বক্সার লিওন স্পিংকসের বিদায়
১৯৭৮ সালে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপে ইতিহাসের অন্যতম সেরা আপসেট স্কোরের মাধ্যমে মোহাম্মদ আলীকে হারিয়ে দেওয়া বক্সার লিওন স্পিংকস গত শুক্রবার নেভাডার হেন্ডারসনের এক হাসপাতালে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
ঐতিহাসিক সেই ম্যাচে মোহাম্মদ আলীকে হারিয়ে দিলেও তার ঠিক সাত মাস পর নিজের মুকুট হারান স্পিংকস।
এক বিবৃতিতে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার স্ত্রী ব্রেন্ডা গ্লার স্পিংকস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্পিংকসের প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল তার পরিবার৷ ক্যান্সার তার ব্লাডারেও ছড়িয়ে পড়েছিল। আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি।
১৯৭৬ সালের মনট্রিল অলিম্পিকে স্পিংকস লাইট- হেভিওয়েটে স্বর্ণপদক জেতার পর আলোচনায় আসেন। একই বছর তার ভাই মাইকেল মিডলওয়েট বিভাগে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।
পেশাদার বক্সিং-এ মাত্র সাতটি ম্যাচ খেলেছেন লিওন। এর ছয়টিতে তিনি জয় পান, অন্যটি ড্র হয়। ১৯৭৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লাস ভেগাস হিল্টনে মোহাম্মদ আলীর মুখোমুখি হন তিনি।
ওয়ার্ল্ড বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন ও ওয়ার্ল্ড বক্সিং কাউন্সিলের শিরোপা তখন আলীর ঝুলিতে।
স্পিংকস তার প্রেশার ফাইটিং এর কৌশল অবলম্বন করলে, আলী রোপ-এ-ডোপ কৌশলের আশ্রয় নেন। প্রতিপক্ষকে ক্রমাগত আক্রমণের সুযোগ দিয়ে প্রতিপক্ষ ক্লান্ত হয়ে গেলে তার সুযোগ নেওয়াই রোপ-এ-ডোপ কৌশল। তবে লিওন এক্ষেত্রে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করেন।
আলী ১৫ রাউন্ড পর্যন্ত পৌঁছালেও স্প্লিট ডিসিশনে জিতে যান লিওন।
ম্যাচ শেষে আলীর ডান চোখের ওপরে ও নিচে বেগুনি কালশিটে দেখা যায়। বাম চোখ বরাবর তার কপাল ফুলে গিয়েছিল, ঠোঁট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।
খেলা শেষে আলী বলেছিলেন, "জেতার ইচ্ছা ও শক্তি দুটোই আছে ওর। বেশ জোরেশোরেই আঘাত করেছে।"
ম্যাচের কদিন পরই ফাঁকা দাতের হাসির পরিচিত লিওনকে দেখা যায় স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের প্রচ্ছদে।
১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে লিওনকে হারিয়ে নিজের ডব্লিউ.বি.এ খেতাব ফিরে পান আলী। সে ম্যাচে প্রায় ৬৩ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিল।
১৯৮১ সালে ওয়ার্ল্ড বক্সিং কাউন্সিলের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন ল্যারি হোমস। সেবছর জুনে তৃতীয় রাউন্ডে টেকনিক্যাল নকআউটে ল্যারির কাছে হেরে যান লিওন। ১৯৮৬ সালে ডব্লিওবিএ ক্রুজারওওয়েট চ্যাম্পিয়ন ডুইট মোহাম্মদ কাওয়ি'র কাছে নবম রাউন্ডে টেকনিক্যাল নকআউটে হেরে যান লিওন।
সেসময়ে তার ক্যারিয়ার তলানিতে ঠেকে, প্রশিক্ষণের সময় পার্টি করার উদাহরণ হয়ে ওঠেন তিনি।
ল্যারি হোমসের বিপক্ষে ম্যাচের আগে লিওনের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রশিক্ষক স্যাম সলোমন আলীর সাথে তার ম্যাচের সময়কার ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন।
"সে রাতে তার রুমে ঢুকে জোরে গান ছেড়ে দিত ও দরজা বন্ধ করে রাখতো। তুষারে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই শুধু তার দেখা মিলতো।" নিউইয়র্ক টাইমকে বলেছিলেন স্যাম।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন লিওন। ফ্রেড হুপের বিপরীতে সে ম্যাচেও হেরে যান লিওন। সেসময় লিওনের বয়স ছিল ৪৩, ফ্রেডের ৪৫।
২৬টি জয়, ১৭ পরাজয় ও তিনটি ড্র নিয়ে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন লিওন স্পিংকস।
১৯৫৩ সালের ১১ জুলাই সেন্ট লুইসে জন্মগ্রহণ করেন লিওন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শৈশবেই তার বাবা-মা'র বিচ্ছেদ হয়। তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল করুণ, বেড়ে ওঠার পরিবেশও ছিল বেশ প্রতিকূল। ছোটবেলায় বাবার হাতে মারধোরের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
নিম্ন রক্তচাপ ও হাঁপানির মতো সমস্যায় ভোগা কোমল চরিত্রের এই ইয়াংস্টার অনেকের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সেন্ট লুইসের একটি জিমনেসিয়ামে বক্সিং শুরু করেন তিনি। অল্প বয়সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি টেনে মেরিনসের বক্সিং প্রোগ্রামে যোগ দেন।
বক্সিং থেকে অবসরের পরও বেশ টানা পোড়নে জীবন কাটে তার। উপার্জিত সব অর্থ হারিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে কাজের সন্ধানে নামেন তিনি। ৫২ বছর বয়সে ইন্ডিয়ানার কলাম্বাসে ওয়াই.এম.সি.এ'র কাস্টোডিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন।
মোহাম্মদ আলীকে হারিয়ে দেওয়ার রাতে লিওন বলেছিলেন, তিনি তার শৈশবের প্রতিকূলতাকে শক্তিকে রূপান্তর করেছেন।
"আমার বাবা সবসময় মানুষকে বলে বেড়াতেন আমি কখনোই কিছু করতে পারবো না। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, কখনোই ভুলিনি এসব। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি কিছু একটা হয়ে উঠবো। এজন্য আমাকে যে মূল্যই দিতে হয়েছে, দিনশেষে আমি সফল হয়েছি।" স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডে ছাপা হয়েছিল তার এই করুণ কাহিনীর অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি।