‘একুশের দিকে আমাদের বার বার তাকাতে হবে’
১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পূর্ব বাংলা নাম পাল্টিয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়- তখন পাকিস্তানের সেই কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলিতে বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, "বাংলা আমাদের ঐতিহ্য, বাংলা আমাদের আত্ম-পরিচয়। ইতিহাসের পাতায় কত হাজার বছর ধরে বাংলার পদচারণা, সুতরাং আমরা কেন পূর্ববঙ্গ নাম ত্যাগ করবো। পূর্ব পাকিস্তান নাম কেন হবে?"
একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরবের বিষয়। প্রতিবছর আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উদযাপন করি। আমরা স্মরণ করি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। কিন্তু, আমাদের দেশের গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, প্রায় সকল স্তরের মানুষ ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকে 'পূর্ব পাকিস্তানের' ভাষা আন্দোলন বলে চিহ্নিত করি। অথ্ এই পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ১৯৫৫ সালের শেষে, অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের শুরুতে। ১৯৪৭ সালে যে দুটি অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল; তার একটি অংশের নাম পূর্ব বাংলা। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমার মধ্য থেকে উঠে আসা এই ভূখণ্ডের নাম 'বঙ্গ' এবং তা 'বাংলায়' রূপান্তরিত হয়েছে। সেই বাংলাকে ভাগ করে ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা আর পশ্চিমবঙ্গ দুটি প্রদেশে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, এর ফলে বাংলায় শাসন পরিচালনা করার সুবিধে হবে।
পূর্ব বাংলার সিংহভাগ জনগোষ্ঠী মুসলমান হওয়াতে; ব্রিটিশ শাসকদের থেকে আলাদা প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের বিষয়টিকে সুনজরে দেখেছিল এই অংশের মুসলিম অভিজাতবর্গ। তখনকার মুসলিম সমাজের এক অংশ সমাজের উপর স্তরের জমিদার শ্রেণির মানুষ ছিলেন। তারা সবাই বঙ্গ-বিভাজনকে সঠিক বলে মনে করেছিলেন। মুসলিম দরিদ্র কৃষককে বোঝানো হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ হলে, তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। অন্যদিকে, একটা বিরাট দল বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে ছিল। কারণ, বিরোধিতাকারী এই দলটির ধারণা ছিল এর মধ্য দিয়ে একটি ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেকারণে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ঘটনার পর বাংলায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনে বাংলার একশ্রেণির জমিদার ও বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছিল। বুদ্ধিজীবীদের সবাই এর বিরোধী ছিল- তা অবশ্য নয়। বরং, পক্ষে-বিপক্ষে তারা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন।
জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে ছিলেন। সেই বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই ভূখণ্ডের নাম হয়েছিল পূর্ব বাংলা। যদিও, পরবর্তীকালে ১৯১১ সালে ব্রিটিশরা এই বঙ্গভঙ্গ রদ করেন এবং বাংলাকে একটি নতুন প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। নতুন প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করার সময়; বাংলার অপর কিছু অংশকে বাংলা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। যার মধ্যে আছে আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা। এক সময় বেঙ্গল ছিল আসাম, বিহার, উড়িষ্যাকে নিয়ে একটি সুবিশাল প্রদেশ।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কার্জন হলের ভাষণের ভেতর থেকে। যেখানে তিনি ঘোষণা করলেন, ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেন ঊর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলেন- তাও একটি গবেষণার বিষয়। কারণ, সর্ব-পাকিস্তানের আঙ্গিকে মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। সেই সময়কার পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ব্যবহৃত ভাষার একটা হিসাব দেয়া যাক। শতাংশ হিসাবে পাঞ্জাবি ৩৮.৭৮, পশতু ১৮.২৪, সিন্ধু ১৪.৫৭, সারাইকি ১২.১৯, ঊর্দু ৭.০৮, বেলুচ ৩.০২ এবং অন্যান্য ৬.১২। অর্থাৎ, ঊর্দুর অবস্থান একবারে নীচের দিকে।
