চীন বিরোধী নীতিতে, পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের মিত্রতা হারাতে পারে ওয়াশিংটন
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান। বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার একমাস পর তার প্রশাসনের চীন মোকাবিলার নীতি এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্যোগে ইতোমধ্যেই শঙ্কিত ইসলামাবাদ। ভারত নয়া-মার্কিন নীতিতে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হবে বলেই মনে করছেন পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকেরা।
উদ্বেগের কারণ বেশ জোরালো। গত ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন বিরোধী জোট কোয়াড'কে শক্তিশালী করতে উদ্যমী হয়েছেন বাইডেন। কোয়াডের মূল সদস্য চারটি দেশ; যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। ওয়াশিংটনের এ নীতি ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের বিপক্ষে থাকায়, প্রমাদ গুনছে পাকিস্তান।
ইসলামাবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও পরীক্ষিত বন্ধু বেইজিং। নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং অর্থনীতিতেও উভয়ের সম্পৃক্ততা বেড়েই চলেছে। তাই চীনের প্রভাব হ্রাসের আঞ্চলিক কাঠামো কোয়াডের ভূমিকাকে নিজেদের জাতীয় স্বার্থের প্রতি সরাসরি হুমকি বলে মনে করছে; দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ ও পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র পাকিস্তান। মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের ভারতীয় প্রতিপক্ষের বৈঠক ও বার্তা বিনিময়ের দিকেও সতর্ক নজর রাখছে পাকিস্তানী প্রশাসন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে জো বাইডেনের ভিডিও কনফারেন্সও তাদের নজর এড়ায়নি। ওই বৈঠকের পরিণামে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য ভারতের পক্ষে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারত ও পাকিস্তানের শত্রুতা রাষ্ট্র দুটির জন্মকাল থেকেই। কিন্তু, চীন ঐতিহাসিক মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি বলেন, "চীন-যুক্তরাষ্ট্রে দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়তে চায় না ইসলামাবাদ। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চাই, কিন্তু বাস্তবতা হলো; পাকিস্তানের কৌশলগত ভবিষ্যৎ চীনের সঙ্গেই জড়িত।"
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র তার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানকে সহযোগী করে। কিন্তু, তারপরের দশকে সন্ত্রাসী হুমকি হ্রাস পাওয়ায়; ওয়াশিংটনের কাছে কমেছে ইসলামাবাদের গুরুত্ব। একইসময়, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দিক থেকে চীনের উত্থানকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন মার্কিন নীতি-নির্ধারক মহল।
আবার আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্র সেনা প্রত্যাহার শুরু করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সুযোগে সেখানে নিজেদের প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন ও রাশিয়া। পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই অঞ্চলের দেশগুলো।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলেই ওয়াশিংটনের 'চীন ঠেকাও' নীতির শিকার হয় পাকিস্তান। ২০১৮ সালের ওই সময়ে চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করাসহ, দেশটির উচ্চাভিলাষী 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' উদ্যোগের বিরুদ্ধে আগ্রাসী কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন ট্রাম্প।
পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মঈদ ইউসুফ একাধিকবার ওয়াশিংটনের ভারত নীতি নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করে বলেছেন যে, এই নীতির মাধ্যমে জোট নিরপেক্ষ অবস্থান ছেড়ে নয়াদিল্লিকে চীন বিরোধী জোটে শরীক হওয়ার উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
গত ২২ জানুয়ারি ইসলামাবাদে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, "এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের প্রতি বৈরিতা থেকে প্রভাবিত নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী পাকিস্তান।"
মঈদ এমন সময় একথা বলেছেন, যখন ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের (সিপিইসি) পরিধি কমানোর জন্যে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
২০১৫ সালে শুরু হয় সিপিইসি বাস্তবায়নের কাজ। তখন থেকে এপর্যন্ত পাকিস্তান জুড়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মহাসড়ক নির্মাণে ২৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মাধ্যমে স্থলপথে চীনা ভুখন্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এতে করে আরব সাগরে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে বেইজিং। সমুদ্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আধিপত্য এড়িয়ে এতে জ্বালানি আমদানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। আবার পাকিস্তান হয়ে পণ্য রপ্তানিতেও পাওয়া যাবে একই সুবিধা।
সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে দুই বছর সিপিইসি'র কাজ প্রায় স্থগিত ছিল। নতুন সরকার এসে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে আবারো তা শুরু করেছে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরেও সিপিইসি'র আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে দুটি বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। স্বাভাবিকভাবেই তাতে ক্ষুদ্ধ হয় নয়াদিল্লি। এবং সাহায্যের জন্যে আরও বেশি পশ্চিমামুখী হয়ে পড়ে।
গেল বছর লাদাখ অঞ্চলে চীন-ভারত সেনা সংঘাতের জন্যে, একে একটি প্রধান কারণ বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। ওই ঘটনার পর ভারতের প্রতি নিরাপত্তা সহযোগিতার নতুন প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে চীন বিরোধী শক্তিগুলো।
পাক-ভারত শত্রুতার অন্যতম কারণ কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই দুটি বড় যুদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে। পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পশ্চিমা সহযোগিতায় কাশ্মীর ইস্যুতে সমর্থন পাচ্ছে ভারত, অন্যদিকে তাদের পক্ষে আছে বেইজিং।
ওয়াশিংটনের সমর নেতারাও পাকিস্তানকে চীনঘেঁষা এক সমস্যাসঙ্কুল দেশ হিসেবে দেখেন, ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে নয়। বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরেই মার্কিন সেন্ট্রাল কম্যান্ডের প্রধান জেনারেল কিথ ম্যাকেঞ্জি মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বিস্তারে পাকিস্তানের প্রতি প্রধান মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালনের অভিযোগ পুনরাবৃত্তি করেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, "চীন তার বাণিজ্য মহাসড়ক এবং সিপিইসি'র মাধ্যমে (মধ্যপ্রাচ্যে) প্রভাব ও উপস্থিতি জোরদার করছে।"
তবে মার্কিন উদ্বেগ ও চাপ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানের সিপিইসি' থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বরং দিনে দিনে তার গুরুত্ব আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি।
তিনি বলেন, "পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী করাই চীনের লক্ষ্য, আর তার প্রতীক হলো সিপিইসি।" পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যে অপরিহার্য এবং সেকারণেই বাইডেন প্রশাসন এব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তবে কূটনীতিক ভাষ্য সতর্ক শোনালেও, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ঘনিষ্ঠ মিত্রতা পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে দিতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আক্রোশ এড়াতে পাকিস্তানী নীতি-নির্ধারকেরা যথেষ্ট সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও, হয়তো তাদের যেকোনো একপক্ষেই দাঁড়াতে হতে পারে। সেটা যে চীনের বিরুদ্ধে হবে না- তা অন্তত নিশ্চিত।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট