ফেসবুক ‘আনফ্রেন্ড’ করল অস্ট্রেলিয়াকে: নিউজ সাইটের জায়গায় অন্ধকার!
বৃহস্পতিবার সকালটা অন্যান্য দিনের মতই শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াবাসীর জন্য। কিন্তু তাদের টনক নড়ল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঢোকার পর। অচিরেই বুঝলেন, ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে সব ধরণের নিউজ কনটেন্ট দেখা বা শেয়ারের অপশনটি তাদের জন্য ব্লক করে দেয়া হয়েছে। এই নাটকীয় পদক্ষেপে অস্ট্রেলিয়াবাসী শুধু অবাকই হননি, চটেছেন সরকারের ওপরেও।
সংবাদ প্রযোজক, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার সমর্থকরা এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন; তাদের মূল ক্ষোভের জায়গা, খবরের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, জরুরি সেবা ও অন্যান্য খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পে'জের প্রবেশাধিকারও ব্লক করে রাখা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, "যেভাবে ফেসবুক আজ অস্ট্রেলিয়াকে 'আনফ্রেন্ড' করল, এবং এর ফলে যেভাবে স্বাস্থ্য এবং জরুরী সেবাগুলো ব্যাহত হলো, তা শুধু উদ্ধতই নয়, হতাশাজনক"।
"এই ধরণের পদক্ষেপ কেবলমাত্র বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান উদ্বেগকেই নির্দেশ করে, যারা নিজেদের সরকারের চেয়ে বড় মনে করে এবং ভাবে যে তাদের ওপর কোন ধরণের বিধি-বিধান আরোপিত হবে না। "
ফেসবুকের এই পদক্ষেপ গুগলের সাথে তার বিভাজনকেও নির্দেশ করে; উভয় প্ল্যাটফর্মই আইনটির বিরোধিতা করে আসছিল। উভয়েই অস্ট্রেলিয়াতে নিজেদের পরিষেবা বন্ধের হুমকি দিয়েছিল, তাদের যুক্তি ছিল এ আইনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের কাজের ধারা প্রতিফলিত হয় না। ফেসবুক আজ অস্ট্রেলিয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য সংবাদ আধেয় দেখা বা তা শেয়ার করার সুযোগ আটকে দিয়েছে অন্যদিকে গুগল এখন পর্যন্ত স্বতপ্রণোদিত কিছু চুক্তি বাতিল বা পুনরুদ্ধার করেছে কেবল।
ঠিক একদিন আগেই মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের নিউজ করপোরেশন জানিয়েছিল, 'উল্লেখযোগ্য পারিশ্রমিকের' বিনিময়ে বিভিন্ন সংবাদ ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কনটেন্ট প্রকাশ করার জন্য গুগল রাজি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ফেসবুকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্তব্য করতে গুগল অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান আইন অনুসারে, এখন থেকে ফেসবুক এবং গুগলকে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাথে বাণিজ্যিক চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রয়োজন হবে ।
তবে এক বিবৃতিতে ফেসবুক জানিয়েছে, এই আইন ফেসবুক এবং প্রকাশকদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করবে। তারা এটিও উল্লেখ করে যে, এমন আইনের ফলে তাদের অস্ট্রেলীয় আইনটির প্রতি পুরোপুরি অনুগত অথবা নিউজ কন্টেন্ট ব্লক করার মত তিক্ত সিদ্ধান্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
টেক জায়ান্টটি দাবি করে, তাদের ওয়েবসাইটটিতে মাত্র ৪ শতাংশই নিউজ কন্টেন্ট থাকে, যদিও অস্ট্রেলিয়াতে সংবাদ সরবরাহের ক্ষেত্রে ফেসবুকের ভূমিকা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
২০২০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যানবেরার এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২১% অস্ট্রেলীয় সংবাদের প্রাইমারি উৎস হিসেবে ফেসবুকের ব্যবহার করে থাকে, যা এর আগের বছরের চাইতে তিন শতাংশ বেশি। ৩৯% মানুষ সংবাদ গ্রহণের জন্য ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল।
একই সমীক্ষায় উঠে আসে যে, অস্ট্রেলীয় নিউজ ভিডিও গুলোর ২৯% ফেসবুকের মাধ্যমেই মানুষের কাছে পৌঁছে।
নিউজ কর্পোরেশনের একজন মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এ বিষয়ে মন্তব্য করার অনুরোধে সাড়া দেননি। তবে নিউজ কর্পের প্রধান অস্ট্রেলীয় নিউজ সাইটে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, "সংবাদ পেতে আপনার ফেসবুকের দরকার নেই"। পাশেই প্রতিষ্ঠানটির স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশানের লিংক ছিল!
সংবাদের স্থান পুরোপুরি ফাঁকা
দেশটিতে এমন এক সময়ে এ ঘটনা ঘটল যখন দেশব্যাপী কোভিড-১৯ এর টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার আর তিন দিন বাকি।
দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদক এবং নাইন এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের মালিক লিসা ডেভিস টুইট করেন,"ফেসবুক এখন ভুল তথ্য, বিপজ্জনক উগ্রবাদ এবং বাক স্বাধীনতার নামে সহিংসতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্র তৈরীর একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে"।
নাইন কোম্পানি এবং নিউজ কর্পোরেশনের ফেসবুক পেজ দুটি মিলে অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্র বাজারের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এছাড়াও রয়েছে সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কেন্দ্রীয় তথ্য উৎস হিসাবে কাজ করে - বলাই বাহুল্য এ সবগুলো পে'জ ফাঁকা ছিল।
এছাড়াও গরমের সময় করোনাভাইরাস মহামারী এবং দাবানল নিয়ে যেসব দাতব্য সংস্থা এবং বেসরকারী সংস্থা পরামর্শ দিয়েছিল তাদের অ্যাকাউন্টসহ বেশ কয়েকটি বড় রাজ্য সরকারের অ্যাকাউন্টের ওপরে এর প্রভাব আজকের সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে।
কিছু পে'জ ফিরে এসেছে
দুপুরের মাঝামাঝি নাগাদ, বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ফেসবুক পে'জ পুনরুদ্ধার করা গেছে তবে কিছু দাতব্য সংস্থার ফেসবুক পে'জ এবং নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, নিউজ কর্পের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং রয়টার্সের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সাইটগুলো তখনো অন্ধকারে থেকে গেছে!
পরিস্থিতি সম্পর্কে ফেসবুকের অস্ট্রেলীয় একজন মুখপাত্রের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
পরবর্তীতে ফেসবুকের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, এই নিষেধাজ্ঞার কোন প্রভাব সরকারি পে'জগুলোর ওপর পড়া উচিত নয়। তবে "যেহেতু এ আইনে সংবাদের বিষয়বস্তুর সংজ্ঞা সম্পর্কে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা সরবরাহ করা হয়নি, ফলে আমরা একটি বিস্তৃত সংজ্ঞা বেছে নিয়েছি"।
পুনরুদ্ধার করার আগে অস্ট্রেলিয়ায় ফেসবুকের নিজস্ব পেজটিই কয়েক ঘন্টা বন্ধ ছিল।
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার ঘটনায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, "এটি খুবই উদ্বেগজনক এবং বিপজ্জনক। এভাবে রাতের আঁধারে পুরো একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রাপ্তির অধিকার যেভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলো তা পুরোপুরি বিবেকবর্জিত।"