মিয়ানমার রাজনৈতিক নাটক: কোন পর্ব দেখছেন এখন আপনারা?
১৯৬২ সালে পহেলা মার্চ; রাজধানী ইয়াঙ্গুনের একটি অভিজাত থিয়েটারে ব্যালে নৃত্য পরিবেশন করছিল চীনের একটি দল। জেনারেল নে উইন-সহ শীর্ষ গণ্যমান্যরা অতিথির আসনে বসে সুরাপান আর আলাপচারিতায় ব্যস্ত। নৃত্যানুষ্ঠান শেষে দেহরক্ষীবেস্টিত নে উইনকে বাসভবনে ফিরতে দেখেন সেখানে উপস্থিত অন্য দর্শকেরা।
কিন্তু, স্বাভাবিক সেই দৃশ্য ছিল সকলকে আশ্বস্ত করার এক আড়াল মাত্র। কারণ, তারপরের দিন অর্থাৎ ২ মার্চ নে উইনের নির্দেশে সেনা সদস্যেরা সরকারের শীর্ষ নেতাদের বাসভবনে গিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। সকাল ৮.৫০ নাগাদ সামরিক বাহিনীর হাতে এএফপিএফএল সরকার পতনের ঘোষণা দেন এই জেনারেল। অত্যন্ত গোপনে চলে সমস্ত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। এতটাই গোপনে যে নে উইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং গি নিজেও সে সম্পর্কে জানতেন না। অথচ অভ্যুত্থানের পর দেশ শাসনে গঠিত বিপ্লবী পরিষদে অং গি দ্বিতীয় ক্ষমতাধর পদ পান।
২০২০ সালের নির্বাচনের পরও মিয়ানমারে একই শঙ্কার আবহ দেখা দেয়। রাজনৈতিক মহলে এবং জনগণের মধ্যেও জোর গুঞ্জন ছিল সু চি'কে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে। সেই গুঞ্জন আজ সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) বাস্তবেই রূপ নেয়। তবু ক্ষমতার কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা, তা জানতে হলে ওই সময়ের আগে পরের নানা ঘটনাপ্রবাহ এবং আশা-আশঙ্কার দিকে তাকানো দরকার।
সেনা অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীরা আশা প্রকাশ করেছিলেন, ক্ষমতা দখল করে জেনারেলরা হয়তো দেশকে প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার আগে অন্তত কয়েকবার ভাববেন। তারপরও, যদি তারা সে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে নিজেরাই নিজেদের সমাধি রচনা করবেন।
গণমাধ্যমের নানা সংবাদ সেসময় সেনাবাহিনীর ফিরে আসার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। তাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল গতানুগতিক। গুঞ্জনের প্রেক্ষিতে ওই সময় স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন বলে পরিচিত এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, "সেনাবাহিনী যদি সত্যিকার অর্থেই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে; তাহলে আগে থেকে কোনো আভাস দেওয়া হবে না। আশা করি এবার বুঝতে পারছেন।"
তবে সকলে তাতে আশ্বস্ত হয়নি। কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে অবস্থান করা আমার এক বিদেশি বন্ধু বলেন, মিয়ানমার সব সময়েই অনিশ্চিত। এদেশে রাজনৈতিক নাটকের দর্শকদের সব সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনাকেই দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
প্রবাসী সেই বন্ধুটি এখন মিয়ানমারের বাইরে থাকেন। ক্যুর আগে তিনি আমাকে বলেন: "এই নাটক দেখার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়, বরং তীব্র যন্ত্রণার। পরের দৃশ্যে কী ঘটবে তার অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে পড়েছি। তবে আমি মনে করি, প্রতিটি সঙ্কটের মধ্যেই নিহিত আছে উত্তরণের সুযোগ। আশা করছি এবারের পর্বেও তাই ঘটবে।"
অনিশ্চয়তার মধ্যে ইয়াঙ্গুনে অবস্থিত পশ্চিমা দূতাবাসগুলো বিবৃতি দিয়ে "মিয়ানমারে ক্ষমতার গণতান্ত্রিক পালাবদল, শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টার প্রতি জোর সমর্থন" পুনর্ব্যক্ত করে।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, "পহেলা ফেব্রুয়ারি আমরা পার্লামেন্টের শান্তিপূর্ণ অধিবেশন দেখার প্রত্যাশা করি। আমাদের বিশ্বাস এদিন নতুন প্রেসিডেন্ট এবং স্পিকার নির্বাচিত হবেন। আমরা নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করছি।"
বিদেশি দুতাবাসগুলোর বিবৃতিটি ছিল মিয়ানমারের সিংহভাগ মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন।
