রোগ ও সোস্যাল স্টিগমার সঙ্গে লড়তে হয় শিশু ডায়াবেটিস রোগীদের
বয়স যখন আট, সেই সময়ই ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় সাদিয়া জান্নাতের। ২৩ বছরের জীবনের ১৫ বছর ধরেই রোগটিকে সঙ্গী করে চলতে হচ্ছে তাকে। ডায়াবেটিস শনাক্তের পর থেকেই আত্মীয়-পরিজন ও স্কুলে নানা বৈষম্যের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। ডায়াবেটিসের ইনসুলিনকে মাদক ভেবে কলেজের হোস্টেল কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশের হাতেও তুলে দিয়েছিল!
এতসব বাধা ডিঙিয়েই এলএলবি শেষ করেছেন সাদিয়া। এখন কোর্টে প্রাকটিস করছেন বটে, তবে সামাজিক স্টিগমা তার পিছু ছাড়েনি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় বিয়ে নিয়েও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাকে।
সাদিয়ার মতো শৈশবে ডায়াবেটিসের কারণে স্টিগমার শিকার হয়েছেন তাজুল ইসলাম মুন্সি (২৭)। ২০১০ সালে কলেজে পড়ার সময় টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় তার। তখন থেকেই শুরু হয় ডায়াবেটিসের পাশাপাশি সমাজের সঙ্গেও যুদ্ধ তার। আত্মীয়রা বলতেন, বেশিদিন বাঁচবেন না তাজুল। বন্ধুরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। সবার কাছ থেকে তাকে লুকিয়ে রাখতেন বাবা-মা। আর লুকিয়েই ইনসুলিস নিতে হতো তাকে।
দেশে বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছে। তবে বড়দের ডায়াবেটিসে সমাজ অভ্যস্ত হলেও শিশু ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি এখনো। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের রোগের পাশাপাশি সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। শিশুরা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে ভোগে বলে তাদের নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়। ইনসুলিন নেওয়ার সময় সমাজের বিভিন্ন ধরনের বাধার শিকার হতে হয়। সামাজিক স্টিগমার শিকার না হলে ইনসুলিন নিয়ে ও হেলদি লাইফ স্টাইল লিড করে শিশু ডায়াবেটিসে ভোগা রোগীরা সুন্দর জীবন গড়তে পারে। কিন্তু সামাজিক স্টিগমা তাদের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাদিয়া জান্নাত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। স্কুলের শিক্ষকেরা মনে করতেন এটি ছোঁয়োচে রোগ। আমার সঙ্গে ক্লাসে কেউ বসত না। শিক্ষক ও বন্ধুদের অমানবিক আচরণের কারণে এক বছর পড়াশোনা থেকে দূরে ছিলাম। পরে আবার শুরু করলেও ইউনিভার্সিটিতে পড়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে।'
সাদিয়া জান্নাত আরও বলেন, 'ছোটবেলায় ডায়াবেটিস শনাক্তের পর আত্মীয়রা মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো খাবারও খাওয়াতে এসেছিল আমাকে। সবার এমন আচরণ দেখে প্রতি রাতে সত্যি ভাবতাম, আমি বোধহয় সকালের আগেই মরে যাব।'
'পড়াশোনা শেষ করে জীবন অনেক বদলে গেলে এখন আমি মনে করি, ডায়াবেটিস অভিশাপ নয়, বরং আমাকে রুটিন লাইফ লিডে সহায়তা করছে। কিন্তু এখন বারবার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে দেখে আবার ছোটবেলার মতো স্টিগমা ও বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা দেখতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ১৭ হাজার শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ টাইপ-১ এবং ২০ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
তবে রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালের তথ্য বলছে, শুধু ৭ হাজার ৮০০ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুর তালিকা রয়েছে, যাদের বয়স শূন্য থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত। প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ শিশু।
চিকিৎসকরা জানান, টাইপ-১ ডায়াবেটিস শিশু-কিশোরদের জন্য সবচেয়ে কমন টাইপ। এর কারণ অবশ্য এখনো অজানা।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, 'শিশু যদি বারবার পানি পান করে এবং প্রস্রাব করতে থাকে অথবা অল্প সময়ে হঠাৎ করে তার ওজন কমে যায়, সেটা শিশুর এক বছর পর থেকে যে কোনো সময় দেখা দিতে পারে, তখন দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সবার আগে জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা যায়। এজন্য সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।'
এদিকে, তাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাকে সময় আতঙ্কে থাকতে হতো, আমি যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত- সেটি কেউ জেনে যায় কি না। বাইরে গেলে আমি বাথরুমে গিয়ে ইনসুলিন নিতাম। আমার মা সবসময় কান্নাকাটি করতেন।'
২০১২ সাল থেকে তাজুল সিডিআইসি (চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রাম) এবং এরপর এলএফএসি (লাইফ ফর অ্যা চাইল্ড) প্রোগ্রামের অধীনে ডা. বেদোয়ারা জাবীনের অধীনে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখানে কাউন্সিলিংয়ের পর তিনি বেঁচে থাকার উৎসাহ ফিরে পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশে অনার্স-মাস্টার্স করে তাজুল ইসলাম এখন সরকারের ডিফেন্স ফিন্যান্স ডিপার্ডমেন্ট, অডিটর হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় চান্স পেয়ে এখন ভাইভার জন্য অপেক্ষা করছেন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ইয়াং লিডার ইন ডায়াবেটিস প্রোগ্রামেও কাজ করছেন তিনি। এখানে শিশু ডায়াবেটিসের বিষয়ে কাউন্সিলিং করান।
তাজুল ইসলাম বলেন, 'দেশে শিশুদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষের ধারণা না থাকায় বড়দের ডায়াবেটিস বা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলে মানুষের কিডনি, হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু টাইপ-১ ডায়াবেটিস তা নয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে মানুষের শরীরে যে হরমোনটা তৈরি হয় না, ইনসুলিন দিয়ে সেই হরমোন কৃত্রিমভাবে নিলেই সবাই স্বাভাবিকতভাবে বাঁচতে পারে। কিন্তু সমাজ সেটি বুঝতে চায় না। তারা সান্ত্বনা দেওয়ার নামে ডায়াবেটিসে ভোগা একটি শিশুর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকেই মেরে ফেলে।'
ডা. বেদোয়ারা জাবীন বলেন, 'টাইপ-১ ডায়াবেটিসের জন্য ইনসুলিন হিউম্যান রাইট। ইনসুলিন নিয়ে হেলদি জীবনযাপন করলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীরাও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সরকার ফ্রি ইনসুলিন দিতে চেয়েছে, দ্রুত সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের স্কুলগুলো এখনো ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুদের প্রতি মানবিক নয়। স্কুলে শিশুদের নিয়ম করে ইনসুলিন দেওয়ার সুযোগ থাকে না। শিশুদের স্বার্থে স্কুলগুলোতে স্টাফ থেকে শিক্ষক- সবাইকে শিশু ডায়াবেটিসের বিষয়ে ধারণা দিতে হবে, যাতে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুরা স্কুলে তাদের উপযোগী পরিবেশে বড় হয়।'
'প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সমাজকেও বোঝাতে হবে, শিশু ডায়াবেটিস রোগীরাও সুস্থভাবে বাঁচতে ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে,' বলেন তিনি।