দারিদ্র্য: যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সেভাবেই কি কমবে?
মহামারি চলাকালীন সময়ে দেশে গত দুইমাসে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)- এর সাম্প্রতিক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক হলেও, জরিপের তথ্যানুযায়ী অবশেষে দেশের অর্থনৈতিক দুর্গতি ক্রমশ এক স্থিতীশীল অবস্থায় এসে দাঁড়ানোর ইঙ্গিতও মিলছে।
অর্থনৈতিক ক্রস সেকশন তথ্যগুলো একত্র করলে, আরও কৌতুহলোদ্দীপক এক বিষয় উঠে আসে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং পরিস্থিতিকেও পরিষ্কার বুঝতে সাহায্য করবে এই তথ্য।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের সাথে লকডাউন চলাকালীন দেশব্যাপী বহু মানুষ আয় এবং কর্মসংস্থান হারায়। পরিণামে বৃদ্ধি পায় দারিদ্র্যের হার। আকস্মিকভাবেই আগস্টে মহামারির পাঁচ মাসের মাথায় দারিদ্যের হার ২০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০.৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
আমরা যদি ধরেও নিই যে মহামারির শুরুতে এই হার ২০.৫ শতাংশে স্থির ছিল, তার অর্থ দাঁড়ায় পাঁচ মাসে এই হার বিস্ময়করভাবে ২০ পয়েন্ট বা ১০০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর – শেষ দুই মাসে এই বৃদ্ধি ছিল খুব কম; মাত্র ১.০১ শতাংশ ।
সরকারি উদ্দীপনা সংক্রান্ত উদ্যোগ এবং অর্থনীতির পুনর্সঞ্চালন স্পষ্টতই কাজে এসেছে। নিশ্চিতভাবেই অর্থনৈতিক দুরাবস্থা অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু যেমনটা বলা হচ্ছে, ৯০ শতাংশ অর্থনীতিও যথেষ্ট নয়। কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় এখনো মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। দ্য ইকোনমিস্ট যেমন লিখেছিল, "অনেক ক্ষেত্রেই ৯০ শতাংশ দারুণ এক বিষয় হতে পারে, কিন্তু অর্থনীতির প্রশ্নে এটা শোচনীয়।"
তবে এখান থেকে আশা করা যাচ্ছে যে, দারিদ্র্যের হার যেভাবে দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই নেমে আসবে।
শেষবার ২০০৫ সালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ৪০ শতাংশে ছিল। সেখান থেকে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে ১৫ বছর লেগেছিল। তবে এবার আর আগের মতো দীর্ঘ সময়ের দরকার হবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে এই রেখাকে নামিয়ে আনা হয়েছিল, সেগুলো যথাস্থানেই আছে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর সেলিম রায়হান বলেন, "ভবিষ্যতে দারিদ্র্যের হার দ্রুত নেমে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে মহামারির কারণে দরিদ্র শ্রেণিতে যুক্ত হওয়া নতুন মানুষগুলোই দুশ্চিন্তার কারণ। এরা মূলত স্বনির্ভর উদ্যোগতা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পুনরায় তাদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে প্রথাগত চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে আমাদের নতুন ধরনের বিশেষায়িত পরিকল্পনার প্রয়োজন।"
অর্থনীতি পুনরায় সচল হলেও, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো আয়ের পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে আছে। শ্রম বাজারও ধীর গতিতে স্বরূপে ফিরছে। দ্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ৩.৬ লাখ তৈরি পোশাকশিল্পের চাকরি এখনো স্বস্থানে ফিরেনি। ফলস্বরূপ, অনেকেই আয়ের নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে। তবে তাদের পক্ষেও মহামারি-পূর্ব অবস্থায় আয় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
চাকরির নিশ্চয়তার মতো বিশেষ উদ্ভাবনী পদক্ষেপ ব্যতীত ২০২১ সালে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলবে। নতুন পরিকল্পনা বেশ পরিকল্পিত হতে হবে যাতে কোনো ফাঁক না থাকে," বলেন ড. রায়হান।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর উদ্দীপনার জন্য আরও ভালো পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন। বড় ব্যবসাগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করা হলেও, এসএমই খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মাত্র ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
তবে দেশের তৈরি পোশাক খাত সবথেকে সৌভাগ্যবান। বেতন এবং মূলধনের জন্য বরাদ্দকৃত ৩৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বেতন পরিশোধের জন্য আরএমজি সেক্টর পেয়েছিল ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সানেমের জরিপে উঠে আসা আরেকটি প্রশ্নোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে যে, সার্বিক প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পেলেও, পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অর্থ এসেছে কম।
কীভাবে বড় বিষয়গুলো দেখতে গিয়ে ছোটখাটো বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে এখানে সেই ইঙ্গিতই মিলে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি সুখবর হলেও, পরিবার এবং ব্যক্তিগতভাবে গৃহীত অর্থের পরিমাণ কম। রেমিট্যান্স চেইন বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যখ্যা করা সম্ভব।
রেমিট্যান্স কেবলমাত্র প্রবাসী, ব্যাংক এবং গ্রাহক সংক্রান্ত বিষয় নয়। আমদানি এবং রপ্তানিকারকরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
"আমদানি এবং রপ্তানিকারকদের জন্য অনিয়মিত পথে রেমিট্যান্স বাড়ে," ব্যখ্যা করেন ড. রায়হান।
"মহামারির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাও মন্দার মুখে। ফলে হুন্ডি এবং অনিয়মিত রেমিট্যান্স ব্যবস্থাতেও প্রভাব পড়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের অর্থ পাঠানোর জন্য কেবলমাত্র নিয়মিত পথ খোলা ছিল। একারণেই নিয়মিত রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে," বলেন তিনি।
অনিয়মিত উপায়ে প্রবাসী আয় পাঠানোর পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, পরিবারের কাছে আসা অর্থের পরিমাণ কমে গেছে।
যারা দেশের বাইরে থেকে প্রেরিত অর্থের উপর নির্ভরশীল ছিল তাদের আয়ও কমেছে, সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে দারিদ্যের হার।
- মূল লেখা: Poverty: Shall it fall just as it rose?
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা