ফিরে আসছে ঢাকাই মসলিন
ঢাকাই মসলিনের কাপড় তৈরির জন্য যে সুতা লাগে তা পাওয়া যায় ফুটি কার্পাস নামে এক ধরনের তুলার গাছ থেকে। মোঘল আমলে গাজীপুরের কাপাশিয়াতে বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে মাঠজুড়ে চাষ হতো ফুটি কার্পাস তুলার গাছ। তারপর সেই তুলা থেকে কয়েক ধাপে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাওয়া যেত কাঙ্ক্ষিত সুতা। নারায়ণগঞ্জের রূপনগরে চরকায় কেটে সুতা থেকে বোনানো হতো মসলিন কাপড়।
কিন্তু ১৮৫০ সাল থেকে মসলিন কাপড় উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর ১৭০ বছর পর আবার সেই মসলিন কাপড়ের পুনর্জন্ম ঘটান একদল গবেষক। ইতোমধ্যে তা জিআই সনদও পেয়েছে। সরকার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনাও নিয়েছে।
মসলিন পল্লীও গড়ে তুলতে চায় সরকার।
মসলিন কাপড় তৈরির প্রযুক্তির পুনরুদ্ধার প্রকল্পের গবেষকদল ছয় বছরের চেষ্টায় মসলিন কাপড়ের পুনর্জন্ম ঘটান।
এইজন্য তাদের ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহ, চাষাবাদ ও জাদুঘরে সংরক্ষিত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকোয়েন্সের সঙ্গে মেলাতে হয়েছে। এরপর ফুটি কার্পাস তুলা থেকে সুতা চরকায় কেটে বোনাতে হয়েছে সুতা। এইজন্য মসলিন কাপড় তৈরির জন্য নতুনভাবে চরকাও তৈরি করতে হয়েছে গবেষকদলকে।
ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিনের পৃথিবীব্যাপী চাহিদা ছিল ব্যাপক। এত মিহি সুতা দিয়ে তৈরি কাপড় আর পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি ছিল না, যা একটা ম্যাচবক্সের মধ্যে এঁটে রাখা যেত। পুনরুদ্ধারকৃত এই মসলিন কাপড় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গেলে বিশ্বব্যাপী মার্কেট পাওয়া সম্ভব। ইতোমধ্যে বিলিয়ন ডলারের মার্কেট তৈরি হয়ে আছে বলে গবেষকদের মত। তাদের প্রত্যাশা, গাজীপুরে বাণিজিকভাবে ফুটি কার্পাস চাষ ও মসলিন কাপড় তৈরির ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা হবে। এখন গাজীপুরে যেমন সারি সারি গার্মেন্টস রয়েছে, ঠিক সেই জায়গায় তেমনভাবে স্থান করে নেবে মসলিন কাপড় তৈরির ইন্ডাস্ট্রি। কারণ ঢাকাই মসলিন বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ড।
পৃথিবীব্যাপি গর্ব করার মতো ব্র্যান্ড বাংলাদেশের খুব একটা নেই, মসলিন ছাড়া- যার তুলা থেকে সুতা তৈরি ও বুনন প্রক্রিয়া সবই হতো বাংলাদেশে। এই মসলিন বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা গেলে বাংলাদেশ ঢাকাই মসলিনকে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড বলে বিশ্বব্যাপী পরিচয় দিতে পারবে।
ফুটি কার্পাস তুলার গাছ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করা হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের গবেষণা মাঠে। জাদুঘরে সংরক্ষিত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকোয়েন্স মেলানোও হয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা ল্যাবে।
ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রযুক্তির পুনরুদ্ধার শীর্ষক প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেন। এই প্রকল্পের প্রকল্প প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা তারই।
গত শুক্রবার বিকেলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছয় বছর ধরে একদল গবেষকের চেষ্টার পর পুনর্জন্ম হয়েছে ঢাকাই মসলিনের। পেয়েছে জিআই সনদও।
