শীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উৎপাদন হচ্ছে কোটি টাকার লালি
শীতে খেজুরের রসের পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরেকটা যে জিনিস সবাইকে আকৃষ্ট করে তা হলো দারুণ সুস্বাদু আখের রসে তৈরি গুড়; তবে এই গুড় ঘন তরল। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় লালি। এই লালি দিয়ে ঘরে ঘরে তৈরি পিঠা-পুলি শীতের খাদ্যতালিকাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়।
লালির কদর শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই না, দেশের নানা অঞ্চলে পাইকারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তার প্রমাণ কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যানমতে, চলতি শীত মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রায় ৬শ' মেট্রিক টন লালি বিক্রি হবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
আখের রসে তৈরি এই তরল গুড় দারুণ মুখরোচক, মূলত পিঠা-পুলি ও পায়েস তৈরিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এই গুড়। এছাড়া চিড়া-মুড়ির সাথে খেতেও অনন্য এই লালি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিন উপজেলায় প্রতি শীত মৌসুমেই লালি তৈরি করেন স্থানীয় কৃষি পরিবারগুলো। বছরের চার মাস লালি তৈরি করে বাড়তি টাকা আয় করেন তারা।
লালি তৈরি ও বাজারজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আখের মৌসুম ধরা হয়। এই সময়টাতেই জেঁকে বসে শীত। এর ফলে এই চার মাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, কসবা ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় উৎপাদিত আখ থেকে লালি তৈরি করেন স্থানীয়রা। ওই তিন উপজেলার শতাধিক পরিবার আখের রস থেকে লালি তৈরির কাজ করেন। এর মধ্যে বিজয়নগর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লালি তৈরি হয়। প্রতিদিন অন্তত এক হাজার কেজি লালি তৈরি হয় সেখানে।
লালি তৈরি হয় আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে, এখনও প্রাচীন পদ্ধতিতে মহিষ দিয়ে মাড়াই করা আখের রস সংগ্রহ করে চুলায় দীর্ঘসময় জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু লালি। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে লালি তৈরির কাজ। প্রতি কেজি লালি পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে। আর খুচরা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ টাকায়।
শুধুমাত্র আখের রস থেকেই এই গুড় তৈরি করা হয়, স্বাদ বাড়ানো বা রঙ হেরফের করতে বাড়তি কোনো কিছুই এই গুড়ে ব্যবহার করা হয় না; ফলে ক্ষতিকারক উপাদান না থাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই লালি একেবারে নির্ভেজাল। জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাইকারদের মাধ্যমে বাজারজাত হয়।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রচুর জমিতে আখের চাষ হতো। কিন্তু অন্যান্য ফসল চাষ অধিকতর লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তারপরও চলতি মৌসুমে জেলার বিজয়নগর, কসবা ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ৬৮ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। আর এসব জমিতে ৪ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদন হবে।
সরেজমিন বিজয়নগর উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা বাড়ির আঙিনায় মহিষ দিয়ে আখ মাড়াইয়ের কাজ করছেন। দিনভর আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহের পর রাতে সেই রস চুলায় জ্বাল দেয়া হয়। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় জ্বাল দেয়ার পর তৈরি হয় সুস্বাদু লালি।
বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের লালি তৈরির কারিগর রুক্কু মিয়া জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ১৫ হাজার টাকায় এক কানি জমির আখ কিনেছেন। এই আখ দিয়ে যে পরিমাণ লালি হবে, তা বিক্রি করে সব খরচ বাদ দিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ হবে তাঁর।
আরব মিয়া নামে আরেক কারিগর বলেন, "আগে বাজারে নিয়ে লালি বিক্রি করতে হতো। এখন পাইকাররা বাড়িতে এসে লালি কিনে নিয়ে যান। এ বছর লালি বিক্রি করে আমার এক লাখ টাকার মতো লাভ হবে। প্রতিবছর শীতের সময়টাতে লালির ব্যবসা করে ভালো টাকা আয় হয়। এতে করে পরিবারের অভাব-অনটন দূর হয়"।
ইদ্রিস মোল্লা নামে গ্রামের প্রবীণ এক ব্যক্তি জানান, কৃষকরা এখন জমিতে অন্য ফসল চাষের কারণে আখ চাষ কমে গেছে। কিছু কৃষি পরিবার পূর্ব-পুরুষদের ব্যবসা ধরে রাখতে লালি তৈরির জন্য আখ চাষ করেন। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কৃষকরা আখ চাষেও আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক রবিউল হক মজুমদার বলেন, "আমরা আশা করছি এবারের মৌসুমে অন্তত ৪ কোটি টাকার লালি বিক্রি হবে। আগে প্রচুর পরিমাণে লালি তৈরি হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু এখন কৃষকরা জমিতে ধানের পাশাপাশি বিভিন্ন লাভজনক ফসল চাষ করছেন। আখ চাষ কমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এতে করে লালিও কম তৈরি হচ্ছে। এখনও কিছু কৃষক ঐতিহ্য হিসেবে আখ চাষ করছেন।"