রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
মেলার মৌসুম মেলার সন্ধ্যা
যখন আজকের মতো নানা প্রকারের ইলেকট্রনিক মিডিয়াছিল না তখন সরকারি সংস্থাগুলোকে প্রচারণামূলক বা সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম চালানোর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া, দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো, হাতে হাতে লিফলেট-পুস্তিকা বিতরণের বাইরে হয় সারাদেশে ছোট প্রজেক্টর নিয়ে তথ্যচিত্র দেখাতে হতো, নয়তো নানা প্রকারের প্রদর্শনীর আয়োজন করতে হতো। অমন প্রচারণামূলক তথ্যচিত্রগুলোকে আমরা 'টকি সিনেমা', আর সিনেমাহলে গিয়ে যেগুলো দেখতাম সেগুলোকে শুধুই 'সিনেমা' বলতাম। আমি জীবনে দুটো টকি সিনেমা দেখেছিলাম–একটি বড় মামার সাথে বালুর মাঠে গিয়ে স্প্রেয়ার দিয়ে ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর পদ্ধতি সংক্রান্ত, আরেকটি শাকিলদের বাসার আঙিনাতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন নৃশংসতা সংক্রান্ত–এটি অবশ্য সরকারি আয়োজন ছিল না।
অনেক শহরেই 'স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিও পরিবার-পরিকল্পনা' বিষয়ক সরকারি বাৎসরিক প্রদর্শনী আয়োজন করা হতো যেটি 'এক্সিবিশন' নামে পরিচিত ছিল। এই এক্সিবিশন কিছুটা আজকের বাণিজ্য মেলা, কিছুটা মীনা বাজার, কিছুটা বৈশাখী মেলা আর কিছুটা সরকারি প্রচারণা কার্যক্রমের মিশেল ছিল। হেমন্তের শেষে বা শীতের শুরুতে এক্সিবিশন শুরু হয়ে চলত প্রায় মাসখানেক ধরে। প্রতি বছর আয়োজনটা হতো বলে এই ব্যাপারে সবার এক প্রকার প্রস্তুতি থাকত। আমার দেখা এক্সিবিশন আমাদের বাসার কাছের স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হতো।স্টেডিয়ামে যাবার রাস্তাটির অনেক দূর থেকে এক্সিবিশনের বাইরের আয়োজন শুরু হয়ে যেত। সেখানে ভ্যানে করে বাদাম-বুট-সীম বিচি ভাজা, পোড়ানো ভুট্টা, আখ, আচার, আইসক্রীম, বেলুন আর হাওয়াই মিঠাই বিক্রির বাইরে ছোট ছোট অস্থায়ী দোকানে চটপটি, ফুচকা, হালিম, শিক কাবাব আর চিকেনটিক্কা বিক্রি করা হতো। সাথে পান, সিগারেট আর চায়ের অগণিত টঙ বসতো। এক্সিবিশনের ভেতরে খাবারের দোকান বসতে দেয়া হতো না। আজও এক্সিবিশনের কথা মনে হলে প্রথমেই কাঠকয়লার আগুনে কাবাব পোড়ানোর সুঘ্রাণ আমার নাকে এসে ধাক্কা দেয়। আমি দেখতে পাই তালপাতার ভাঙা হাতপাখা দিয়ে প্রাণপনে বাতাস করে একজন মানুষ কাঠকয়লার আগুনের উপরে রাখা সারি সারি শিক কাবাব আর চিকেন টিক্কা ঝলসাচ্ছেন।
স্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টারগুলো এক্সিবিশনের টিকিট কাউন্টার হয়ে যেত। একেবারে ছোট শিশুদের টিকিট লাগতো না বলে দুয়েক বার সদ্য যুবক মামা-কাকারা আমাদের জন্য টিকিট না কেটে কোলে তুলে নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। গেটে দেখা গেলো এমন কেস অনেক। নিজেদের লোকসান ঠেকাতে সদা তৎপর গেটের ইজারা প্রাপ্তরা তাই আমাদের জন্য আবার হাফ টিকিট কিনে আনতে বাধ্য করতেন। এক্সিবিশনটা মোটা দাগে কয়েকটা ভাগে বিভক্ত ছিল–সরকারি প্রচারণামূলক প্রদর্শনী অংশ, মেলা অংশ, হাউজি-যাত্রা-সার্কাস-পুতুল নাচ অংশ, চিড়িয়াখানা অংশ।কাঠের থাম আর বাঁশের ফ্রেমে তিনদিকে টিনের বেড়া, উপরে টিনের চাল দিয়ে প্রদর্শনী কক্ষগুলো বানানো হতো। মেঝের মাটির উপরে স্রেফ ইট বিছিয়ে দেয়া হতো। কোন কোন কক্ষের মেঝের ইটের উপরে চটও দেয়া হতো।
সরকারি অংশের একটি কক্ষে কলেরা, উদরাময়, যক্ষ্মা ধরনের রোগ, টিকা দান আর স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বিষয়ে নানা পোস্টার আর ছবি থাকতো। সেখানে উপস্থিত স্বাস্থ্য কর্মীরা দর্শকদের এই সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন, কী করে লবণ-গুড়-জলের শরবত বা খাবার স্যালাইন বানাতে হয় তা শেখাতেন। এখানে মাইকে খাবার স্যালাইনের প্রচারণা চলত–
"পুরুষ কণ্ঠঃ ডায়রিয়া! ডায়রিয়া!! ডায়রিয়া!!!