ওই সময় আমি বলেছিলাম, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো হুমকি এলে; অং সান সু চি দেশের জনসাধারণ এবং আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে সমর্থন পাবেন। দেশের ভেতরেও বাড়বে তার জনপ্রিয়তা। ফলে সু চি এবং তার শাসক দলের মর্যাদা এমন বাড়বে; যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ শুনতে চাইবে না। সু চি নিজে কিছু না করেই পাবেন সেই সমর্থন।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে ব্যবসা করে অতি-ধনী হয়ে ওঠা এক ব্যবসায়ীও বলেন, "সবকিছু দেখেশুনে আমি প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী জঘন্য এবং এর বেশি কিছু আমার বলার নেই।"
তার এই দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা খুব সহজ।
২৮ জানুয়ারি রাতে সু চি তার দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিজ বাসভবনে এক জরুরি বৈঠক করেন। আলোচনার মূল ইস্যু ছিল উদ্ভূত সঙ্কট।
বৈঠকে সু চি জানান, ভোট পুনঃগণনা, পহেলা ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত এবং ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে সেনাবাহিনীর পক্ষে করা দাবির বিরোধিতা করেছেন তিনি। এই অবস্থায়, আসন্ন যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে তিনি সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
রাজনীতিবিদ হিসেবে সু চি'র অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। তিনি দীর্ঘকাল গৃহবন্দিত্ব এবং নজরদারির মধ্যে কাটিয়েছেন। গ্রামীণ এলাকায় ভ্রমণের সময় বেঁচে ফিরেছেন প্রাণনাশের চেষ্টা থেকেও। সহ্য করেছেন হাজারো অপমান-গঞ্জনা। আজ সোমবারের ক্যু'র আগে তিনিই ছিলেন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। ৭৫ বছর বয়সী এই স্টেট কাউন্সিলর ঠাণ্ডামাথায় বুঝেশুনে ধৈর্যের সামনে সঙ্কট সামলাবেন, তেমনটাই প্রত্যাশা করেন মিয়ানমারবাসী।
কিন্তু, তা আর হলো কৈ? সেনাবাহিনী সু চি'কে ভুল করার সুযোগ না দিয়ে, ক্ষমতা দখল করে বসলো। ফলে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য, তিনি সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাতেই পারেন। বহিঃবিশ্বও এখন তার পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো; সেনা শাসন নিয়ে সাধারণ বার্মিজদের উদ্বেগ। ২৯ জানুয়ারি সকালে আমার এক বন্ধু চ্যাট বক্সে একটি বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সেনাবাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখল করলে, নতুন করে আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধের কারণে; দেশবাসীর অর্থনৈতিক সংগ্রাম এবং দারিদ্র চরম আকার ধারণ করবে। মহামারির মধ্যে সেনাবাহিনী এমন ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন।
আমার সেই বন্ধুটি কোনো সাংবাদিক নন, তবে স্বশিক্ষিত একজন নাগরিক মাত্র। তিনি নিজের বিশ্লেষণ স্পষ্ট তুলে ধরে বলেন, "অভ্যুত্থান হলে রাশিয়া জিতবে। কারণ, সেনাবাহিনী রাশিয়া থেকে আরও অস্ত্র কেনার পরিকল্পনা করছে।"
জবাবে আমি বলেছিলাম, রাশিয়া আমাদের দেশ নিয়ে এতটা ভাবে না'
বন্ধুটি জবাব দিলেন: কিন্তু তাহলে চীন হারবে……'
এবং সবচেয়ে বড় কথা ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হবে।
এরপর তিনি আবার লিখলেন, 'ক্যু হলে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সেনাবাহিনীর সহযোগী অনেক ব্যবসায়ী এবং তাদের সন্তানেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে'
'তারপর কী হবে?' জিজ্ঞাসা করতে বললেন, "ক্যু'র মধ্য দিয়ে চীনের বিআরআই উদ্যোগের অস্থিতিশীল সহযোগিতে পরিণত হবে মিয়ানমার।
ভার্চুয়াল এই বার্তা বিনিময়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়; শিক্ষিত মানুষ এখন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলের পেছনে বিদেশি শক্তিগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে স্বচ্ছ বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখেন। তবে সচেতন বন্ধুটির ধারণা অনুযায়ী, চীনের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হলে; অভ্যুত্থানের সুফল জেনারেলরা নিশ্চিন্তে ভোগ করতে পারবেন না। বরং ভেতরে- বাইরে নানামুখী চাপ মোকাবিলা করে তাদের ক্ষমতায় থাকতে হবে। আজ ১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা প্রবাহ নিশ্চিত জানিয়ে দিল; তারা সেই চ্যালেঞ্জকেই গ্রহণ করলেন।
- লেখক: মিয়ানমারের ইংরেজি ভাষার গণমাধ্যম দ্য ইরাবতীর প্রতিষ্ঠাতা এডিটর-ইন-চিফ
- সূত্র: দ্য ইরাবতী