রেনেসাঁ যুগের নারী চিত্রশিল্পীদের অন্বেষণ: তারা হারালেন কোথায়?
ইউরোপ ভ্রমণে গেলে শিল্পপ্রেমিকেরা একটিবার হলেও ইতালির ফ্লোরেন্সে আসবেন। উফিজির আর্ট গ্যালারিতে ঢুঁ মারলে দর্শকেরা মন ভরে দেখতে পাবেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলো ও রাফায়েলের মতো রেনেসাঁ যুগের অন্যান্য চিত্রশিল্পীর কাজ।
অবশ্য এদের কেউই নারী নন। নারী চিত্রশিল্পীদের কথা কোথাও উল্লেখ নেই; নারীদের কাজ চোখে পড়ে না জাদুঘরের দেয়ালে।
২০০৯ সালে, ফ্লোরেন্সের এক অলাভজনক ফাউন্ডেশন এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।
অ্যাডভান্সিং উইমেন আর্টিস্ট (এডব্লিউএ) সংগঠনের পরিচালক লিন্ডা ফ্যালকন বলেন, 'আমি জাদুঘরের স্টোরেজ এবং চিলেকোঠায় ঢুঁ মারতে শুরু করলাম এ আশায়, সেখানে নারী শিল্পীদের তৈরি কী কী কাজ আছে, তা খুঁজে দেখব। এটা নিয়ে আগে কখনোই কেউ ভাবেনি; কেউ জানতে চায়নি, সেই নারীরা আসলে গেলেন কোথায়?'
এ সংগঠনের এমন উদ্যোগের পর ইতালির জাদুঘর এবং পুরনো ও স্যাঁতসেতে গির্জায় নারী শিল্পীদের প্রায় দুই হাজার কাজ খুঁজে পাওয়া যায়! সেই শিল্পীরা, যাদের কেউ মনে রাখেনি!
এডব্লিউএ শুধু খুঁজেই ক্ষান্ত থাকেনি, ১৬ থেকে ২০ শতকে আঁকা ৭০টির মতো চিত্রকর্ম পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকান সমাজসেবী জেন ফরচুন ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিখুঁত এক শিল্পবোদ্ধা ও অনুসন্ধানী। রেনেসাঁ যুগের শিল্প ও চিত্রকর্ম অনুসন্ধানের এই অভিযানের জন্য কাছের বন্ধুদের কাছে তিনি 'ইন্ডিয়ানা জেন' নামেও পরিচিত ছিলেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ইতালিতে নারী চিত্রশিল্পীদের একাডেমিক ভবনে প্রবেশের অনুমতি ছিল না।বহু শিল্পীর তাই নামই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
লিন্ডা ফ্যালকন বলেন, 'রেনেসাঁর সময়ে নারীদের নাগরিকত্ব ছিল না। তারা শুধু পেশা হিসেবে শিল্পচর্চা বেছে নেবেন, সেই সুযোগ ছিল না। নিজে থেকে কোনো মূল্যতালিকা বা রশিদ চালান করতে পারতেন না। এনাটমি (শারীরসংস্থাবিদ্যা) পড়া ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ।'
'শুধু নারী বলেই যে ক্যানভাসে নগ্নতার প্রদর্শন তাদের জন্য সে সময় অনুপযুক্ত হিসেবে গণ্য হতো তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরুষ শিল্পীদের মানবদেহ বোঝবার যে সুযোগ ছিল, নারীরা সেটি থেকেও বঞ্চিত ছিলেন।'
তবু কিছু শিল্পী নিজ প্রচেষ্টায় চিত্রচর্চা চালিয়ে যান। তাদের অনেকেই বাবার স্টুডিওতে ছবি আঁকা অব্যাহত রাখেন। ১৭ শতকের চিত্রকর ওরাজিও জেন্টিলেশির কন্যা আর্তেমিসিয়া জেন্টিলেশির নাম এখানে উল্লেখ্য।
এডব্লিউএ আর্তেমিসিয়ার ডেভিড ও বাথসেবা চিত্রকর্মের পুনরুদ্ধারেও কাজ করেছে। ৩০০ বছরেরও বেশি সময় এটি গুপ্ত ছিল।
তবে সংস্থাটির অন্যতম বড় আবিষ্কার লাস্ট সাপার- নারী অঙ্কিত 'লাস্ট সাপার'। ২১ ফুট লম্বা ক্যানভাসে আঁকা রীতিমতো মানবাকৃতির চিত্রকর্মটি ষোড়শ শতকের ডমিনিকান নান প্লতিলা নেলির আঁকা। এই মাস্টারপিস চিত্রকর্ম পাওয়া যায় ফ্লোরেন্সের এক অখ্যাত মঠে।
ফ্যালকন বলেন, ফ্লোরেন্সের চিত্রকরদের কাছে লাস্ট সাপারের ছবি আঁকা রীতিমতো ঐতিহ্যের সামিল।
'তবে নেলির ছবিটি অনন্য। তিনি সেই সময়ের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন, যখন যিশু তার বিশ্বাসঘাতকের নাম বলবেন। সেই মুহূর্তের আবেগ আপনারা নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারছেন। যেহেতু নেলি এমন এক সময়কে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, ধরেই নেওয়া যায়, তার মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝার এবং মনস্তাত্ত্বিক আচরণ ফুটিয়ে তোলার মতো সক্ষমতা ছিল।'
'আবার, অন্যান্য পুরুষ শিল্পীর তুলনায় ব্যতিক্রমভাবে নেলি তার সাপারের চিত্রকর্মটিতে খাবারের ছবি এঁকেছেন,' যোগ করেন লিন্ডা।
