'ভ্যাকসিন পাসপোর্ট' খুলে দেবে ভ্রমণের দরজা
'ভ্যাকসিন পাসপোর্ট' যেন এখন সোনার হরিণ, কোভিডের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া সীমান্তও খুলে যাচ্ছে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট থাকলে।
ভ্যাকসিন গ্রহণের সনদধারীদের অবাধে প্রবেশাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ। সিসিলি, সাইপ্রাস এবং রোমানিয়াসহ কিছু দেশ ইতোমধ্যে করোনার টিকা গ্রহণ করা ভ্রমণকারীদের জন্য কোয়ারেন্টিন বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে আরোগ্য লাভ করা ব্যক্তিদের জন্য ভ্রমণের দরজা খুলে দিয়েছে আইসল্যান্ড ও হাঙ্গেরি।
দেশগুলোর এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণেই ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রমাণপত্র দেখিয়ে নির্বিঘ্ন ভ্রমণের পথ খুলে গেছে, এক্ষেত্রে টিকা পাসপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাসের পর মাস ঘরবন্দী থাকার পর সামনের গ্রীষ্মের ছুটিতে বেরিয়ে পড়তে আগ্রহীদের জন্য এটি বিরাট সুখবর হয়ে এসেছে। পুরো ইউরোপ জুড়েই জোরেশোরে টিকাদান কর্মসূচি চলছে।
টিকাদান প্রক্রিয়ার অগ্রগতির মধ্যে দেশগুলোর রেস্টুরেন্ট, পানশালা, প্রেক্ষাগৃহ এবং অন্যান্য অবসর বিনোদন সুবিধাগুলো আবার চালু করার সিদ্ধান্তও আসবে অচিরেই। গত এক বছর ধরে বন্ধ থাকা এসব প্রতিষ্ঠান বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
টিকা পাসপোর্টকে সহজ করার জন্য আইবিএম-এর মতো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও স্মার্টফোন অ্যাপ বা ডিজিটাল ওয়ালেট তৈরি করছে। এর মাধ্যমে টিকা গ্রহীতারা এসব অ্যাপে কোভিড-১৯ পরীক্ষা এবং টিকা গ্রহণের বিস্তারিত তথ্য আপলোড করতে পারবেন, ফলে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে টিকা গ্রহণের প্রমাণপত্র প্রদর্শনের কাজও অনেকটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। আর পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসাকেন্দ্রের প্রধানরাও এ উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন।
এ সপ্তাহে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মহাসচিব জুরাব পোলোলিকাশভিলিও বৃহত্তর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী টিকা পাসপোর্ট গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ইউএনডব্লিউটিও'র গ্লোবাল ট্যুরিজম ক্রাইসিস কমিটির এক সভায় তিনি বলেন, "টিকাদান কর্মসুচী সঠিক পথেই এগোচ্ছে। পর্যটন পুনরায় শুরু হওয়ার জন্যও আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। টিকাদান কর্মসূচীকে অবশ্যই একটি বৃহত্তর সমন্বিত আয়োজনের অংশ করে, নিরাপদ আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণের জন্য টিকা গ্রহণের সার্টিফিকেট এবং ছাড়পত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে।"
তবে টিকা পাসপোর্ট বা রোগ-প্রতিরোধ পাসপোর্টের এই ধারণাও বেশ বিতর্কিত। সবাই এটি গ্রহণে সম্মত না হলে অনেকের ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালীন ছুটির স্বপ্ন হতাশায় পরিণত হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত টিকা গ্রহণের প্রমাণপত্র পৃথিবীকে আবারও সংযুক্ত করবে, টিকা পাসপোর্ট ধারণার স্বপক্ষে এমন জোরালো যুক্তি আছে। তবে টিকা পাসপোর্ট কীভাবে পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করবে, এর অপব্যবহার কীভাবে রোধ করা হবে এবং যারা এখনো টিকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে তাদের জন্য কি ব্যবস্থা থাকবে—এসব প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এছাড়াও কোন ধরনের ভ্রমণের জন্য এটি বাধ্যতামূলক হবে এবং কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদে আদান-প্রদান করা হবে, এসব প্রশ্নও উঠেছে।
বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টিকা গ্রহণের সার্টিফিকেট তৈরির আহ্বানের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোতাকিস জানুয়ারির শুরুতে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিওনকে চিঠি লিখে বলেছিলেন 'সার্বজনীনভাবে গৃহীত নথিপত্রের প্রয়োজনীয়তা আছে, এবং এটি আমাদের সবার জন্য মৌলিক অগ্রাধিকার"।