ড. মনজুর হোসেন বলেন, 'ইতোমধ্যে অনেক অ্যাপারেল কোম্পানিই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, যারা আসলে বাণিজ্যিকভাবে ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে চায়। তবে এইজন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ঢাকাই মসলিন শাড়ি তৈরির প্রযুক্তির পুনরুদ্ধার প্রকল্পে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের বিষয়ে আসলে কিছুই বলা নাই। প্রথম প্রকল্প ছিল শুধু প্রযুক্তির পুনরুদ্ধার বিষয়ে। আমরা সেখানে ৯৫ শতাংশ সফল হয়েছি। আমরা মসলিনের ছয়টি শাড়ি তৈরি করতে পেরেছি, যা লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে পাওয়া শাড়ির সঙ্গে মোটামুটি মিলে গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকার নিশ্চয় বাণিজ্যকিভাবে উৎপাদনে যাওয়ার প্রকল্প হাতে নিবে।'
প্রথম পর্যায়ে যে ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়েছে, তার একেকটির খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গেলেও ১ লাখ টাকার কম মূল্যে শাড়ি বিক্রয় করা সম্ভব হবে না।
শাড়ি তৈরিতে খরচ বেশি লাগার বিষয়ে মনজুর হোসেন বলেন, '৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি ও তা হাতে বোনা তাঁতে বুনতে চারজন তাঁতির দুই বছরের বেশি সময় লেগে গেছে। এটা এত সূক্ষ্ম যে, অনেক সময় লেগে যায় কাপড় তৈরি করতে। বারবার ছিঁড়ে যায় আবার জোড়া দিতে হয়। কাঁচামাল, শ্রমিকের মজুরি সব মিলিয়ে এই খরচটা পড়বে। তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গেলে তখন খরচ কমে আসবে। তখন তাঁতিরাও আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠবেন। কারণ যত বেশি মসলিন কাপড় তৈরি করা হবে, তত বেশি দক্ষ হবেন তাঁতিরা। তখন আরও উন্নতমানের মসলিন কাপড় তৈরি করা সম্ভব হবে।'
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকাই মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাঠে নেমে পড়েন একদল গবেষক। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত গবেষকদল ছয় বছরের চেষ্টায় পুনরুদ্ধার করেন ঢাকাই মসলিনের ঐতিহ্য।
শুরুতে তাদের হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা ছিল না, ছিল না মসলিন তৈরির সুতা হয় যে ফুটি কার্পাস থেকে- তার চিহ্নও। নেই ফুটি কার্পাসের কোনো চিহ্নও। তবু তারা মসলিন কাপড়ের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে মাঠে নেমে পড়েন।
দীর্ঘ ছয় বছরের চেষ্টায় সফল হন তারা। ১৮৫০ সালে লন্ডনের শেষ প্রদর্শনীর ১৭০ বছর পর বুনে ফেলেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন কাপড়ের শাড়ি। ইতোমধ্যেই তৈরিকৃত ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদন দিয়ে ২৮ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশিত হয়েছে।
এজন্য মসলিন কাপড় ও ফুটি কার্পাস খুঁজে বের করা এবং মসলিন কাপড়ের ডিএনএন সিকোয়েন্সের সঙ্গে তা মেলানো এবং তারপর সুতা থেকে কাপড় তৈরি করতে দীর্ঘ জটিল এক প্রক্রিয়া পার করতে হয়েছে তাদের। এজন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহকৃত ৩৮টি ধরনের তুলার মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে হয়েছে ফুটি কার্পাস, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও ঢাকাই মসলিন তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আয়ুব আলী বলেন, 'সরকারিভাবে যখন গবেষণাকে উন্মুক্ত করা হবে, তারপর সরকার এটাকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের সব ব্যবস্থা তৈরি করে দিলেও এটা বেসরকারি উদ্যোক্তারাই বাণিজ্যিকভাবে মসলিন উৎপাদন করবে। অবশ্য তার জন্য কমপক্ষে দুই বছর লেগে যাবে। এর মধ্যে প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ও তাঁতিদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে ধারাবাহিক উৎপাদনের মধ্য দিয়েই।'
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, 'মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধারে আমরা সফল হয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের পর তার নির্দেশনায় আমরা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাব। তবে কয়েকটি ধাপ মেনেই আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।'