'লেটুস, লবণের চিমনি, ওয়াইনের সারি, রুটি, শিমের বীজ, ল্যাম্ব থেকে শুরু করে ছুরি-কাঁটাচামচ... সমস্তই তিনি একেঁছিলেন। মানুষের খাবারের সময়ে এবং খাবারের টেবিলে সহজাতভাবে যে খাবার থাকে, এটিই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেলি তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই সারল্যের জন্যই যেন ছবিটি অনন্য।'
কোনো পুরুষ চিত্রশিল্পী যা কখনো করবেন না, নেলি সেটিও করেছেন- ক্যানভাসে লিখে গেছেন, 'চিত্রশিল্পীকে আপনাদের প্রার্থনায় রাখুন।'
ষোড়শ শতকে এই নানের কাজ প্রশংসিত হয়েছিল; কেননা ফ্লোরেনটাইনরা ভেবেছিলেন, এই চিত্রকর্ম আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। তার সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জিয়র্জিও ভাসারি বলেছিলেন, 'পুরুষের মতো সুযোগ-সুবিধা এবং ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান লাভ করলে তার কাছ থেকে পৃথিবী আরও দারুণসব ছবি উপহার পেত।'
আমেরিকান বংশোদ্ভুত শিল্প সংরক্ষক এলিজাবেথ উইকস বলেন, 'ফলাফল কী হলো? অন্য নারী শিল্পীদের মতো নেলিও আজ বিস্মৃত।'
'১৯ শতকের মাঝামঝি সময়ে এসব নারী চিত্রশিল্পী এবং তাদের কাজ নিয়ে বোধহয় তখনকার গাইডবুকগুলোতে উল্লেখ করাই বন্ধ হয়ে যায়। নারীদের প্রসঙ্গও তোলা বন্ধ হয়ে যায়। কাউকে নিয়ে যখন কোথাও কোনো চিহ্ন থাকছে না, এক সময় সে যে সময়ের আবর্তে হারিয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক', যোগ করেন এলিজাবেথ।
অ্যাডভান্সিং উইমেন আর্টিস্ট সংগঠনের সমর্থনে এলিজাবেথ এখন অষ্টাদশ শতকের ভিওলান্তে ফেরোনির দুটি বড় ছবি পুনরুদ্ধারের কাজ করছেন। প্রডিজি এই শিশু চিত্রকরের খুব কম তথ্যই পৃথিবীর জানা।
তাকে নিয়ে করা গবেষণায় জানা যায়, ফেরোনি জন্মেছিলেন ১৭২০ সালে। ফ্লোরেন্স তখন ব্যাপক সমাজতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
লেখক ও গবেষক এয়ান গোলব বলেন, এ কারণে সে সময়ে নারীরা অনেকটাই নিজেদের আলোকিত করে তুলতে পেরেছিলেন এবং স্বল্প পরিসরে তারা কাজের মাধ্যমে খ্যাতি লাভও শুরু করেছিলেন।
নারী চিত্রশিল্পীরা মূলত স্থিরচিত্র এবং ছোটখাট প্রতিকৃতিচিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। ফেরোনির বয়স তখন বিশের কাছাকাছি। অইটুকু বয়সে কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই ফেরোনি ফ্লোরেন্সের এক হাসপাতালের উদ্যোগে আট বাই সাড়ে এগার ফুট মাপের দুটি ডিম্বাশয়ের চিত্র এঁকে ফেলেন। উদ্দেশ্য ছিল, নিছক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাহায্য করা। এ বিষয়ে তখনো পুরুষদের হস্তক্ষেপের অনুমতি ছিল না।
এলিজাবেথ মনে করেন, করোনাভাইরাসের প্রাক্কালে এসব চিত্রকর্ম পুনরুদ্ধারে বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
'এই প্রকল্পে কাজ করাটা রীতিমতো টনিকের কাজ করেছে। আমি শুধু ওই কাগজে আঁকা চিত্রগুলো পুনরুদ্ধার করছিলাম না, বরং এ কাজের মাধ্যমে নিজেকেও এই মহামারির অস্থির সময়ে পুনরুজ্জীবিত করেছি।'
'প্রকৃত পক্ষে শিল্প একটি জীবন্ত সত্তা এবং এক টুকরো শিল্পের মাঝেও প্রাণ রয়েছে। এটি আঘাত পায়; এর ক্ষতিসাধন হয়। একেও নবজীবন এনে দিতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, একে গুরুত্ব দিতে হয়।'
লিন্ডা ফ্যালকন বলে, এই পুনরুদ্ধার কাজ, ডকুমেন্টেশন এবং প্রদর্শনীর মাধ্যমে এডব্লিউএ বিশ্বব্যাপী নারীদের শিল্পের প্রতি আগ্রহ এবং সচেতনতায় অবদান রাখছে। তবে পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে সংস্থাটির পক্ষে দীর্ঘদিন কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সামনের জুনেই এটিকে বন্ধ ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
ফ্যালকন আনন্দের সঙ্গে বলেন, 'এ সংস্থার উদ্দেশ্যটি আমরা মোটামুটি অর্জন করতে পেরেছি।'
'এটি সত্যিই বিজয়; কেননা, আমরা আজ এমন এক পর্যায়ে এসেছি, যখন জাদুঘরগুলো নারী চিত্রকরদের নিয়ে ভাবছে, তাদের আঁকা শিল্পকর্ম প্রদর্শনে উৎসাহী হচ্ছে,' বলেন তিনি।
এখন শুধু একটি নির্দিষ্ট সংস্থা বা গোষ্ঠী নয়, খোদ শিল্পঅনুরাগীরাই প্রশ্ন তুলছেন, 'সত্যিই তো, কোথায় হারালেন নারী চিত্রশিল্পীরা?'
এনপিআর থেকে অনুবাদ: মেহজাবিন তুলি