করোনার প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে নাটোরের ওষুধি গ্রাম
নাটোরের খোলাবাড়ীয়া গ্রামের কৃষক হাসান আলী ভূঁইয়া। তিনি তার আড়াই বিঘা জমিতে গত আট বছর ধরে এলোভেরা চাষাবাদ করেন। প্রতিবছর তার আড়াই বিঘা জমি থেকে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার এলোভেরার পাতা বিক্রি হয়। প্রতি মাসেই ২০ থেকে ২২ দিন পরপর গাছ থেকে কেটে এলোভেরার পাতা বাজারে বিক্রি করা যায়। কিন্তু গতবছর করোনার কারণে তিনি কোনো পাতা বিক্রি করতে পারেননি। এলোভেরার গাছ টিকিয়ে রাখতে প্রতি মাসেই পাতা কেটে গর্তে পুঁতে ফেলতে হয়েছে তাকে।
বুধবার (২০ জানুয়ারি) দুপুরে জমিতে এলোভেরার পরিচর্যার সময় এই প্রতিবেদকের সাথে তার কথা হয়। তিনি পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এলোভেরা গাছে স্প্রের মাধ্যমে চুন প্রয়োগ করছিলেন।
তিনি জানান, প্রতি মাসেই ২০ থেকে ২২ দিন পর পর গাছ থেকে ২২ গাড়ি এলোভেরার পাতা পাওয়া যায়। এক গাড়িতে সাড়ে ৭ মণ এলোভেরার পাতা হয়। কিন্তু এ বছর বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় গাছে পাতা কম আসছে। এইজন্য পাতা কম উঠছে। বেশিরভাগ পাতা এখনো বড় হয়নি। এইজন্য দামও কম পাওয়া যাচ্ছে। আগে যেখানে এক গাড়ি এলোভেরার পাতা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এখন সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৫০০০ থেকে ৫২০০ টাকায়। গত সপ্তাহে এই দামে বিক্রি করেছি। তবে দিন যত গড়াবে দাম তত বাড়বে বলে জানান তিনি। তখন পাতাও বেশি পাওয়া যাবে। এক বিঘা জমিতে বছরে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিক টন এলোভেরার পাতা পাওয়া যায়।
ওষুধি গ্রামের এরকম শত শত কৃষক যারা এলোভেরা চাষ করেন তারা গতবছর করোনার কারণে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে ক্ষতি কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তারা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্নস্থানেও যাচ্ছে এলোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজ ওষুধি পণ্য।
কৃষকরা জানান, এলোভেরার পাতা বর্ষাকালে বেশি পাওয়া যায়। তবে তখন পচনও ধরে বেশি। গাছ থেকে পাতা কাটার পর দুই একদিনের বেশি সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। তবে শুকনোকালে এলোভেরার পাতা এক সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়। পাতা সংরক্ষণের জন্য কৃষকরা সরকারের প্রতি হিমাগার স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
খোলাবাড়ীয়া ওষুধি গ্রামের কৃষক মোস্তফা কামাল ২১ বিঘা জমিতে এলোভেরার চাষাবাদ করেন।
তিনি জানান, 'এলোভেরার পাতা সংরক্ষণ করে রাখা কঠিন। সংরক্ষণের অভাবে অনেক পাতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু উপায় তো নাই এভাবেই পাতা বিক্রি করা হয়। তবে আমার সব এলোভেরার পাতা ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত তাইওয়ান ফুড কোম্পানি কিনে নেয়'।
ওষুধি গ্রামে এলোভেরার চাষাবাদ বেশি পরিমাণে হয়। এছাড়া শিমুল মূল, অর্শগন্ধা, তুলসীপাতা, বাসক, মিছরি দানা, কালোমেঘ, শতমূলসহ বিভিন্ন প্রজাতির ওষুধি গাছের চাষাবাদ করেন কৃষকরা। খোলাবাড়ীয়া গ্রামের সড়কের দুই পাশের জমিতে, বসতবাড়ির আঙিনায়, পুকুরপাড়ে প্রচুর ওষুধি গাছের চাষাবাদ হয়।
এলোভেরার জন্য হিমাগার প্রয়োজন হলেও অন্যান্য ভেষজ ওষুধি গাছের জন্য হিমাগারের প্রয়োজন খুব একটা হয় না। তবে নায্য দাম পাওয়া নিয়ে অভিযোগ করলেন চাষীরা।
খোলাবাড়ীয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল আলিম দুই বিঘা জমিতে শিমুল মুলের চাষাবাদ করেছেন। শিমুলমূল একটি জমিতে বছরে একবারই চাষাবাদ করা যায়।
তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে ৫০ থেকে ৬০ মণ শিমুল মূল উৎপাদন হয়। কাঁচা শিমুল মূল বিক্রি হয় ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকা মণ আর শুকনো শিমুল মূল বিক্রি হয় ৪০০০ থেকে ৮০০০ টাকায়। এক বিঘাতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যান্য বছর আরও বেশি দামে বিক্রি হতো। এ বছর দাম কিছুটা কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে অর্শগন্ধার দাম বেশি। ৩০ হাজার টাকা মণে অর্শগন্ধা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া এলোভেরার পাতা স্থানীয় বাজারে যেখানে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় সেখানে তাইওয়ান ফুড মানভেদে এলোভেরার পাতা কেনার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৩ টাকা আর ৭ টাকা কেজি। অন্যান্য কোম্পানিও যদি বেশি পরিমাণে কিনতো তবে কৃষকরা আরও দাম বেশি পেত।