ঊর্দু ভাষার উৎপত্তিও চমকপ্রদ। এই ভাষাটি পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতন সাধারণ প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়নি। ভাষাটির জন্ম হয়েছিল মোগল সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে। আকবরের সময়কালে সামরিক বাহিনীতে লোক-নিয়োগ এবং তাদের পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ভাষা একটি সংকট হিসেবে দাঁড়ায়। মহারাষ্ট্র অঞ্চলের মানুষ মারাঠি ভাষায় কথা বলতেন, উত্তর ভারতের মানুষরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন। আবার, ভারতের অপর অংশের মানুষরা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলতেন। সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষদের জন্য একটি কমন বা সার্বজনীন ভাষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে; যার প্রেক্ষিতে ঊর্দু ভাষাকে তৈরি করা হয়েছিল। যে ভাষার মধ্যে বহু শব্দ হিন্দি ও ফারসি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং বর্ণমালা ছিল আরবি বর্ণমালা। মোঘলরা যেটাকে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মুসলিম লীগের নেতাদের অনেকেই এই ভাষায় (ঊর্দু) কথা বলতেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-সহ অপরাপর মুসলিম লীগ নেতাদেরও মাতৃভাষা ঊর্দু ছিল না। জিন্নাহ'র নিজের ভাষা গুজরাটি। তারপরও, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেন ঊর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন- তা আজও পরিষ্কার নয়।
এর বিপক্ষে সেই থেকে যে আন্দোলন, সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বহু ঘটনা ইতিহাসে গ্রন্থিত হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী দক্ষিণ ভারতে শুরু হয় হিন্দি ভাষা বিরোধী আন্দোলন। রাজ্যের দাপ্তরিক কাজে ও বিদ্যালয়গুলিতে হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার বিরোধিতা করে ১৯৩৭ সালে প্রথম হিন্দি-বিরোধী এই আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৪০ সালে দক্ষিণ ভারতের সরকার থেকে কংগ্রেস পদত্যাগ করলে হিন্দি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। দক্ষিণে তামিলসহ আরো অনেকগুলি ভাষার প্রচলন থাকায় ইংরেজি সেখানে (কমন ভাষা) দাপ্তরিক কাজ ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৫০ সালে হিন্দি ভারতে সরকারি ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়, এবং ঠিক হয় পরবর্তী পনের বছর ইংরেজি সহযোগী আধিকারিক ভাষা হিসেবে অব্যাহত থাকবে। পরে হিন্দি একমাত্র সরকারি ভাষা হয়ে উঠবে। নতুন সংবিধানটি ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০-এ কার্যকর হয়।
হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষার করার দিন (২৬ জানুয়ারি ১৯৬৫) হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন কলেজের শিক্ষার্থীদের সমর্থন-সহ মাদ্রাজে প্রবল গতির সৃষ্টি করেছিল। ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে, দক্ষিণের শহর মাদুরাইতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী দুই মাস- তা অব্যাহত থাকে। এ আন্দোলনে দুই পুলিশ সদস্যসহ প্রায় ৭০ জনের মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ঘোষণা করেন, যতদিন অ-হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যগুলো চায়, ততদিন ইংরেজি ভাষাটি ব্যবহার করা হবে। শাস্ত্রীর আশ্বাসের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু এরপর থেকে কংগ্রেস আর ক্ষমতায় আসতে পারেনি দক্ষিণ ভারতে।
১৯৬৫ সালের এই আন্দোলনটি রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে ডিএমকে (আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল) বিজয়ী হয়েছিল এবং তখন থেকেই কংগ্রেস আর এ রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি।
৫২'র ভাষা আন্দোলন; যার ধারাবাহিকতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন- ইতিহাসের এই বিবরণ যখন আমরা পাঠ করি, তখন ভুলে যাই, ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল 'পূর্ব বাংলায়' 'পূর্ব পাকিস্তানে' নয়। আমাদের বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ এমনকি গণমাধ্যম এই ভুল অহরহ করে চলেছে।
পূর্ব পাকিস্তান নামটি গ্রহণ করা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আমাদের এই অঞ্চলের বগুড়ার মানুষ (জন্ম বরিশালে) ধনবাড়ির নবাব পরিবারের মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হলে; দুইটি ভূখণ্ডকে সম-মর্যাদার দেওয়ার নামে 'এক ইউনিট' করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্ম হলো। জনসংখ্যার বিচারে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে (৫৬%), যাদের প্রায় সকলেই বাঙালি।
১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পূর্ব বাংলা নাম পাল্টিয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়- তখন পাকিস্তানের সেই কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলিতে বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন,"বাংলা আমাদের ঐতিহ্য, বাংলা আমাদের আত্ম পরিচয়, ইতিহাসের পাতায় কত হাজার বছর ধরে বাংলার পদচারণা সুতরাং আমরা কেন পূর্ববঙ্গ নাম ত্যাগ করবো। পূর্ব পাকিস্তান নাম কেন হবে?" বঙ্গবন্ধু'র এই বক্তৃতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের গর্ভ থেকে উঠে এসেছে। ৫২'তে যে ভূখণ্ড ফুঁসে উঠেছিল- তা ছিল পূর্ব বাংলা। সেটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক