৪৭ বছরের ভেতর মঙ্গলের ব্যস্ততম দুটো সপ্তাহ
গত গ্রীষ্মে মঙ্গল এবং পৃথিবী একই সরল রেখায় মিলে গিয়েছিল। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন এজেন্সি এমন একটা সুযোগ লুফে নেয়।
তিনটা ভিন্ন ভিন্ন দেশের তিনটি প্রোব মাত্র নয়দিন আগেপিছে লাল গ্রহে হাজির হওয়ায় ফেব্রুয়ারি মাস ভীষণ ব্যস্ততায় কাটছে মঙ্গলের। এটা আদৌ কাকতালীয় ঘটনা নয়। পৃথিবী এবং মঙ্গলের কক্ষপথের হিসাব নিকাশের সাথে একটা সম্পর্ক আছে এর।
লাইভ সায়েন্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্পেসডটকমের রিপোর্ট মোতাবেক সংযুক্ত আরব আমীরাতের প্রথম আন্তগ্রহ মিশন দ্য হোপ প্রোব মঙ্গলবার, ৯ই ফেব্রুয়ারি মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছে। ১০ই ফেব্রুয়ারি বুধবার চীনের পয়লা আন্তগ্রহ মিশন তাইওয়েন-১-এর মঙ্গলের কক্ষপথে ঢোকার দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। চীনা প্রোবে অরবিটারের পাশাপাশি একটা ল্যান্ড রোভারও রয়েছে। আসছে মে মাসে মঙ্গলের জমিনে এটা অবতরণের প্রয়াস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি নাসার আনকোরা নতুন ধরনের অবতরণ যান মঙ্গলে পৌঁছানোর পরই সরাসরি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়েছে। মাহকাশযানটি বাইরের খোলস ঝেড়ে ফেলে গ্রহের জমিনের উপর ভেসে থেকে গণ্ডার-আকৃতির নিউক্লিয়ার শক্তিচালিত ২.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত পার্সেভেরেন্স রোভারকে স্কাই ক্রেনের সাহায্যে গ্রহের জমিনে নামিয়ে দিয়েছে। রোভার রুদ্ধশ্বাসে দেখার মতো সব ছবিও পাঠাতে শুরু করেছে।
লোহিত গ্রহের উদ্দেশে পাঠানো নতুন প্রজন্মের এইসব রোভার, ল্যান্ডার এবং অরবিটার মারফত আমরা এখন মঙ্গলের নানা রহস্য আরও বেশি করে জানতে পারছি; মঙ্গলের ল্যান্ডস্কেপ এবং গঠন সম্পর্কে জানছি, সেখানে পানি এবং প্রাণের অস্তিত্বের সত্যতার ব্যাপারে জানা যাচ্ছে। সূর্যের চার নম্বর এই গ্রহটি একদিন আমাদের আবাস হওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এসবের মধ্য দিয়ে।
'একই সময়ে এতগুলো রোবটের হাজিরা মোটেই কাকতালীয় কিছু নয়,' বলছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ এবং মহাশূন্য অভিযান বিশেষজ্ঞ জোনাথান ম্যাকডাওয়েল।
মঙ্গল এবং পৃথিবী অনেকটা 'বৃত্তাকার রেসট্র্যাকের দৌড়বিদের মতো,' বলেছেন তিনি। 'এবং আসল দ্রুততম দৌড়বিদ [পৃথিবী] নিয়মিতই খানিক দূরের দৌড়বিদকে [মঙ্গল] পাশ কাটায়। তো অনেক সময় এরা একে অন্যের কাছাকাছি এসে পড়ে, আবার অনেক সময় ট্র্যাকের একেবারে উল্টোদিকে চলে যায়।' পৃথিবী-মঙ্গলের এই চক্র শেষ হতে, মানে মঙ্গলের নাগাল পেতে পৃথিবীর প্রায় দুই বছর সময় লাগে।
এই দুটি গ্রহ একে অন্যটি থেকে বেশি দুরে থাকলে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছাতে সুবিশাল রকেট, প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি এবং অনেক বেশি সময় দরকার হবে, লাইভ সায়েন্সকে বলেছেন ম্যাকডাওয়েল। কিন্তু গ্রহ দুটি সবচেয়ে কাছে, অর্থাৎ পরস্পরের গড় পড়তা ৩৮.৬ মিলিয়ন মাইল (৬২.১ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে থাকার সময় রকেট উৎক্ষেপণ করাও কিন্তু মঙ্গলে পৌঁছানোর সহজতম রাস্তা নয়।
গ্রহ দুটির দুই বছর মেয়াদী আবর্তনের আগের একটা পর্যায়েও যাত্রার জন্যে কম সময় এবং কম জ্বালানির দরকার হবে। ওই অবস্থায়, দুই বছরের মাত্র একবারই এমন ঘটে, পৃথিবী মঙ্গলের খানিকটা পেছনে থাকলেও পড়শীর চেয়ে দ্রুত ছুটতে থাকে। এমনি অবস্থান মহাশূন্যযানকে তথাকথিত 'হোফমান ট্রান্সফার অরবিটে' ঢোকার সুযোগ করে দেয়। ১৯২৫ সালে এর পেছনের গাণিতিক সূত্রের আবিষ্কারক জার্মান প্রকৌশলী ভাল্টার হোফমানের নামানুসারে কক্ষপথের এই নাম রাখা হয়েছে।
ঘটনাটা এভাবে ঘটে:
পৃথিবী ও মঙ্গলের মাঝখানের কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ মাইলের ভেতর ওঠানামা করা গোটা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার মতো যথেষ্ট জ্বালানি বহন করা কোনো রকেটের পক্ষে সম্ভব নয়।
তার মানে যেকোনো আন্তগ্রহ অভিযান ত্বরণের এক ধরনের সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র পর্যায় দিয়ে শুরু হয়ে ধীর গতিতে এগোনার দীর্ঘ একটা পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। প্রাথমিক এই পর্যায়ে রকেটের এঞ্জিনের কাজ হচ্ছে মহাশূন্যযানটিকে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে মঙ্গলের কক্ষপথকে ছেদ করবে সূর্যের এমন কক্ষপখে স্থাপন করা। সুতরাং, দুটো গ্রহের ভেতর সবচেয়ে জুৎসই রাস্তা হচ্ছে সবচেয়ে কম জ্বালানি পুড়িয়ে পৌঁছানোর মঙ্গলের সাথে মিলিত হওয়া সৌর কক্ষপথ। প্রতি দুই বছরে মাত্র একবার এই কক্ষপথ নাগালে আসে।
কিন্তু বিভিন্ন স্পেস এজেন্সির কাটায় কাটায় এই দিনটি শনাক্ত করার প্রয়োজন হয় না। ওই সময়ের মোটামুটি সপ্তাহ দুয়েকের আশপাশে উৎক্ষেপণ করলেও মহাশূন্যযান ঠিকই হোফমান ট্রান্সফার অরবিটে স্থাপন করা যায়। কিন্তু দুই সপ্তাহর বেশি এদিকওদিক হলে অবশ্য কাজটা খুব দ্রুতই কঠিন হতে শুরু করবে।
হোপ অরবিটার উৎক্ষেপণ করা হয় ১০ শে জুলাই, ২০২০, তাইওয়ান-১ ২৩ শে জুলাই এবং পার্সেভেরেন্স ৩০শে জুলাই। রকেট প্রযুক্তি, মহাশূন্যে গতিপথ এবং গন্তব্যের ভেতর ছোটখাটো ফারাকের কারণে এসব মহাশূন্যযানের পৌঁছানোর সময়ের সাথে উৎক্ষেপণ সময় মেলেনি, বলেছেন ম্যাকডাওয়েল। (যেমন, হোপের মতো উঁচু কক্ষপথে ঢোকার চেয়ে সরাসরি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের জন্যে ভিন্ন কোণের প্রয়োজন)।
মঙ্গলের কক্ষপথে এধরনের জটলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়, বলেছেন ম্যাকডাওয়েল। ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মঙ্গলের উদ্দেশে চারটি মহাশূন্যযান পাঠিয়েছিল, সেগুলোর একটি কক্ষপথে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলেও বাকি তিনটি পৌঁছানোর পর প্রত্যাশামতোই কাজ করে। দুটো সোভিয়েত স্পেসক্র্যাফট এবং একটি আমেরিকান স্পেসক্র্যাফট ১৯৭১ সালে মঙ্গলে বুকে নেমেছিল। সবকটিই আংশিকভাবে মিশন সফল করে। (দুই দেশই ওই বছর আরও প্রোব পাঠানোর পরিকল্পনা করলেও আমেরিকান মেরিনার ৮ প্রোবটি উৎক্ষেপণের সময় ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে সোভিয়েত কসমস ৪১৯ লো-আর্থ অরবিট থেকেই বেরুতে পারেনি।
'এবছরের ব্যতিক্রমের দিকটা হলো,' বলছেন ম্যাকডাওয়েল, 'মঙ্গলে পৌঁছানো মহাশূন্যযানগুলোর লক্ষণীয় বৈচিত্র্য এবং বেশ কয়েকটি বাড়তি প্রোব ইতিমধ্যেই গ্রহটি ঘিরে সক্রিয় থাকা। নাসার তিনটি প্রোব মঙ্গলের কক্ষপথে সক্রিয়, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)-র নিজস্ব একটি এবং রাশিয়ান রসোকসমসের সাথে যৌথ পরিকল্পনার অধীনে একটি প্রোব রয়েছে। ভারতীয় মহাশূন্য গবেষণা সংস্থারও একটি সক্রিয় অরবিটার রয়েছে। নাসার কিউরোসিটি রোভার এবং ইনসাইট ল্যান্ডারও মঙ্গলের জমিনে কাজ করছে।
এমনি আপেক্ষিক ভীড় সত্ত্বেও, বলছেন ম্যাকডাওয়েল, এমনকি কোনো দেশ আগেভাগে এই প্রোবের ট্র্যাজেক্টরির দিকে খেয়াল না রাখলেও কোনোটিই এমনকি পরস্পরের লক্ষ মাইলের ভেতরে আসার ব্যাপারে্ও তিনি সন্দিহান।
'মহাশূন্য বিশাল,' বলেছেন তিনি।