দেশের পর ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্যামসাং পণ্য নিয়ে বিশ্ববাজারে ফেয়ার গ্রুপ
দুবছর আগেও বাংলাদেশে স্যামসাং ব্রান্ডের মোবাইল সেট মানেই ছিল মেইড ইন চীন, ভিয়েতনাম অথবা সাউথ কোরিয়া। আর এখন বাজারে দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেকট্রনিক জায়ান্ট স্যামসাংয়ের সব সেটই 'মেইড ইন বাংলাদেশ'। নরসিংদীর শিবপুরে ফেয়ার গ্রুপের কারখানায় এখন তৈরি হচ্ছে স্যামসাংয়ের Galaxy Note 20 Ultra, and Note 20 মতো ৫জি ফ্ল্যাগশিপ সেটও।
'মেইড ইন বাংলাদেশ' ট্যাগ লাগানো স্যামসাংয়ের মোবাইল সেট এখন রপ্তানি হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও। ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব জানালেন, 'পরীক্ষামূলকভাবে দুবাইতে কিছু স্যামসাং হ্যান্ডসেটে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া গেছে।'
দুবাইতে স্যামসাংয়ের রেফ্রিজারেটর রপ্তানি করেও ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে ফেয়ার গ্রুপ। ফেয়ারের অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্টে তৈরি স্যামসাং পণ্য আগে শুধু বাংলাদশের বাজারে বিপননের অনুমতি থাকলেও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায় এখন রপ্তানির অনুমোদনও মিলেছে।
দেশের বাজারের মতো রপ্তানিতেও বড় সম্ভাবনা দেখছে ফেয়ার গ্রুপ। রুহুল আলম আল মাহবুব জানান, ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত সাত রাজ্য, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় মেইড ইন বাংলাদেশ স্যামসাং পণ্য বড় বাজার হতে পারে।
সাউথ এশিয়া ফ্রি ট্রেড এরিয়া, সাফটাসহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য রপ্তানিতে এসব দেশে শুল্ক সুবিধা পাওয়া গেলে অল্প সময়েই বড় আকারের রপ্তানি সম্ভব বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন তিনি।
এজন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যকে যুক্ত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে ফেয়ার গ্রুপ।
দেশের ভেতরে ও বাইরে স্যামসাং পণ্যের বিপুল চাহিদা মেটাতে বিনিয়োগও বাড়াচ্ছে ফেয়ারগ্রুপ। চলতি মাসেই (জানুয়ারি) শিবপুরের কারখানায় মোবাইল ফোনের মাদারবোর্ড তৈরির প্ল্যান্ট চালু করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
রুহুল আলম আল মাহবুব জানান, 'পুরো প্ল্যান্ট রেডি। আমরা এনবিআরকে অনুরোধ করেছি, প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে উৎপাদন শুরুর অনুমোদন দিতে। এই প্ল্যান্টে উৎপাদিত মাদারবোর্ডে তৈরি মোবাইল ফোন মধ্য জানুয়ারিতেই বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা।'
প্রায় ৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগের এই প্ল্যান্টে রেফ্রিজারেটর ও টেলিভিশনের মাদারবোর্ড তৈরির মেশিনারিও বসানো হয়েছে। মোবাইল সেটের পর এই দুটি স্যামসাং পণ্যও বাংলাদেশে উৎপাদিত মাদারবোর্ডে তৈরি হবে। দেশে উৎপাদিত মাদারবোর্ড ব্যবহার করলে দেশে স্যামসাং পণ্যের উৎপাদন খরচ ও দাম কমবে।
কেবল ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যই নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার আরেক জায়ান্ট হুন্দাই মোটরসের একমাত্র পরিবেশক ও ডিস্ট্রিবিউটর ফেয়ার গ্রুপ বাংলাদেশে হুন্দাই প্যাসেঞ্জার কারের অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্টও স্থাপন করতে যাচ্ছে।
কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কে হবে এই প্ল্যান্ট। এজন্য জমি বরাদ্দ নিয়ে ৫ জানুয়ারি হাইটেক পার্ক অথরিটির সঙ্গে চুক্তি হবে ফেয়ার গ্রুপের।
স্যামসাংয়ের ওয়াশিং মেশিন উৎপাদনের প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে ফেয়ার গ্রুপ। ২০২১ সালেই দেশের বাজারে পাওয়া যাবে স্যামসাংয়ের মেইড ইন বাংলাদেশ ওয়াশিং মেশিন।
ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব জানান, ভিয়েতনাম থেকে প্রতিবছর ৫৫-৬০ বিলিয়ন ডলারের স্যামসাং পণ্য রপ্তানি হয়। ব্যবসার পরিবেশ সহজ করা গেলে বাংলাদেশ থেকেও এ পরিমাণ স্যামসাং পণ্য রপ্তানি সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের সরাসরি বিনিয়োগের ব্যাপারেও আশাবাদী তিনি। স্যামসাং কোরিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেশে দীর্ঘমেয়াদী করনীতি থাকা উচিত বলে মনে করেন রুহুল আলম মাহবুব।
তিনি বলেন, 'আমরা যখন মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট স্থাপন করি, তখন হ্যান্ডসেটে ভ্যাট ছিল শূন্য শতাংশ। পরের বছর যখন উৎপাদন শুরু করি, তখন হঠাৎ করেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে অনেক দৌড়ঝাঁপের পর ভ্যাট ৫ শতাংশে নামানো হয়। এভাবে হঠাৎ করেই কর-ভ্যাট আরোপ করলে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো তো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আস্থা পাবে না।'
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারিদের ফেভারেবল পলিসি সাপোর্ট ও অবকাঠামো সুবিধা দিতে হবে। শুধু সস্তা জনশক্তি দিয়ে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে না। আর প্রযুক্তি খাতে খুব বেশি জনবলের দরকারও হয় না।
'ফেয়ার বিজনেস প্রাকটিস' নীতিতে চলা ফেয়ার গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পর এক যুগেই বাংলাদেশে ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ফেয়ার গ্রুপ। ২০১৪ সালে স্যামসাং মোবাইলের ন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউটরের দায়িত্ব পায়। স্যামসাংয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ২০১৭ সালে দেশে প্রথমবারের মতো নরসিংদীর শিবপুরে সামস্যাংয়ের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট তৈরি করে ফেয়ার গ্রুপ।
২০১৮ সালে এই প্ল্যান্ট থেকে স্যামসাংয়ের সিকেডি মোবাইল সেট বাজারে আসে। তার আগেই অবশ্য বাজারে আসে স্যামসাংয়ের রেফ্রিজারেটর। ২০২০ সালে টেলিভিশন ও এয়ারকন্ডিশনার উৎপাদন শুরু করে ফেয়ার গ্রুপ। আর এবছর বসতে যাচ্ছে ওয়াশিং মেশিনের প্ল্যান্ট।
ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের ডিরেক্টর অব সেলস মো. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, ফেয়ার গ্রুপে বর্তমানে তিন হাজারেরও বেশি জনবল কাজ করছে। এর মধ্যে কারখানায় সরাসরি কর্মসংস্থান ১৬০০ জনের। বাকিরা অফিস, ওয়্যারহাউজ, সেলস সার্ভিসে নিয়োজিত।
কারখানায় নিয়োজিতদের বড় অংশই হাইস্কিল্ড ইঞ্জিনিয়ার। চালুর অপেক্ষায় থাকা মাদারবোর্ড প্ল্যান্টে প্রায় ৫০ জন হাইস্কিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের কর্মসংস্থান হবে বলে জানান মেজবাহ।
জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম এবং বিপুল পরিমাণ তরুণ জনশক্তিতে ভরপুর দেশ। বর্তমানে দেশে বছরে ৩ কোটি পিস মোবাইল সেট বিক্রি হয়, যার মধ্যে এক কোটি স্মার্ট ফোন।
দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার, মাথাপিঁছু আয় বৃদ্ধি ও শিক্ষার হার বাড়ায় আগামী ৫ বছরে দেশে স্মার্টফোনের চাহিদা বার্ষিক দুই কোটিতে উন্নীত হবে মনে করছে ফেয়ার গ্রুপ। তাই স্মার্টফোন উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে নেতৃত্ব পোক্ত করতে চায় ফেয়ার গ্রুপ।
এনার্জি সেভিংস ইনভার্টার ও নন-ফ্রস্ট রেফ্রিজারেটর এবং স্যামসাং টেলিভিশনকে আগামী তিন বছরের বাংলাদেশে এক নম্বর অবস্থানে নিয়ে আসতে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ফেয়ার গ্রুপ। এজন্য দেশে মূল্য সংযোজন বাড়িয়ে পণ্যমূল্য আরও কমাতে চায় তারা।