‘আমি বাংলাদেশি, কিন্তু আমার ভাষা বাংলা না’
প্রশাসনিকভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও, সামাজিকভাবে বিহারীরা অবহেলিত। বিশেষ করে, মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে তারা আজও বৈষম্যের স্বীকার বলে মনে করেন ৫ লাখ মানুষের এই জনগোষ্ঠীর তরুণ প্রজন্ম।
দীর্ঘ সাইত্রিশ বছর স্বাধীন বাংলাদেশে অমীমাংসিত অবস্থায় আটকে থাকার পর এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের আদেশে ২০০৮ সালে সকল উর্দুভাষী বিহারীদের নাগরিকত্ব তথা ভোটাধিকার প্রদান করা হয়।
নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর কাছে উর্দুভাষী তরুণ প্রজন্মের অনুভূতি তুলে ধরে উর্দুভাষী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি মোঃ ইমরান খান বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু বিষয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও, পাঠ্যক্রমে কোথাও আমাদের মাতৃভাষার চর্চার সুযোগ নেই। মিরপুরে ক্যাম্প এলাকায় শাহীন স্কুল ও মিল্লাত ক্যাম্প স্কুলসহ ৩টি বিদ্যালয় আছে যেখানে বিহারি শিশুদের জন্য উর্দু ভাষায় পাঠ্যক্রম পরিচালনা করা হয়। নিজ জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে আমরা মাতৃভাষা চর্চা করতে পারলেও, ক্যাম্প এলাকার বাহিরে গিয়ে যখন আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলি, তখন মানুষ খুবই বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। থানায় যখন আমরা কোনো অভিযোগ নিয়ে যাই, শুধুমাত্র উর্দুভাষী বলে সেখানেও বৈষম্যের শিকার হতে হয় আমাদের। ভোটাধিকার থাকলেও, নাগরিক মর্যাদা থেকে আজ'ও আমরা বঞ্চিত।"
তিনি আরো বলেন, "মাতৃভাষার চেতনাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা করি বাংলা ভাষার জন্য এদেশের মানুষের সংগ্রামকে। ভাষা শহীদদের সম্মানে আমরা প্রত্যেক বছর প্রভাতফেরী করে ২১ এ ফেব্রুয়ারী ফুল দেই শহীদ মিনারের বেদিতে। ফুল দিতে যাবার সময় বাংলার পাশাপাশি উর্দুতেও লেখা থাকে আমাদের ব্যানার।"
বাংলাদেশে অনেক ভাষাভাষী মানুষ আছে। যাদের অনেকেই ভাষাগতভাবে সংখ্যালঘু। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী'রাও কিন্তু ভাষাগত ভাবে সংখ্যালঘু এবং বৈষম্যের শিকার। কিন্তু, তাদের সাথে হওয়া বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেকে সোচ্চার থাকলেও, আমাদের নিয়ে কেউ কথা বলে না। যখন চাকরি ক্ষেত্রে গিয়ে নিজেদের উর্দুভাষী হিসেবে পরিচয় দেই; তখন সরকারি চাকরি তো দূরে থাক, বেসরকারি চাকরিতেও আমাদের নেওয়া হয় না। এমন পরিস্থিতি ভাষাগত চর্চা টিকিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর, তাই ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভাষাগত সংস্কৃতি।"
মোঃ ইমরান খানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে আরো ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরেন ২১ বছর বয়সী উর্দুভাষী চা বিক্রেতা ফরহাদ ইসলাম। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন-
"আমার বাবা পাকিস্তান দেখে নাই, আমার জন্মও বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আমার জন্ম, আমি বাংলাদেশি, কিন্তু বাংলা আমার ভাষা না। আমাদের বাপ-দাদাদের পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না, তাই তারা জীবনে ভালো কিছু করতে পারে নাই। শিক্ষিত হতে পারে নাই। দারিদ্র্য আর অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালীরা আমাদের অনেক খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। যার বদনাম পড়ছে আমাদের পুরো বিহারী জনগোষ্ঠীর উপর।"
ফরহাদ আরো বলেন, "কারো সাথে বিবাদ হলেই আমাদের পাকিস্তানি বলা হয়৷ আমরা তো পাকিস্তানি না, আমরা বিহারী। আমার দাদা ভারতের বিহার থেকে এসেছিলেন এখানে। পাকিস্তানের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই, সম্পর্ক থাকলে তো আমরা পাকিস্তানেই থাকতাম।"
এবিষয়ে বাংলাদেশে উর্দুভাষীদের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন সংগঠন স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানিস জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির সাথে যোগাযোগ করা হলে সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল জব্বার খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "পাকিস্তানেও অনেক বাঙালী আছে, তাদের আমাদের মতো অবস্থায় পড়তে হয় না।"
অসুস্থ থাকায় তিনি এবিষয়ে আর কথা বলতে রাজি হননি।
যদিও বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানে থাকা ২৮ লক্ষ বাঙালীর জীবন কাটছে বহুমুখী বৈষম্যের ভেতর দিয়ে।
প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের বিহারী নাগরিকদের মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ না থাকায়, এ জনগোষ্ঠীর ভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এর পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মোঃ শাফীউল মুজনবীন মুঠোফোনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "নানান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাসহ বাংলাদেশে ৪০টি ভাষা আছে, যার অনেকগুলো ভাষারই লেখ্যরূপ নেই। ১৪টি ভাষা ইতোমধ্যেই বিপন্ন অবস্থায় আছে। সেগুলোর মাঝে বেশ কয়েকটি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের বই ছাপানো হয়েছিল। যতদূর জানি, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঐ ভাষাভাষী শিক্ষক নিজেই তার ভাষায় শিক্ষাদান করতে পারছেন না। যেহেতু তারা বাংলায় শিক্ষিত, তাদের ভাষায় তারা কথা বলতে পারলেও, সে ভাষায় তাদের অক্ষরজ্ঞান নেই।"
তিনি আরো যোগ করেন, "নিজেদের ভাষা রক্ষার জন্য তাদের নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ভাষার অধিকার যেমন অন্য কেউ এসে রক্ষা করেনি, আমাদের নিজেদেরই করতে হয়েছে। আমরা যদি আগামী অর্থবছরে গবেষণা বরাদ্দ পাই, তাদের জনগোষ্ঠীর কেউ যদি তাদের ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করতে এগিয়ে আসে, আমরা তাতে সহযোগিতা করতে পারি।"
এর আগে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী গবেষণায় উঠে আসা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলেছিলেন, "পৃথিবীতে মোটা দাগে দু'রকম ভাষা আছে। একটা হল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা, আর একটি সংখ্যালঘুদের ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা সব সময় সংখ্যালঘুর ভাষাকে হত্যা করে। বৃহত্তর যোগাযোগের জন্য সংখ্যালঘু ভাষাভাষীকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা শিখতে হয়।"
"মানুষের মৌলিক যতগুলো পরিচয়চিহ্ন রয়েছে; সেসবের মধ্যে ভাষা অন্যতম। একটি জাতি আলাদা হচ্ছে তার সংস্কৃতির জন্য। এ সংস্কৃতির অপরিমাপ্য উপাদান বা সম্পদই হচ্ছে তার মাতৃভাষা।"