ভারতের কৃষক আন্দোলন থেকে যে শিক্ষা নেওয়া উচিত বাংলাদেশের
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কর্মসূচি তার জৌলুস হারিয়েছে। কেন্দ্রের সাথে দেশের কৃষকদের দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময়ের লড়াইয়ের পর দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে লালকেল্লার উপরে ঝান্ডা উড়িয়ে প্রতিবাদ জানায় কৃষকরা। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে কয়েকশো কৃষক লালকেল্লার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
সরকারের নানান বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে হাজার হাজার ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকরা দিল্লির রাজপথে ঢুকে পড়ে। এমনকি লুকিয়ে-চুরিয়ে ট্রাকের অভ্যন্তরে ট্রাক্টর নিয়ে এসে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় রাজ ভবনের সামনে।
গতকালের ঘটনায় দিল্লিতে প্রাণহানি ঘটেছে এক কৃষকের। কৃষক সংগঠনের নেতারা দাবি করছেন, পুলিশের গুলিতেই ওই কৃষক নিহত হয়েছেন; কিন্তু পুলিশ তা অস্বীকার করছে। দিল্লির সীমান্তজুড়ে দীর্ঘ দুই মাস যাবত কৃষকরা অবরোধ করে প্রতিবাদ করছিল ভারতের এই কৃষি বিলের।
যে কারণে সর্বস্তরে এর সমালোচনা হচ্ছে তা হল বিজেপি সরকার এই বিল প্রণয়ণের পূর্বে দীর্ঘকালের প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য অত্যন্ত তাড়াহুড়া করেছে। কৃষক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
কী ছিল সেই কৃষি বিলে? তা নিয়ে কৃষকদের এত বিদ্রোহ কেন?
বিলটি হচ্ছে উৎপাদিত কৃষিপণ্য জেলার আড়তে বিক্রি করার বিধান যে 'মান্ডি ব্যবস্থা' তা বাতিল করা নিয়ে অর্থাৎ ভারতের যেকোনো অংশের কৃষিপণ্য অন্যত্র বিক্রি করা পরিবহন করা ইত্যাদি। আবার বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন পণ্য সংরক্ষণের আইন যা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বৃটিশ শাসনামলে এবং তার পরবর্তীকালে গ্রহণ করা হয়েছিল সেই সংরক্ষণ আইন বাতিল করেছে ভারতের বর্তমান কৃষি বিল।
নতুন এই কৃষি বিল প্রবর্তনের আগে ভারতের কোন কোন পণ্যের ক্ষেত্রে এক ধরনের মিনিমাম প্রাইস গ্যারান্টি চলছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তুলা। বর্তমানের বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ব্যাপকভাবে তুলা উৎপাদনকারী চাষীদের সহায়ক মূল্য প্রদান করা হয়, ফলে গত দুই-তিন বছর যাবৎ তুলা উৎপাদনকারী চাষীরা ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে। সরকার সহায়ক মূল্য দ্বারা তুলা ক্রয় করে সরকারের গোডাউনে সংরক্ষণ করছে। ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় এইভাবে সহায়ক মূল্য প্রদানে সরকারের এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে। আর প্রধান বিষয়টি হচ্ছে বিজেপি সরকার খানিকটা চীনের প্রদর্শিত রাস্তা ধারণ করতে যাচ্ছে, যা হচ্ছে স্টেট ক্যাপিটালিজম ডেভলপ করার লক্ষ্যে চীনের অনুকরণে দেশের কিছু বৃহৎ কোম্পানিকে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করার মাধ্যমে নতুন অর্থনীতির পথ তৈরি করা।
ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে কৃষি আইন এর নানান দিকে। যার মধ্য আছে মজুদ বিরোধী আইন, যা বাতিল করেছে সরকার। যার মধ্যে আছে মান্ডি ব্যবস্থা, যা বাতিল করেছে সরকার। ভারতের বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এসব কিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী মান্ডি ব্যবস্থা পরিচালনাকারী রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। তারা কৃষকদেরকে ভুল বুঝাচ্ছে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে মিনিমাম প্রাইস গ্যারান্টি থাকার কথা বলা হচ্ছে, আপাতত দেড় বছরের জন্য স্থগিত করে আলাপ আলোচনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে কৃষকরা এত ব্যাপক দৃঢ়তার সঙ্গে সরকারের সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে তা বোঝা যাচ্ছে না। কৃষকদের পক্ষ থেকে মূল দাবি হচ্ছে, আইনটি প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু এই নতুন আইন দ্বারা যে কৃষি সংস্কার করার কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে, তা উন্নত দেশগুলোতে প্রায় সর্বত্র একই ধরণের অবস্থা বিরাজ করে। ভারতের কৃষকরা অর্থনৈতিক স্কেলে ছোট কৃষক। এ রূপান্তর হওয়াতে বহু বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশের কৃষকদের মতন তারা সক্ষম নন।
বিজেপি সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এক ধরনের চুক্তিভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা চালু করা অর্থাৎ বৃহৎ পুঁজির কোম্পানিগুলো কৃষকের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে কৃষি পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ। উন্নত বহু দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা থেকে চুক্তিভিত্তিক কৃষি উৎপাদন হয়ে থাকে। ছোট ছোট কৃষককে সহায়তা করার জন্য এটি সম্ভবত একটি পরীক্ষিত উৎপাদন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কৃষকের বেঁচে থাকা কিংবা কৃষককে বাঁচিয়ে রাখা বৃহৎ পুঁজির ধর্ম হয়ে যায়। সেই জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করা হয় তা কৃষকের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর কিছু হয়না।
এর পাশাপাশি ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাব এই ডিসেম্বর মাসের ভরা শীত মৌসুমে দেশের সর্বত্র কৃষক যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন করেছে তা সম্পূর্ণরূপে কৃষকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাজারে শীতের সকল ধরণের সবজির গড় বিক্রয় মূল্য দাঁড়িয়েছে ২০/৩০ টাকা। ঢাকার বাজারে যদি বিক্রয় মূল্য ২০ টাকা হয় তাহলে মাঠে কী দামে বিক্রি হচ্ছে এই পণ্য তা সহজেই অনুমান করা যায়। এমনকি মাস ছয়েক আগে যে আলুর মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আলুর সংরক্ষণাগারে অভিযান চালাচ্ছিল মূল্য বৃদ্ধির গতি রোধ করতে, সেই আলু এখন ৩০ টাকার নিচে চলে এসেছে। ৩০ টাকার নিচে আলু বিক্রি করতে গেলে এই মুহূর্তে কৃষক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কোন পণ্যের উৎপাদন সহায়ক মূল্য সরকারের নাই। ধানের/চাল একটি ক্রয় মূল্য ঘোষণা করে কিন্তু কোন বছর তা কার্যকর হয়, আবার কোন বছর তা কার্যকর হয় না। সরকারকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয় কৃষি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য। কোন কারণে কৃষিপণ্য সংকট দেখা দিলে, প্রাকৃতিক কারণে উৎপাদন কম হলে, সরকারকে আমদানির দিকে ঝুঁকে যেতে হয়। এখানেও সেই বড় কোম্পানি।
বাংলাদেশের বৃহৎ কোম্পানিগুলো সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্য আমদানি শুরু করে। এই বৃহৎ কোম্পানিগুলো সরকারের নানা স্তরের সহযোগী হওয়াতে কৃষি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা প্রায়ই সরকারকে সহযোগিতা করছে। ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে চাল আমদানি প্রক্রিয়াও একইভাবে চলছে। কিছুদিন আগে পেঁয়াজ নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি করেছিল ভারত, সেই সময়ে ব্যাপক হারে এই বৃহৎ কোম্পানি এবং মাঝারি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে সরকার। চাহিদা কিংবা আমদানির সময় এবং সামুদ্রিক পণ্য পরিবহনে সময়নিষ্ঠ হওয়া ইত্যাদি কারণে সময়মতো পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসতে না পারায় কয়েক লক্ষ টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে নষ্ট হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়, যার সঠিক পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি। এ ধরনের বৃহৎ কোম্পানিদেরকে কাজে লাগিয়ে সরকার যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছেন কৃষি পণ্য উৎপাদন ও বাজার সংরক্ষণ করার জন্য তা কতটা সুদূরপ্রসারীভাবে কার্যকর হবে তা বলা মুশকিল। এই কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফার জন্য পণ্য আমদানিতে ভূমিকা পালন করে। কখনো তাদের ইচ্ছা নির্ভর ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। সেই জন্য বাংলাদেশের ভারতীয় কৃষকদের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ বাজারজাত করা এবং ছোট কৃষকের সহায়তা প্রদান মজুদদারি আইন সংরক্ষণ ইত্যাদির একটি ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া দরকার, যাতে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণার জায়গা থেকে প্রকৃত কৃষকের উন্নয়নের দিকে লক্ষ রাখা যায়।
বর্তমানে প্রচলিত টুকরো-টুকরো সিদ্ধান্ত সরকারের ভাবমূর্তি যেকোনো ধরনের বড় সংকটে ফেলতে পারে। সেজন্য মজুদদারী আইন এবং মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস দীর্ঘস্থায়ীভাবে শুধু ধানের অথবা চালের জন্য নয়, অন্যান্য কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রেও করা দরকার। ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার সবজি সংরক্ষণ এর জন্য, ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার কৃষির অন্যান্য অঞ্চলে মানোন্নয়নের জন্য। তা না হলে হয়তো আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষকরাও সরকারের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতে পারে ভারতের কৃষকদের মতন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক