না কেউ কোমড় তাঁত দিয়ে শীতের কাপড় তৈরি করে জানান পাড়ার কার্বারী (গ্রাম প্রধান) হাওলিয়ান বম।
তিনি বলেন, বম সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা খুবই পরিশ্রমী হয়ে থাকেন। তারা সারাবছর বাগান ও ক্ষেত খামারেও কাজ করেন। এর বাইরে প্রায় সব বম নারীই কোমড় তাঁতে কাপড় বানাতে পারদর্শী।
কোমড় তাঁতের কারণে পরিবারে বাড়তি আয় যোগ করেছেন বম নারীরা। লাইমি পাড়ার পাশে ফারুক পাড়া, সদর উপজেলা হেবরন পাড়া, রুমা এবং রোয়াংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন বম পাড়াতে এখনো কোমড় তাঁতের কাপড় তৈরির রেওয়াজ চালু রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে বম সমাজের নারীদের কোমড় তাঁত বুনে পরিবারে বাড়তি আয়ের যোগানকে ইতিবাচক দিক বলে মনে করছেন জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আতিয়া চৌধুরী।
মহিলা উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য ৫ শতাংশ সুদে ১৫ হাজার পর্যন্ত ব্যক্তিগত ঋণ দিয়ে থাকেন তারা, জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগত ঋণকে পঁচিশ হাজার পর্যন্ত করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে নিবন্ধিত সদস্যদের জন্য মেঘলা পর্যটনের পাশে একটি মার্কেট তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিবন্ধনভুক্ত সদস্যরা নিজেদের উৎপাদিত যে কোনো জিনিস বিক্রি করতে পারেন।
এছাড়া এলাকাভেদে টেইলারিং, হস্তশিল্প, তাঁত, চটের ব্যাগ তৈরিসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে মহিলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে হয়েছে বলে জানান জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে সরকারি এই কর্মকর্তা।