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া গ্রামে প্রায় ১৪০ প্রজাতির ভেষজ ওষুধি গাছ গাছড়ার চাষাবাদ করে থাকেন কৃষকরা। প্রায় ১৫০ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ ১১২৫ বিঘা জমিতে এসব ওষুধি গাছের চাষাবাদ হয়। বছরে মোট ১৫ হাজার ৭১৯ মেট্রিক টন ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হয় এলোভেরা। ৫২৫ বিঘা জমিতে চাষ হয় এলোভেরা। বছরে ১৪ হাজার ১৪০ মেট্রিক টন এলোভেরার পাতা উৎপাদন হয়। এরপর সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় শিমুল মূল। ৪১৩ বিঘা জমিতে শিমুল মূল চাষাবাদ হয়। বছরে ১৩২০ মেট্রিক টন শিমুল মূল উৎপাদন হয়। এছাড়া অর্শগন্ধা ৩৮ বিঘা জমিতে, মিছরিদানা ৩৭ বিঘা জমিতে চাষাবাদ হয়। এছাড়া কালোমেঘ, তুলসীপাতা, শতমূল, বাসকসহ অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদ ১১৩ বিঘা জমিতে চাষাবাদ হয়। প্রতিবছর লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের ১৫ টি গ্রাম থেকে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার ভেষজ উদ্ভিদের বেচাকেনা হয়।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার জানান, ওষুধি গ্রামের কৃষকদের জন্য আলাদাভাবে কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। সব কৃষকদের জন্য যে ধরনের প্রণোদনা তাদের জন্যও একই ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা।
কারা কেনেন ও কোথায় বিক্রয় হয়
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৪৫ বছর আগে নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন আফাজ উদ্দিন। পাশাপাশি কবিরাজি চিকিৎসাও শুরু করেন তিনি। এলাকার সবাই তাকে আফাজ পাগলা নামে চেনে। তিনি নিজে ঔষধি গাছ চাষ করেই থেমে থাকেননি, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলেন ভেষজ উদ্ভিদ চাষে। প্রথমে কেউ গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, এটি লাভজনক। পরে অন্যরাও ভেষজ চাষে যুক্ত হন।
এভাবে ওষুধি গাছের চাষ বাড়তে থাকে। এভাবেই এই গ্রাম সারা দেশে ওষুধি গ্রাম হিসেবে পরিচিত পায়। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আফাজ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন।
নাটোর জেলা প্রশাসনের বরাতে বলা হয়েছে, নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের প্রায় ১৫ টি গ্রাম নিয়ে ওষুধি গ্রাম অবস্থিত। ওষুধি গ্রামের নামকরণের কারণ হচ্ছে এসব গ্রামের কৃষকরা সমিতির মাধ্যমে অধিকাংশ কৃষিজমি ও বাড়ির আঙিনার আশেপাশে ব্যাপক হারে বিভিন্ন প্রকারের ৩০০ প্রজাতির ওষুধি গাছ গাছড়ার চাষাবাদ করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্নস্থানে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করে থাকে।
আফাজ উদ্দিন মারা গেলেও ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদের সাথে সাথে বেড়েছে কবিরাজী চিকিৎসাও। লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের আশেরপাশের গ্রাম মিলে প্রায় ৫০টির মতো কবিরাজী দাওয়াখানা আছে। এইসব এলাকার প্রায় সবাই কবিরাজী পেশার সাথে জড়িত।
লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়ার আমিরগঞ্জ ও লক্ষীপুর বাজার মিলে ১৫টির মতো ভেষজ উদ্ভিদের বেচাকেনার দোকানও রয়েছে। এসব দোকান থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্নস্থানে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রি করে পাঠানো হয়। তবে এলোভেরার কাচামাল ট্রাক ভর্তি করে দেশের বিভিন্নস্থানে যায়। এছাড়া তাইওয়ান ফুড, হামদর্দ, স্কয়ার, একমি, জেনিম, প্রাণসহ প্রায় ১২ টি কোম্পানি কৃষকদের কাছ থেকে ওষুধি কাঁচামাল কিনেন। এর মধ্যে স্কয়ার শুধু অর্শগন্ধা কেনেন। তাইওয়ান কিনে সবচেয়ে বেশি এলোভেরা। আর নিজ উদ্যোগে দেশের বিভিন্নস্থানে ১০০০ জন হকার ফেরি করে ঔষুধি পণ্য বিক্রি করে থাকেন।
কৃষকদের অভিযোগ সব কোম্পানিই তাদের কসমেটিকস পণ্যে এলোভেরা ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু তারা আমাদের মতো কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য না কিনে ভারত থেকে আমদানি করেন। এতে কৃষকরা তাদের নায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
খোলাবাড়িয়া ওষুধি গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন জানান, বিভিন্ন ভেষজ ওষুধি গাছগাছড়া দেশের বিভিন্নস্থানসহ এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই যায়। এছাড়া ১০০০ জন হকারের মাধ্যমে ওষুধি পণ্য দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্রি হয়। বিভিন্ন কোম্পানিও ওষুধি কাঁচামাল কিনেন। সব কোম্পানি ওষুধি পণ্য কিনলে কৃষকরা তাদের পণ্যের নায্যমূল্য পেতেন।