ডায়রিয়া কেড়ে নেয় প্রাণ,
মানুষকে করে ফেলে মৃতের সমান।
নারী কণ্ঠ (সুর সহযোগে): ডায়রিয়া নামে যেন দানব বেশে,
নেয় যেন কারো বুকের মাণিক কেড়ে।
শুরুতেই তাকে দিন খাবার স্যালাইন,
লবণ-গুড়-জলে বানানো স্যালাইন"।
ডায়রিয়া বিষয়ক সরকারি প্রচারণা দেশে কার্যকর ডায়রিয়া প্রতিরোধে আসলেই বিপ্লব করে ফেলতে পেরেছিল। এই কক্ষের বিপদজনক ব্যাপার হচ্ছে এখানে টিকা দেবার ব্যবস্থা থাকত। জন্মের পর থেকে সব শিশুকে ছয় বার নিয়মিত টিকা দেবার ব্যাপক সংস্কৃতি তখনও দেশে গড়ে ওঠেনি। ফলে ঐ কক্ষে আমার বয়সী বা তারচেয়ে ছোটদের চীৎকার চেঁচামেচি লেগে থাকত।
আরেকটি কক্ষে অশিক্ষার কুফল সংক্রান্ত নানা পোস্টার থাকত। সেখানে 'লেখাপড়া' আর 'বড়দের বই' নামে বয়স্ক শিক্ষার বই আর প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকও থাকত। তখন সবেমাত্র 'সবুজ সাথী'কে হঠিয়ে 'আমার বই' টেক্সটবুক বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক হিসাবে বাজারে এসেছে। নতুনপাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট আর অঙ্গসজ্জা দেখার ব্যাপারে সাধারণের আগ্রহ ছিল। তখনো বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেবার কার্যক্রম শুরু হয়নি। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নানা পাঠসামগ্রীও থাকত। যেমন, সাদা কাঠের ফ্রেম দিয়ে চারপাশ বাঁধাই করা স্লেট আর মাটির পেন্সিল রাখা থাকত। স্লেটের ফ্রেমে খোদাই করে লেখা থাকত 'ইতালী পাথরের তৈরী'। সেই স্লেট হাত থেকে পড়লে বা ঘুষি মারলেই ভেঙে যেত–পাথরের জিনিস এত ভঙ্গুর হয় কী করে! স্কুলগুলোতে ব্যবহারের জন্য কাঠের তৈরি 'ব্ল্যাকবোর্ড' আর চকপেন্সিল রাখা থাকত।
পরিবার পরিকল্পনার কক্ষে ছোটপরিবারের সুখ আর অধিক সন্তানের কষ্ট সংক্রান্ত নানা রকমের ছবি আর পোস্টার থাকত। এছাড়া অন্যকিছু ছিল কিনা বলতে পারব না কারণ, বড়রা এই কক্ষ থেকে আমাদেরকে বের করার জন্য তাড়া দিতেন, বের হ! বের হ! এখানে দেখার কিছু নাই! আমরা অবশ্য 'রেডিও বাংলাদেশে' দুপুরে 'ছোট্ট নীড়, সুখের নীড়' আর সন্ধ্যায় 'সুখী পরিবার' অনুষ্ঠান শুনে শুনে 'ছেলে হোক, মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট', 'ছোট পরিবার, সুখী পরিবার', 'আমার মন যাইতে চায়, পরিবার পরিকল্পনায়' জাতীয় শ্লোগানগুলো তো বটেই কয়েকটা পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর বিজ্ঞাপনের গান পর্যন্ত মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। বিজ্ঞাপনের সেসব গান গাইতে গিয়ে প্রায়ই নানা বিপত্তি সৃষ্টি হতো–সেসব লজ্জার কথা থাক।
আমাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল কৃষির কক্ষ। সেখানে বিশাল বিশাল আকারের লাউ, কুমড়ো, অস্বাভাবিক বড় আলু, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি রাখা থাকত। আমরা সেসব ধরে দেখতে চাইতাম, আর বড়রা রে রে করে আসতেন–অ্যাই! কোন কিছুতে হাত দিবি না। সেচ পাম্পের কার্যক্রম দেখানোর জন্য সেখানে একটা চৌবাচ্চা থেকে ডিজেল এঞ্জিন দিয়ে চালিত পাম্প দিয়ে পানি তুলে আবার ঐ চৌবাচ্চাতেই ফেলা হতো। আমরা অবশ্য 'দমকল' দিয়ে যেখানকার পানি সেখানেই ফেলার কোন মানে বুঝতে পারতাম না। আশ্চর্যের ব্যাপার, চৌবাচ্চার পাশেই একটা ছোট ক্ষেতমতো বানানো জায়গায় লাগানো ধান, বেগুন, টমেটোর গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে থাকত। কক্ষগুলোর বাইরে খোলাজায়গায় খাল খনন কর্মসূচীর মাধ্যমে কী করে দেশের উন্নতি করা হবে সেটার মডেল বানিয়ে দেখানো হতো। কাদামাটি আর রঙ দিয়ে বানানো মাঠজুড়ে বিশাল একটা বাংলাদেশের ম্যাপ থাকত। আদমজী জুটমিলের বিশাল প্যাভিলিয়ন থাকত যেখানে পাট থেকে সুতো বানানো আর তাঁত যন্ত্র দিয়ে কী করে সুতো থেকে চট বানানো হয় তা দেখানো হতো। আমরা ঐ প্যাভিলিয়নে ভয়ে ভয়ে ঢুকতাম কারণ, প্রতি বছর আদমজীর প্যাভিলিয়নে কী করে যেন আগুন লাগতো। আমি নিজে দুই বার অমন অগ্নিকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি। আগুন লাগলে বড়রা ইস্যুরেন্স নিয়ে কীসব যেন আলোচনা করতেন তার কিছু বুঝতে পারিনি।
এক্সিবিশনের মেলা অংশে ছিল হস্তজাত শিল্প বা কুটির শিল্পের নানা জিনিসের স্টল। পাট, সুতা, উল, তুলা, কাপড়, চট, বাঁশ, বেত, কাঠ, মাটি, কাচ, চীনামাটি, ধাতু ইত্যাদি দিয়ে বানানো নিত্যপ্রয়োজনীয় বা ঘর সাজাবার নানা উপকরণ। রাবারের অল্পস্বল্প জিনিস থাকলেও প্লাস্টিকের এমন সর্বগ্রাসী আক্রমণ তখনো শুরু হয়নি।এই অংশে একটা নাগরদোলা থাকত। চারটা কাঠের খাঁচায় লোক ভর্তি করে দুজন মানুষ সেগুলোকে একটা আনুভূমিক অক্ষের চারপাশে ক্যাঁকোর ক্যাঁকোর শব্দে প্রবল বেগে ঘূর্ণি খাওয়াচ্ছেন–এমনটি দেখলে আমার আর জানে পানি থাকতো না। এই কারণে যথেষ্ট বড় না হওয়া পর্যন্ত আমি নাগরদোলাতে চড়তাম না। এখান থেকে আমরা বাঁশের ছোট ডুলা বা পলো, কাঠের বলাকা, মাত্রুশকা পুতুলের মতো দেখতে তিনটি কাঠের পুতুলের সেট, মাটির বানানো কলা-কাঁঠাল-আপেল-বেদানা, কাচের মোটা টিউবের ভেতরে জরি মেশানো জলদেয়া রকেট এমন সব জিনিস কিনতাম। এই অংশের পাশে থাকতো চিড়িয়াখানা অংশ যেখানে সাধারণত একটা জ্বরাক্রান্ত ভালুক, একটা বড় চৌবাচ্চাতে কাঠের গুড়ির মতো পড়ে থাকা ছোট আকারের কুমীর, কয়েকটা বানর, কয়েকটা শেয়াল আর গণ্ডাখানেক চিত্রল হরিণ থাকতো। একটা বিশাল অজগর সাপের মমি একটা কাঠের থামে পেঁচিয়ে রাখা হতো। ভালুকটাকে কখনো সুস্থ অবস্থায় নড়াচড়া করতে দেখিনি। আমাদের প্রতিবেশী সরকারি পশুচিকিৎসক ইউনুস চাচাকে দেখতাম ভালুকটাকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন। তাঁর সাহস দেখে আমরা চমৎকৃত হতাম। রোগা ভালুকটাকে দেখে অনুচ্চস্বরে ছোটদের পাঠ্যপুস্তকে পড়া ছড়া—
"ভালুকের শিরঃপীড়া হয়
পুনঃ পুনঃ বাড়ে
আর সে দুঃখীজন হয়"
আস্তে আস্তে আবৃত্তি করতাম। জোরে বলার সাহস হতো না পাছে ভালুকটা গর্জন করে ওঠে সেই ভয়ে। দর্শকেরা বানরগুলোকে বাদাম বাকলা দিতে চাইলে পাহারায় থাকা লোকজন নরম গলায় নিষেধ করতেন।
অনেক উঁচু করে গোল তাঁবুর মতো টিন দিয়ে ঘেরা সার্কাসের জায়গাটিতে ঢুকতে আলাদা টিকিট কাটতে হতো, সেটি পুতুল নাচ বা যাত্রার জায়গাতে ঢোকার জন্যও সত্য ছিল। আমার কখনো সার্কাসে ঢোকার সুযোগ হয়নি। তবে সহপাঠী বাদশাহ্, প্রদীপ, শহীদুল, মিজানদের কাছে বর্ণনা শুনতে শুনতে আমার সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। একজন মানুষচোখ বেঁধে একটা কুয়ার ভেতরে মোটর সাইকেল চালায়, একজন মেয়ে দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে লাঠি নিয়ে খেলা দেখায়, একটা ছাগল আড়াআড়ি করে পাতা একটা বাঁশের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, একজন মেয়ে বাঘের সাথে বল নিয়ে খেলে, একজন মানুষের মুখে ইলেকট্রিক বাল্ব ধরলে বা দুহাতে টিউবলাইট ধরলে জ্বলে ওঠে, একজন মানুষ নিজের গলার ভেতরে লম্বা তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয়, চোখ বাঁধা একজন লোক একটা বোর্ডের সাথে বাঁধা একজন মেয়ের চারপাশে ছুরি ছুঁড়ে মারে এমন সব লোমহর্ষক ব্যাপার স্যাপার। সার্কাসের বাইরে একজন মানুষ মাইক নিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেন, 'বঅঅঅঅঅঅনসুন্দরীইইইইইই'! তা এই 'বন সুন্দরী' ব্যাপারটি কী? যারা দেখেছেন তাদের কাছে জানা গেল একজন মেয়েকে লতাপাতার পোশাক, ফুলের অলঙ্কার, মুকুট ইত্যাদি পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সেই মেয়ের গায়ে ভালুকের মতো বিশাল বিশাল লোম যা আসলে পাট বা উল জাতীয় কিছু দিয়ে বানানো। গোটা ব্যাপারটা কল্পনা করে আমার মধ্যে এখনো ভীতির সাথে একটা গা-গোলানো ব্যাপার কাজ করে।
এক্সিবিশনের পুতুল নাচ আমার কাছে খুব একঘেঁয়ে আর বিরক্তিকর লাগতো। এর কারণ হচ্ছে ওখানকার পুতুল নাচের গল্পগুলো ছিল খুব হাতেগোনা কয়েকটি, গানগুলো মূলত বাংলা সিনেমার, নেপথ্যের মানুষগুলো কেমন গলা চেপে সংলাপ বলে, গান গায়, পুতুলগুলোর নড়াচড়াগুলোও হাতেগোনা কয়েক রকমের। এজন্য আমি পুতুল নাচ দেখতে চাইতাম না। এরচেয়ে আমার কাছে বিটিভিতে দেখানো মুস্তফা মনোয়ারের পুতুল নাচ ভালো লাগতো। সেই পুতুল নাচের গল্প, সংলাপ, উচ্চারণ, গান, পুতুলের সাজ-পোশাক সব কী চমৎকার ছিল! সেখানে দেখানো 'মিথ্যেবাদী রাখালে'র গল্পের গান আজো মনে আছে–
"দুপুর বেলা বনের ধারে বাজাই বাঁশের বাঁশী
মন লাগে না কোন কাজে নেইকো মুখে হাসি
ছল ছলিয়ে ডাক দিয়ে যায় ঐ যে ছোট্ট নদী
উদাস মনে সদাই ভাবি হতেম পাখি যদি
বিনা কাজে থাকতে বড়ই ভালোবাসি
মন লাগেনা কোন কাজে নেইকো মুখে হাসি"।
মধ্যরাতে যখন যাত্রা শুরু হতো তার অনেক আগে এক্সিবিশনের বেশিরভাগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেত এজন্য এক্সিবিশনে 'সাগরভাসা' বা 'হিংসার পরিণামে'র মতো যাত্রা পালা কখনো দেখা হয়নি। কেবল একবার যাত্রার গ্রীনরুমে উঁকি দিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল। খুব অবাক হয়ে দেখেছিলাম কী করে মেকআপ দিয়ে একজন মানুষের চেহারা রাতারাতি পালটে দেয়া হচ্ছে! সন্ধ্যা থেকে যাত্রার মঞ্চের মাইকে উচ্চস্বরে গান বাজানো হতো—
"একশ টাকার নোট দিলে
গান শোনা যায় রে
আরো কিছু বেশি দিলে
নাচ দেখা যায় রে
এমন কিছু জিনিস আছে
লাখ টাকা দিলেও তারে পাওয়া যায় না"।
আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কূল করতে পারতাম না কোন্ জিনিসের দাম লাখ টাকার চেয়েও বেশি হতে পারে!
হাউজির জায়গায় দেখা যেত লোকজন শতকিয়ার টেবিলের মতো ছাপা হাউজিশীট আর কলম নিয়ে বসে আছেন আর একজন সামনে মাইকে নামতা পড়ার মতো সুর করে বলে যাচ্ছেন–
"এক্সিবিশন গেইট, নাম্বার এইট
টু লিটিলডাকস, টু এন্ড টু, টুয়েন্টিটু
ছেলেটা ভালোই কিন্তু গাঁজাখোর, নাম্বার ফোর
মটকা-মটকি, ফোর এন্ড ফোর, ফর্টিফোর
মি এন্ড ইউ, নাম্বার টু"।
এর মধ্যে এক একজন খেলোয়াড় হঠাৎ 'ইয়েস!' বলে চেঁচিয়ে উঠে 'লাইন' বা 'হাউজ' ঘোষণা দিতেন। আমার খুব ইচ্ছে করতো অমন সহজ খেলাটি খেলতে। কিন্তু ঐ চোষ কাগজের শীটগুলোর এক একটি নাকি দশ টাকা দিয়ে কিনতে হয়! অত টাকা আমাকে কে দেবে? এক্সিবিশনের বাইরে কোথাও কোথাও আধো অন্ধকারে জুয়ার বোর্ড যে বসতো না তা নয়। তবে পুলিশী তৎপরতায় সেগুলো দৌড়ের ওপর থাকত।
একসময় শীতকালে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর পক্ষ থেকে শেরে বাংলা নগরে 'রপ্তানী মেলা' নামের একটা মেলা আয়োজন করা হত। এই মেলাটি হচ্ছে এখনকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পূর্বসূরী। এটি বেশ ছিমছাম, গোছানোমেলা ছিল যেটিকে ঠিক বৈশাখী মেলা বা এক্সিবিশনের কাতারে ফেলা যাবে না। বিকেলে শুরু হয়ে রাত নয়টা-দশটা অবধি চলা এই মেলাটিতে যাবার সুযোগ খুব কম হয়েছে আমাদের বাসা থেকে মেলার দূরত্বটা বেশি ছিল বলে। ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় মেলার বিজ্ঞাপনে অদ্ভুত আকারের খিলানের মতো করে বানানো মেলার প্রবেশদ্বারের ছবি দেয়া থাকত। শেষ বিকেল থেকে লোকজন পরিবারের সব সদস্য নিয়ে একসাথে মেলা দেখতে আসতেন। তখন মেলার ভেতরে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বাঁশের খুঁটির সাথে লম্বা করে আটকানো টিউবলাইটগুলো একে একে জ্বলে উঠে কেমন অদ্ভুত একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতো। আলোর পোকারা টিউবলাইটগুলোর চারপাশে উড়তে থাকতো। একটা জায়গায় অনেকগুলো ফুলগাছ ছিল যেগুলোতে বিশাল বিশাল আকারের গোলাপ, ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা ফুটে থাকতো। সেটা কি কোন বাগান নাকি টবে সাজানো গাছ সেকথা আর স্পষ্টমনে নেই। ঐ মেলাতে বেশ বড় আকারের দেয়াশলাই, খুব ছোট আকারের সাবান, নানা আকার-আকৃতি-রঙের মোমবাতির মতো অদ্ভুত সব জিনিস পাওয়া যেত। এখানে প্রথম 'ববিক্লিপ' দেখি। আইনত লম্বা চুল আটকানোর জন্য ব্যবহৃত ধাতব পিন যেটা বাজারে 'কালোক্লিপ' নামে পরিচিত সেটাই 'ববিক্লিপ' বা 'ববি পিন', কিন্তু আমরা এক বিশেষ প্রকারের হেয়ার পিনকে ববিক্লিপ বলতাম। সেটাতে কালো ক্লিপের গায়ে ধাতব আঙুরের থোকা, কলার ছড়া, একজোড়া আপেল, প্রজাপতি বা ফুল লাগানো থাকতো। ধাতুর ওপরে রঙিন মীনাকারির উপরে একটু উঁচু হয়ে থাকা স্বচ্ছ কিছু একটার প্রলেপ থাকত। এই ব্যাপারটি আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। এজন্য চুলের ক্লিপের ব্যবহারকারী না হলেও আমি চাইতাম নানা রকমের ববিক্লিপ কেনা হোক। কাপড় দিয়ে বানানো সবুজ পাতার সাথে লাল গোলাপ পাওয়া যেত যেখানে পাতার পেছনে আর ফুলের বোঁটার ভেতরে ধাতব তার আর কাপড়ের উপরে রজনের প্রলেপ দেয়া থাকত। মেয়েরা এটাকে চুলের কাঁটা আর ছেলেরা কোটপিন হিসাবে ব্যবহার করত। আমরা এটাকে বলতাম 'ব্রুচ'। এই মেলায় আমাদের কেনাকাটা হতো খুব কম। আসলে মেলাটি ঢাকার মধ্যবিত্তের সপরিবারে সান্ধ্যকালীন বেড়ানোর একটি জায়গা ছিল।
কোন কোন ক্লাব বা অ্যাসোসিয়েশন নিজেদের তহবিল বাড়ানোর জন্য হঠাৎ হঠাৎ যে মেলার আয়োজন করতো সেটাকে আমরা 'মীনা বাজার' বলতাম। দুয়েক দিনের জন্য ছোট পরিসরে আয়োজন করা হতো বলে মীনা বাজারগুলোতে বেশ ভীড় হতো। সেখানে লোকে যতোটা না কেনাকাটা করতে যেতেন তারচেয়ে ঢেড় বেশি যেতেন এমনি বেড়াবার উদ্দেশ্যে। আজকাল দেখি কিছু জায়গায় এমন মীনা বাজার স্থায়ীরূপ পেয়ে গেছে। ভেতরে স্টলগুলোর কোন পরিবর্তন হয় না, কেবল বাইরের গেট আর মেলার নাম বদলে যায়। এটা বোধকরি রাজস্ব ফাঁকি দেবার জন্য একটা কায়দা। তবে যেদিন থেকে 'আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা' শুরু হয়েছে সেদিন থেকে কেবল রপ্তানীমেলা বন্ধই হয়নি সাথে এক্সিবিশন তার জৌলুস হারিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, মীনা বাজারগুলোও প্রাণৈশ্বর্য হারিয়েছে। এর পাশাপাশি এখন হাজার হাজার খাবারের দোকান হয়েছে যেখানে ছোট বড় সবাই একা বা দলবেঁধে খেতে যান। লোকে এখন বসে খেতে খেতে গল্প করেন। খেতে যাওয়াটাও এখন বেড়াতে যাওয়া বলে ধরা হয়। এর সাথে কেনাকাটার জন্য যোগ হয়েছে অগণিত সুপার মার্কেট, সুপার শপ।ফলে মেলাগুলো আর আগের মতো নিজস্ব ঘ্রাণ আর রঙ নিয়ে হাজির হতে পারে না।
- ১২ জানুয়ারি ২০২০