মিৎসোতাকিস আরও লিখেছিলেন, "যদিও আমরা টিকা বাধ্যতামূলক বা ভ্রমণের জন্য কোন পূর্বশর্ত আরোপ করছি না। তবে যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের মুক্তভাবে ভ্রমণ করতে দেওয়া উচিত। এটি নাগরিকদের টিকা নিতে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার একমাত্র উপায়।"
২০২০ সালের গ্রীষ্মের শেষেদিকে ইইউ-এর অভ্যন্তরের কিছু দেশের সীমানা উন্মুক্ত করা হয়। ফলে পর্যটন নির্ভর দেশগুলো কিছু ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০২১ সালে অবাধ যাতায়াত চালু না করলে ইউরোপ অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে টিকা প্রত্যয়নের ক্ষেত্রে আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত হয়েছেন ইউরোপের নেতারা। ভ্রমণের ছাড়পত্র হিসেবে টিকা পাসপোর্ট ব্যবহার করলে টিকাবিহীন নাগরিকরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন এবিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
এর ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যেখানে রেস্টুরেন্ট বা পানশালায় এক গ্লাস ওয়াইন চাওয়া গ্রাহকদের কাছ থেকেও টিকা নেওয়ার প্রমাণের প্রয়োজন হতে পারে। অথবা পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় তাদের কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হতে পারে।
ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার কোয়ান্টাস এবং যুক্তরাজ্যের সাগা ক্রুজের মতো কোম্পানি জোর দিয়ে বলছে যে শুধুমাত্র টিকা নেওয়া যাত্রীদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে।
ভন ডার লিওন বৃহস্পতিবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বলেন, "টিকা নিয়ে এখনো অজানা উদ্বেগ রয়েছে। যারা টিকা নিয়েছেন, তারাও ভাইরাসের বাহক হতে পারেন কিনা, বা টিকা তাদের কতদিন ধরে সুরক্ষা প্রদান করবে। তারপর আসে রাজনৈতিক প্রশ্ন। যাদের টিকা গ্রহণের সুযোগ মেলেনি তাদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারটি কীভাবে নিশ্চিত করবেন? এবং যাদের এই টিকা না পাওয়ার কারণ আছে তাদের কাছে আপনি কী বিকল্প প্রস্তাব রাখবেন?"
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেইয়েসাস গত সপ্তাহে জানান, তিনি টিকা পাসপোর্টের বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রভাব নিয়ে সন্দিহান। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরী কমিটির একটি সভায় বলেন, "দুটি জরুরী বিষয় আছে যেগুলোর বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ চাইছি। বিষয় দুটি হলো সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের নতুন ধরনের আবির্ভাব এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য টিকা এবং করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেটের সম্ভাব্য ব্যবহার।"
"একাত্মতাই বিষয় দুটিকে একসাথে নিয়ে আসতে পারে। আমরা নির্দিষ্ট কোনো দল বা দেশকে অগ্রাধিকার বা শাস্তি দিতে পারি না। অবশ্য এ ধরনের বৈষম্য ইতোমধ্যে বর্তমান ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।"
মালদ্বীপের রিসোর্টগুলো কয়েক মাস ধরে সবার জন্য উন্মুক্ত, যদিও সেখানে ধনী ছাড়া সবার জন্য প্রবেশাধিকার সীমিত। যুক্তরাজ্য প্রথম দেশ হিসেবে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে। কিন্তু তারপরও ডিসেম্বরের শেষ থেকে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সংক্রমণের হার ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে সামনের গ্রীষ্মে আন্তর্জাতিক ছুটি অনিশ্চিত এব্যাপারে সরকারী কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক সোমবার বলেছেন, নাগরিকদের ভ্রমণে আগাম বুকিং দিতে দেওয়ার সময় হয়নি এখনও। এখন যত দ্রুত সম্ভব বেশিরভাগ মানুষকে দ্রুত টিকা দেওয়া উচিত। তিনি একইসঙ্গে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের বাড়িতেই ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন।
- সূত্র: সিএনএন