যশোরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে সার বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎ
যশোর-নড়াইল সড়কের হামিদপুর ময়লার ভাগাড়ে যশোর পৌরসভা ১৩ দশমিক ৯৭ একর (প্রায় ৪০ বিঘা) জমিতে তৈরি করেছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন কেন্দ্র। ২৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয় এ কেন্দ্রের কাজ।
৪৭ কর্মী নিয়ে ২০১৯ সালের আগস্টে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন কেন্দ্রটি যাত্রা শুরু করে। দেড় বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছে। এ পর্যন্ত ৮০০ মেট্রিক টন কম্পোস্ট সার উৎপাদিত হয়েছে, যা ৭ টাকা কেজি দরে স্থানীয় কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
একইসঙ্গে, বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন কেন্দ্রেই।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধনের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের নিজস্ব তহবিলের পাশাপাশি সহায়তা দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (কেমফডব্লিউ) এবং সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (সিডা)।
যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন কেন্দ্রকে। ফলে যশোরের বাইরে অন্যান্য সিটি করপোরেশনের জন্যও এটি একটি রোল মডেল বলা হচ্ছে।
বলে রাখা ভালো, এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন প্রকল্প বাংলাদেশে যশোরেই প্রথম। এই কেন্দ্রে দৈনন্দিন জীবনের পচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ করে উৎপাদন করা হচ্ছে জৈবসার, বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎ।
প্রকল্পের সুপারভাইজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সারাদিন পৌরসভার ট্রাকে ট্রাকে বর্জ্য সংগ্রহ করে আনা হয়। প্রতিদিন চাহিদা ৪৫ টন হলেও বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ টন। বর্জ্যগুলো ওজন স্টেশনে ওজন করার পর স্টোরেজে নেওয়া হয়। সেখানে বর্জ্য বাছাই করেন প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মীরা। এরপর সেখান থেকে পচনশীল দ্রব্য, যেমন- তরকারি, ফলমূলের খোসা, ঘাস, পাতা ইত্যাদি যেগুলো জৈব স্যার তৈরির উপযোগী, সেগুলো জৈবসার প্লান্টে চলে যায়। সেখানে মেশিনের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করে জৈবসার প্রস্তুতের জন্যে উপযোগী করা হয়। এগুলো পরে ২৮ দিনের জন্যে উপযুক্ত করা হয়। পরে বয়লার মেশিনে শুকিয়ে ছাকনির মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী জৈবসারে পরিণত করা হয়। এই সারের রঙ ও দানা চায়ের দানার মতো। তারপর প্যাকেটজাত করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়। বাকি অংশ চলে যায় বায়োগ্যাস প্লান্টে।'
তিনি আরও বলেন, 'অপরদিকে, মানুষের বিষ্ঠা থেকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল অংশ ও শুকনো অংশও পৃথক করে বায়োগ্যাস প্লান্টে পাঠানো হয়। এখানে চার থেকে পাঁচ দিন রাখার পর সেখান থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়। অবশিষ্ট থাকা অংশ জৈবসারে ব্যবহৃত হয়। বায়োগ্যাস ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে।'
'বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন কেন্দ্রে এখান তিনটি জেনারেটর রয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কিলোওয়াট আওয়ার। উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্লান্ট এরিয়ায় ব্যবহার হচ্ছে,' বলেন তিনি।
যশোর পৌরসভার সচিব আজমল হোসেন বলেন, 'শহর ও শহরতলী থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্যের একটি বড় অংশ অপচনশীল- প্লাস্টিক ও পলিথিনজাতীয়। এগুলো ফেলা হয় ল্যান্ডফিল্ডে। অথচ দুই বছর আগেও শহরতলীর এই এলাকা ছিল পৌরসভার ডাম্পিং এরিয়া। ময়লার দুর্গন্ধে চারপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে থাকত। মানুষের চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দৃশ্যপট বদলে গেছে।'
'শহর থেকে ময়লা সংগ্রহ করার জন্য আমরা তিনটি এনজিওকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে ডাস্টবিনে ফেলছে। পরে আমাদের কর্মীরা সেখান থেকে সংগ্রহ করে শোধনাগারে পাঠাচ্ছেন,' বলেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্লান্টে জৈবসার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে দৈনিক চার টন। বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে দেড় টন। প্লান্টে দৈনিক ৭২০ কিউবিক মিটার বায়োগ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৪৫০ কিউবিক মিটার। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ৪৩০ কিলোওয়াট আওয়ার। বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ১০০ কিলোওয়াট আওয়ার।
প্রকল্পের সুপারভাইজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'যে পরিমাণ বর্জ্য এখানে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব, সে তুলনায় প্রতিদিন তা আসছে না। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুতে হলে আমাদের দ্বিগুণের বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে।'
যশোর পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু বলেন, 'শত বছরের ময়লার স্তূপ সরিয়ে জায়গাটিকে ব্যবহার উপযোগী করা কঠিন ছিল। সেটি সম্ভব হয়েছে।'
'পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় বর্জ্যের সরবরাহে ঝিকরগাছা ও মনিরামপুর পৌর কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছিল, কিন্তু তারা পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ইতোমধ্যে আমরা সার উৎপাদনে গেছি। আগামিতে এর পরিমাণ বাড়ানো হবে। মুজিববর্ষে সিটি করপোরেশনগুলোকে যশোর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি আমাদের জন্য বড় পাওয়া। অপচনশীল দ্রব্যের বিকল্প ব্যবহারেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে,' বলেন মেয়র।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, 'বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে সম্পদ তৈরির কাজ দেশের মধ্যে যশোরে প্রথম শুরু হয়েছে। এটি সুখকর বিষয়। অন্যান্য জেলার জন্য এটি রোল মডেল হতে পারে। ভারত এই প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যতদূর জানি, ভারত সরকার আমাদের দেশে এই খাতে বিনিয়োগ করতেও আগ্রহী।'
'প্রকল্পের টেকনিক্যাল বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে, সায়েন্টিফিক্যালি যদি করা যায়, তবে আরও ভালো রেজাল্ট আশা করা যায়,' যোগ করেন তিনি।