একাধিক ভাষায় দক্ষতা আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়ায়
বহুভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্থনীতির জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনে। গবেষকরা দেখেছেন, যেসব দেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার অভ্যাস তৈরি করেছে, তারা এই চর্চার ব্যাপক সুফল পাচ্ছে; রপ্তানি বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনী কর্মীদল গড়ে ওঠার সুবাদে।
গবেষকদের অন্যতম ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা অধ্যয়ন বিভাগের রিসার্চ ফেলো গ্যাব্রিয়েল হোগান ব্রান বলেন, "জাতীয় পর্যায়ে ভাষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি ব্যবসায়িক স্তরেও তার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।" তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভাষাভিত্তিক বৈচিত্রের সম্পর্ক নিয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে এ মন্তব্য করেন।
যেমন; বহুভাষী দক্ষতার ঐতিহ্য আছে সুইজারল্যান্ডের। জাতীয় ভাষা চারটি; জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান এবং প্রাচীন-লাতিন ভাষার একটি সংস্করণ- রোমানশ। দেশটির মোট জিডিপি'র ১০ শতাংশ আসছে ঐতিহ্যগত এ দক্ষতার কারণেই।
যার বিপরীতে অন্য ভাষায় দক্ষতা কম থাকার কারণে, প্রতিবছর নিজ জিডিপি'র ৩.৫ শতাংশ হারাচ্ছে গ্রেট-ব্রিটেন।
এমনটা হওয়ার প্রধান কারণ, বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ক্রেতা বা বিক্রেতার সঙ্গে তার ভাষায় কথা বলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার এই দখল বিশ্বাসযোগ্যতা এবং স্পষ্ট বোঝাপড়া সৃষ্টি করে। জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং ফ্রান্সের ছোট ও মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলোর উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব দেশের মধ্যে যারা দেশ ভাষা শিক্ষায় বেশি খরচ করছে, তারা অন্যদের থেকে বেশি পণ্য রপ্তানি করতে পারছে।
বহুভাষী কর্মী তৈরি ও নিয়োগে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জার্মান কোম্পানিগুলোর রপ্তানি বাজারে অন্যদের তুলনায় যুক্ত হয়েছে আরও ১০টি দেশ। অন্যদিকে, ভাষায় বিনিয়োগ যারা করেনি, সেসব জার্মান সংস্থা তুলনামূলক বেশি বাণিজ্য চুক্তি হাতছাড়া হওয়ার কথা উল্লেখ করে।
একাধিক ভাষায় কথা বলার কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে অর্জিত ইতিবাচক সুফলের দিকেও অনেকদিন ধরে গবেষকরা আলোকপাত করছেন। নতুন ভাষা শেখা যাদের কাছে কঠিন, তাদের জন্য সুসংবাদ হচ্ছে, ভাষা শিক্ষার সুফল পেতে আপনাকে ওই ভাষায় পুরোপুরি পারদর্শী না হলেও চলবে।
বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বহু ভাষার দক্ষতা, আয় বাড়ায়। যেমন; যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যে যেসব কর্মী স্প্যানিশ ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই যোগাযোগ করতে পারেন, তাদের আয় শুধু ইংরেজি ভাষীদের থেকে বার্ষিক ৭ হাজার ডলার বেশি। কানাডীয় এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষীদের তুলনায় দ্বিভাষী পুরুষ ও নারীরা যথাক্রমে; ৩.৬ এবং ৬.৬ শতাংশ বেশি আয় করেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে; কর্মক্ষেত্রে তারা দ্বিতীয় ভাষাটি ব্যবহার না করেই এই সুফল ভোগ করছেন।
কানাডীয় গবেষণা নিবন্ধের অন্যতম লেখক লুই ক্রিস্টোফিডেস বলেন, "তাহলে দেখা যাচ্ছে কাজের জায়গায় দ্বিতীয় ভাষা ব্যবহার না করে্ তারা দ্বিভাষী হওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন।" দ্বিতীয় ভাষা জানা থাকা কর্মী নিয়োগদাতার কাছে; অধিক জ্ঞান সক্ষমতা, অধ্যাবসায় এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়ার মতো যোগ্যতা তুলে ধরেন, এবং সেকারণেই তাদের আয়ের সুযোগ বেশি বলে গবেষকরা অনুমান করছেন।
তবে অর্থনৈতিক প্রাপ্তিই একমাত্র সুফল নয়, বরং এর বাইরেও আছে অনেক ইতিবাচক প্রভাব। নানা ভাষায় দক্ষতা একটি দেশের কর্মীসংখ্যাকে আরও বোধশক্তি সম্পন্ন করে তোলে, দীর্ঘমেয়াদে বাড়ায় তাদের সৃজনশীলতা। বহু ভাষার জ্ঞান আমাদের মস্তিস্কের জন্যেও উপকারি, কিছু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সেদিকেও ইঙ্গিত দেয়। এর সাহায্যে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার গতি হ্রাস পায়। আবার মস্তিস্কের মনোযোগ এবং তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা বাড়ে। বিশেষ করে, যেসব ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত কম বয়স থেকেই বহুভাষার দক্ষতা অর্জন করেন, তাদের মধ্যে এসব প্রভাব বেশ জোরালো আকারেই দেখা যায়। শুধু তাই নয়, জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে নতুন ভাষা শিক্ষার পরিধি বাড়ালেও তার সুফল পাওয়া যায়।
ভাষা বৈচিত্রের মূল্যায়ন নিয়ে এডিনবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ থমাস বাক এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের লেকচারার দিনা মেহমেদবেগোভিচ- এর এক যৌথ গবেষণাপত্রে বলা হয়,"মাত্র এক সপ্তাহের ভাষাশিক্ষা ক্লাস করেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনঃসংযোগ বাড়তে দেখা গেছে। সপ্তাহে যারা অন্তত পাঁচ ঘণ্টা ভাষা শিক্ষার পেছনে ব্যয় করেছেন, তাদের অনেকের মধ্যে ৯ মাস পরেও এই প্রভাব বজায় ছিল।"
ভাষার এত সুফলকে বিভিন্ন দেশ কীভাবে সম্পদ বা মূলধনে রূপ দিতে পারে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এ দুই গবেষক। তাদের পরামর্শ, নাগরিকদের মধ্যে বহু ভাষা শিক্ষার পরিমিত ও নিয়মিত চর্চা ধরে রাখলে, সারা জীবন তার সুফল ধরে মিলবে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, অভিবাসী পরিবারগুলোর সূত্রে ইতোমধ্যেই অনেক দেশের আছে; অন্য ভাষা শিক্ষার এক বিশাল ও অব্যবহৃত ভান্ডার। ভাষাশিক্ষা ভিন্ন সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও মূল্যবোধের দিকেও আমাদের দৃষ্টি স্বচ্ছ করে। এর মাধ্যমেই সমাজে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করে, সহাবস্থান ও মিলিত উন্নয়নের নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। যা বিশ্বকে জাতি, শ্রেণি আর ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক নতুন দিনের আলো দেখাবে।
- সূত্র: ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম