জীবনানন্দ দাশ: ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি অথবা ৬ ফাল্গুন এবং বরিশাল ও বামনকাঠি
অফিসিয়ালি জীবনানন্দের জন্মদিন এখন ১৭ ফেব্রুয়ারি। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রণীত বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ 'বাংলাডিপিয়া'য় লেখা হয়েছে—কবি, শিক্ষাবিদ জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন।
বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে (বর্তমান নাম জীবনানন্দ দাশ সড়ক) পারিবারিক বাড়ির কম্পাউন্ডে তার নামে যে লাইব্রেরি বানানো হয়েছে, সেখানকার প্রবেশপথের ম্যুরালেও জন্মতারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি। ২০০৬ সালে ঐতিহ্য ৬ খণ্ডে জীবনানন্দের যে রচনাবলি প্রকাশ করেছে, সেখানেও ইংরেজি জন্মতারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজ ও হাসপাতালে জীবনানন্দের যে ভাস্কর্য ও ম্যুরাল রয়েছে, সেসব জায়গায়ও ১৭ ফেব্রুয়ারি উল্লিখিত।
যদিও অনেকেই তার জন্মতারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি লেখেন। যেমন জীবনানন্দের উপরে বড় কলেবরে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থে (অম্বুজ বসু, একটি নক্ষত্র আসে, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা ৫০২) জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। সংক্ষিপ্ত কলেবরে প্রথম জীবনীগ্রন্থেও (গোপালচন্দ্র রায়, জীবনানন্দ, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ১) লেখা ১৮ ফেব্রুয়ারি। মার্কিন গবেষক ক্লিনটন বি সিলিও (অনন্য জীবনানন্দ, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৮) তা-ই। 'জীবনানন্দ দাশ: বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত' গ্রন্থে (১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৯) দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮ ফেব্রুয়ারি উল্লেখ করেছেন।
গবেষক গৌতম মিত্র লিখেছেন, যখন 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকা নিয়ে কাজ করছিলাম তখন বাংলা তারিখকে ইংরেজিতে রূপান্তরের একটা ফর্মুলা শিখেছিলাম। সেটা ১৯৯৬, তখনও ইন্টারনেট আসেনি। এই ২০২১-এ বাংলা তারিখ ইংরেজিতে কনভার্ট করা খুব সহজ। নির্ধারিত যেকোনো অ্যাপসে তারিখটি বসালেই হল। জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ নিজে লিখেছেন, জীবনানন্দ দাশের জন্ম ৬ ফাল্গুন ১৩০৫!এই তারিখটিকে ইংরেজিতে রূপান্তর করে দেখুন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ হয়! তাছাড়া জীবনানন্দ দাশ তার ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২-এর ডায়েরিতে নিজের হাতে লিখে গেছেন: Birthday Unnoticed.
কিন্তু জীবনানন্দের পূর্ণাঙ্গ জীবনীকার হিসেবে খ্যাত প্রভাতকুমার দাস (জীবনানন্দ দাশ, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১) লিখেছেন ১৭ ফেব্রুয়ারি এবং শুক্রবার। তিনি লিখেছেন, ১৯৮৪ সালে নববর্ষে পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক পর্ষদ কবির বহুপরিচিত মুখমণ্ডলের রেখাচিত্র সংবলিত যে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে, তাতে তার জন্মতারিখ মুদ্রিত হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি। এই উল্লেখের উৎস সম্ভবত অঞ্জলি বসু সম্পাদিত চরিতাভিধান (১৯৭৬) গ্রন্থ। প্রভাতকুমার দাসের দাবি, পুরাতন পঞ্জিকা অনুসরণ করে বাংলার সন-তারিখ অনুসারে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখটিই যে যথাযথ সে বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া গেছে।
তবে ১৭ নাকি ১৮— সেই তর্ক এড়াতে কিছুটা কৌশলী আবদুল মান্নান সৈয়দ। জীবনানন্দের জীবনালেখ্যতে (আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা ৭৮৩) তিনি লিখেছেন, জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের ১৭/১৮ই ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে।
১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারির বিভ্রান্তি এড়াতে জীবনানন্দের বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্য (কবি জীবনানন্দ দাশ, পৃষ্ঠা ১২৮) কিছুটা কৌশলী। লিখেছেন, জীবনানন্দের জন্ম ১৮৯৯ সালে (৬ ফাল্গুন ১৩০৫) পূর্ববঙ্গের বরিশাল শহরে। অর্থাৎ তিনি জন্মসাল বাংলা ও ইংরেজি ব্যবহার করলেও ইংরেজি তারিখ এড়িয়ে গেছেন। দেখা যাচ্ছে, ১৭ নাকি ১৮ ফেব্রুয়ারি--তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাংলা তারিখ যে ৬ ফাল্গুন ১৩০৫, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
অশোকানন্দ দাশও ইংরেজি তারিখ এড়িয়ে গেছেন। মৃত্যুর পরের বছর ১৯৫৫ সালে জীবনানন্দের সবশেষ কর্মস্থল হাওড়া গার্লস কলেজ যে স্মরণিকা প্রকাশ করে সেখানে 'আমার দাদা জীবনানন্দ দাশ' শিরোনামের একটি দীর্ঘ নিবন্ধে অশোকানন্দ লিখেছেন, 'আমার দাদা জীবনানন্দ দাশ ১৩০৫ সালে ৬ই ফাল্গুন বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।'
জীবনানন্দ নিজে অবশ্য জন্মতারিখ লিখে যাননি। ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই সর্বানন্দ ভবন থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে (পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ, প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ১৫৭) প্রভাকর সেনকে লিখেছিলেন: 'আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে।' দেখা যাচ্ছে, তিনি নিজেও তারিখ এড়িয়ে গেছেন। সন লিখেছেন ইংরেজিতে। কিন্তু মাস বাংলায়। তার মানে কি তিনি নিজেও জন্মতারিখের ব্যাপারে সুনিশ্চিত ছিলেন না? যদিও গৌতম মিত্রর দাবি অনুযায়ী যদি ১৯৩২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির ডায়েরিতে উল্লিখিত বাক্যটি সঠিক হয়, তাহলে ১৮ তারিখের দিকেই পাল্লাটা ভারী হয়।
ইংরেজি জন্মতারিখের বিভ্রান্তি এড়ানোর একটি সমাধানসূত্র হলো শুক্রবার। অর্থাৎ জীবনানন্দের জন্মদিন যে শুক্রবার ছিল, তা উল্লেখ করেছেন প্রভাতকুমার দাস, হরিশংকর জলদাস (জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, ২০১৭, পৃষ্ঠা ৫) এবং জীবনানন্দ রচনাবলিতেও (ঐতিহ্য, ২০০৬) এই তথ্য রয়েছে।
তবে যেহেতু ইংরেজি জন্মতারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে এবং বাংলা তারিখের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই, সুতরাং বিভ্রান্তি ও বিতর্ক এড়াতে জীবনানন্দের জন্মতারিখ ৬ ফাল্গুন ব্যবহার করা ভালো।
উল্লেখ করা যেতে পারে, জীবনানন্দের জন্মসাল নিয়েও কিছুটা বিতর্ক ছিল। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশ লিখেছেন ১৮৯৮। যদিও এই তারিখটি কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। সম্ভবত লাবণ্য ভুলবশত ১৮৯৮ লিখেছিলেন অথবা এটি ছাপার ভুল ছিল। কারণ গবেষকদের সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, জীবনানন্দের জন্ম ১৮৯৯ সালে। কেননা জীবনানন্দ নিজেও লিখেছেন ১৮৯৯।
বরিশাল ও বামনকাঠি:
জীবনানন্দকে নিয়ে এ যাবত লিখিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর বরাতে এটি মোটামুটি স্পষ্ট যে, বরিশাল শহরেই তার জন্ম। কিন্তু সেই বাড়িটা কোথায়?
অনুসন্ধান বলছে, কালিবাড়ি রোডের যে বাড়িতে জীবনানন্দের জন্ম, সেটি ছিল অশ্বিনীকুমার দত্তর বাড়ির উল্টো দিকে। পরবর্তীকালে অশ্বিনীকুমারের বাড়িতে নির্মিত হয় বরিশাল কলেজ। এখনও কলেজের মূল ফটকের উল্টো দিকে একটি পুরনো কাঠের দোতলা ঘর দেখা যায়। বইপত্রে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে ধারণা করা যায় এখানেই কোনো একটি বাড়িতে জীবনানন্দের জন্ম। কিন্তু এটিই সেই বাড়ি কি না বা হলেও এত বছর পরও বাড়িটার টিকে থাকা সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বরিশালের বিশিষ্ট সংস্কৃতিজন এবং স্থানীয় অমৃতলাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তপংকর চক্রবর্তী মনে করেন, এটিই সেই বাড়ি যেখানে জীবনানন্দের জন্ম।
২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর কথা হয় এই ঘরের বর্তমান বাসিন্দা ইসরাত জাহান টিংকুর সাথে। জানান, তার বাবা মোজাফফর হোসেন চৌধুরী বাড়িটা কিনেছিলেন ১৯৫২-৫৩ সালে। টিংকুরও জন্ম এই ঘরে। তিনিও অনেকের কাছে শুনেছেন, এই ঘরে অথবা এর আশপাশের কোনো বাড়িতেই জীবনানন্দের জন্ম। টিংকু নিজেও জীবনানন্দের ভক্ত। জানান, তার বাবা একটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নেন। তার আগে কারা এই বাড়িতে ছিলেন, সেই ইতিহাস তার জানা নেই। তার বাবা জজ কোর্টে চাকরি করতেন। দাদা মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। দাদাকে তিনি দেখেননি। ছোটবেলায় তিনি এরকম কোনো কথা শোনেননি যে এই বাড়িতেই জীবনানন্দের জন্ম। বড় হবার পরে কারো কারো কাছে এ কথা শুনেছেন। বিশেষ করে জীবনানন্দ বিষয়ক লেখালেখি এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে এরকম ইঙ্গিত পেয়েছেন যে, এই বাড়িতেই হয়তো জীবনানন্দ দাশের পরিবার একসময় ভাড়া থাকতো।
ইসরাত জাহান টিংকুর ধারণা, এই বাড়িটা শতবর্ষী। চেহারা দেখেও সেটি আন্দাজ করা যায়। বাড়িটার নিচতলায় দুটি কক্ষ। দোতলাটা ফাঁকা। কাঠের ঘরের উপরে টিনের চাল। টিংকু জানালেন, ঘরের অনেক জায়গায় উঁইপোকা বাসা বেঁধেছে। এই বাড়িতে আসলেই জীবনানন্দের জন্ম কি না, সে প্রশ্ন তারও।
তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন বরিশালের সন্তান এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী নশরত শাহ আজাদ। তিনি একসময় বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, বরিশাল কলেজের ঠিক উল্টোদিকে যে বাড়িটায় জীবনানন্দের জন্ম বলে ধারণা করা হয়, এটি সেই বাড়ি নয়। বরং বাড়িটা ছিল আরও ভেতরে। ছোটবেলায় সেই বাড়ির শূন্য ভিটা তারাও দেখেছেন এবং প্রবীণদের কাছ থেকে জেনেছেন, সেই ভিটাতেই জীবনানন্দের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল—যেখানে তার জন্ম। মি. আজাদ জানান, গেট দিয়ে প্রবেশের পরে কম্পাউন্ডের ভেতরে তিনটি ঘর ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘরটিতে থাকতো জীবনানন্দের পরিবার। সম্প্রতি এই বাড়িতে পুনরায় গিয়ে দেখা যায়, নশরত শাহ আজাদ যে শূন্যভিটার কথা বলেছেন, সেখানে বাড়িঘর উঠে গেছে।
প্রভাতকুমার দাস লিখেছেন, বরিশাল শহরের যে বাড়িতে জীবনানন্দের জন্ম, সেটি ছিল প্রশস্ত আটচালা ঘর। জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দ দাশ সেই বাড়িতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বাড়িতে থাকা অবস্থায় ১৮৯৪ সালে সত্যানন্দ দাশ ও কুসুমকুমারীর বিয়ে হয় এবং বিয়ের ৫ বছর পরে তাদের প্রথম সন্তান জীবনানন্দ দাশের জন্ম হয়। কিন্তু জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দের পুত্ররা অর্থাৎ তার বাবা কাকারা এই বাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপরে তারা আলেকান্দা এলাকায় একটি ভাড়াবাড়িতে কিছুদিন থাকেন। সর্বানন্দর বন্ধু জগচ্চন্দ্র দাশের পত্নী মুক্তকেশী গুপ্তার বসতবাড়ির এক অংশে অনুমতিসূত্রে জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ, কাকা হরিচরণ দাশসহ অন্য কাকারা মিলে একটি ঘর নির্মাণ করেন। তবে মালিকানা বদল নিয়ে সে বাড়িটি নিয়েও বিপত্তি বাঁধে। ফলে সম্পূর্ণ নিজ মালিকানাধীন একটি বাড়ির জন্য হরিচরণ ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। মূলত তাঁরই একাগ্র অন্বেষণ ও উৎসাহে অন্য ভাইদের সহায়তায় শহরের বগুড়া রোডে ১৯০৭ সালে, অর্থাৎ জীবনানন্দের বয়স যখন ৮ বছর, তখন তারা একটি ঘর নির্মাণ করেন। সর্বানন্দের নামানুসারে বাড়িটির নাম রাখা হয় 'সর্বানন্দ ভবন'।
জীবনানন্দের জন্ম যে বাড়িতে বলে ধারণা করা হয়, সেই বাড়ির সামনে দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে যে সরু রাস্তাটি চলে গেছে, তার কিছুটা পশ্চিমে গেলেই তেমাথা। তার বাম পাশেই সর্বানন্দ ভবন—যেখানে পরবর্তীকালে জীবনানন্দ বেড়ে ওঠেন। জীবনানন্দের পরিবার বরিশাল ছেড়ে চলে যাওয়ার অনেক বছর পরে বাড়িটার নাম দেয়া হয় 'ধানসিড়ি'।
আবদুল মান্নান সৈয়দকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ বলেছেন, তাদের ঠাকুরদাদা সর্বানন্দ দাশ বরিশাল শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকেছেন। তার মৃত্যুর পরে জমিদার বিনয়ভূষণ গুপ্তর গৃহসংলগ্ন একটি জমিতে কিছুদিন থেকেছেন। সেই বাড়ির কথা বিশেষ কিছু মনে নেই। অশোকানন্দ মনে করতে পারেন, সেই বাড়িতে একটি করমচা গাছ ছিল। তাতে থোকায় থোকায় ফল হয়ে থাকতো।
তবে জন্মতারিখের মতো জীবনানন্দের জন্মস্থান নিয়েও কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। যেমন জীবনানন্দ নিজে, তার সুহৃদ ও গবেষকরা তার জন্মস্থান বরিশাল বা বরিশাল শহর লিখলেও কেউ কেউ বরিশাল শহর সংলগ্ন ঝালকাঠি জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে ধানসিড়ি নদী তীরের একটি গ্রাম বামনকাঠিতে জীবনানন্দের পূর্বপুরুষেরা থাকতেন এবং সেখানেই জীবনানন্দের জন্ম বলে দাবি করেন। এ বিষয়টিরও সুরাহা করা দরকার।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার একটি মহকুমা শহর। কীর্তনখোলা (জলসিড়ি) নদীর তীরে ছিমছাম মফস্বল শহরে বাস করতেন বরিশাল কালেক্টরেটের কর্মচারি সর্বানন্দ দাশ (জীবনানন্দের দাদা)। পদ্মার (কীর্তিনাশা) ভাঙনে তাদের ভিটেমাটি বিলীন হলে মুন্সিগঞ্জের গাউপাড়া গ্রাম থেকে বরিশালে এসে বসবাস শুরু করেন সর্বানন্দ। প্রভাতকুমার দাস (জীবনানন্দ দাশ (তৃতীয় সংস্করণ), পৃষ্ঠা ২) লিখেছেন, শিক্ষাবিস্তার ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সর্বানন্দ এতটাই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন যে, বরিশাল মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে তিনি খোদ অশ্বিনীকুমার দত্তকেও পরাজিত করেন। বরিশাল শহরে সর্বানন্দ ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
জীবনানন্দ নিজেই ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই প্রভাকর সেনকে লিখেছিলেন: 'আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে।' জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের লেখায়ও এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, ১৩০৫ সালে ৬ ফাল্গুন জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রভাতকুমার দাস রচিত জীবনানন্দের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী 'জীবনানন্দ দাশ'-এ জীবনানন্দের জন্মস্থান উল্লেখ করা হয়েছে বরিশাল শহর। শুধু তাই নয়, কীর্তনখোলাবিধৌত বরিশাল শহরের নৈসর্গিক পরিবেশের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। প্রভাতকুমার লিখেছেন,'খালবিল নদীনালা বন বনানীঘেরা প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত জেলা শহরটির সঙ্গে দূরদূরান্তের গ্রামগুলির যোগাযোগ আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ দিয়ে গাঁথা।…গাঁ-গৃহস্থবাড়ি গাছপালা শস্য ফসলঘেরা মনোরম পটে লেখা মফস্বল শহরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ (বঙ্গাব্দ ১৩০৫ ফাল্গুন ৬) শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।'
আবু হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত 'জীবনানন্দ দাশ: মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার' বইতেও অশোকাননন্দ দাশের 'জীবনানন্দের প্রাকৃতিক ও পারিবারিক পরিবেশ' শিরোনামে যে নিবন্ধ ছাপা হয়, সেখানেও ওই একই তথ্য রয়েছে যে, জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন। জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠ সহচর সঞ্জয় ভট্টাচার্যও সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ১৮৯৯ সালের ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ পূর্ববঙ্গের বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দ বিষয়ে মার্কিন গবেষক ক্লিন্টন বি সিলির গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, 'বরিশালের স্কুলশিক্ষক ও ব্রাহ্ম যাজক সত্যানন্দ দাশ ও তাঁর স্ত্রী সাময়িক কবি ও পুরোপুরি গৃহিণী কুসুমকুমারী দাশের ঘরে বাংলা ১৩০৫ সনের ফাল্গুন মাসের ৬ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ দাশ।'
আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং আবুল হাসনাত সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থে তার জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে আরও যেসব লেখক জীবনানন্দের জন্মবৃত্তান্ত লিখেছেন, তারা সবাই জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করেছেন।
ড. আকবর আলি খান লিখেছেন, 'জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ এবং মা কুসুমকুমারী দাশ উভয়ই বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের পৈতৃক নিবাস বরিশালের বিখ্যাত গৈলা (আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়ন) গ্রামে। জীবনানন্দের মাতামহ চন্দ্রনাথ দাশ বরিশাল শহরের কালেক্টরিতে কাজ করতেন। ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি পৈতৃক গ্রামে যাওয়া-আসা বন্ধ করে দেন। তাই পিতামহ বা মাতামহের গ্রামে যাওয়া-আসার সুযোগ জীবনানন্দের ছিল না। গ্রামের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল অতি ক্ষীণ।'
কিন্তু তারপরও কেন জন্মস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি?
২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর দেশের জনপ্রিয় সংবাদপত্র প্রথম আলোয় 'জীবনানন্দ দাশের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ' শিরোনামে একটি খবরে লেখা হয়: ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধানসিঁড়ি নদী। নদীতীরের গ্রামটিতে একটি পরিত্যক্ত ভিটায় রয়েছে কিছু গাছপালা। পুকুর থাকলেও ঘাট ভাঙাচোরা। স্থানীয়ভাবে এটি 'দাশের ভিটা' নামে পরিচিত। এটাই রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের পৈতৃক ভিটা।
এই সংবাদে আরও লেখা হয়, জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোর এমনকি যৌবনের অনেক সময় পার হয়েছে বামনকাঠি গ্রামে। তাঁর পৈতৃক ভিটা দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটক। তবে এই বিরান ভিটা দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় থাকে না।
বামনকাঠি এলাকার রমজান আলী (৭০) নামে একজনের ঊধ্বৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে, ৩০ বছর আগেও দাশের বাড়িতে অধি দাশ ও ভোলা দাশ নামে কবির দুই জ্ঞাতি সপরিবার বসবাস করতেন। তখন একটি ডাকাতির ঘটনায় দুই ডাকাত গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার পর তাঁরা পুলিশি হয়রানির ভয়ে ঘরবাড়ি বিক্রি করে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে ছাড়া ভিটায় পরিণত হয়েছে কবির জন্মস্থান।
২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো এবং দেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাকেও জীবনানন্দের জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে বলে ছাপা হয়। ওই সংবাদ ও নিবন্ধগুলোর লেখকদের দাবি, 'জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ১০ বছর পর বাবার শিক্ষকতার সুবাদে বরিশালে বসবাস শুরু করে কবি পরিবার।' এই লেখায় কবির মা কুসুমকামারীর জন্মস্থানও বামনকাঠি গ্রাম বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও কুসুমকুমারীর পৈত্রিক নিবাস যে ছিল বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে—তা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত।
ধানসিড়ি ও বামনকাঠি:
প্রশ্ন হলো, কেন জীবনানন্দের জন্মস্থান এই ধানসিড়ি নদী তীরের গ্রাম বামনকাঠিতে উল্লেখের প্রবণতা? প্রথম কারণ ধানসিড়ি নদী। জীবনানন্দ মৃত্যুর পরে শঙ্খচিল শালিকের বেশে ধানসিড়ির তীরে ফিরে আসতে চান বলে একটি কবিতায় উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া তার কবিতায় অনেকবারই এই নদীর নাম এসেছে। বরিশালের পার্শ্ববর্তী জেলা শহর ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই নদীটি মূলত একটি খাল। ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই জলধারা খুব একটা আকর্ষণীয়ও নয়। বরং নদীর কোনো কোনো অংশ এখন মরাখাল। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে এই খালটি বড়সর পরিসরে একবার খনন করা হয়েছিল। তারপর বহু বছর এক অর্থে অবহেলায়ই ছিল। সম্প্রতি এটি খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু খননকাজে অনিয়মের অভিযোগও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।
ছোটবেলায় আমরাও এ কথা শুনতাম যে, জীবনানন্দের জন্ম এই নদী তীরবর্তী একটি গ্রামে। কিন্তু তার জীবনী গ্রন্থ এমনকি তার নিজের ও আত্মীয়-স্বজনের লেখায় কোথাও এটি উল্লেখ নেই যে, তার জন্ম ঝালকাঠিতে। এমনকি ঝালকাঠিতে তার কোনো আত্মীয়ের বাড়ি ছিল, এমন কোনো তথ্যও কোথাও পাওয়া যায় না। তাছাড়া ধানসিড়ি নদীর নাম তিনি একাধিক কবিতায় উল্লেখ করেছেন বা তিনি মৃত্যুর পরে এই নদীটির তীরে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন বলেই যে তার জন্ম এই নদীর পাড়ে হতে হবে, এটিও যৌক্তিক নয়। কেননা, তিনি আরও অসংখ্য নদীর নামই তার কবিতায় উল্লেখ করেছেন।
জীবনানন্দ বরিশাল শহর থেকে স্টিমারে খুলনা হয়ে কলকাতায় যেতেন। তখন এটিই ছিল বরিশাল-কলকাতার সহজ রুট। সম্ভবত এই যাওয়া-আসার পথে তিনি ধানসিড়ির নাম জেনেছেন এবং নামটি তার পছন্দ হয়েছিল বলে এটি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। ক্লিনটন মনে করেন, ধানসিড়ি আসলে বাংলার প্রতীক। ১৯২৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য তিনি যেহেতু বাগেরহাটের পিসি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন, তাই বরিশাল থেকে এখানে যাওয়া-আসার পথে ধানসিড়ি নদীর সঙ্গে হয়তো তার পরিচয়।
জীবনানন্দ যখন জন্মেছেন তখন আলাদা করে ঝালকাঠি কোনো জেলা শহর ছিল না। বরং এটি ছিল বরিশালেরই অংশ। ফলে জীবনানন্দের জন্মস্থান হিসেবে বৃহত্তর অর্থে বরিশাল লেখা হলেও কার্যত তার জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে বলে অনেকে দাবি করলেও এই যুক্তিও ধোপে টেকে না কারণ জীবনানন্দের আপন ছোট ভাইও লিখেছেন তার জন্ম বরিশাল শহরে
যারা দাবি করেন, জীবনানন্দের জন্মের ১০ বছর পরে বাবা সত্যানন্দের শিক্ষকতার সুবাদে তার পরিবার বরিশাল শহরে আসেন, সেই তথ্যও সঠিক নয় এ কারণে যে, সত্যানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন স্কু্লে শিক্ষকতা করেন জীবনানন্দের জন্মের অনেক আগে থেকেই এবং তার পিতামহ সর্বানন্দের সময় থেকেই তারা বরিশাল শহরের বাসিন্দা। তাছাড়া বরিশাল শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে, যখন বরিশাল থেকে ওই গ্রামে যেতে কালিজিরা এবং গাবখান নামে দুটি নদী ও চ্যানেল পাড়ি দিতে হতো (পরবর্তীতে সেতু হয়েছে), এরকম যোগাযোগ ব্যবস্থায় সত্যানন্দের বরিশাল-ঝালকাঠি যাতায়াত করে শিক্ষকতা করা অসম্ভব ছিল। তাছাড়া সত্যানন্দের জীবনে এরকম কোনো তথ্য জানা যায় না। এরকম কোনো তথ্যও জানা যায় না যে, সত্যানন্দ একা বরিশাল শহরে থাকতেন। তাছাড়া যদি জীবনানন্দে পূর্বপুরুষেরা বামনকাঠি গ্রামে বসবসা করতেন, তাহলে সেই তথ্য জীবনাননন্দ এবং তার আত্মীয়স্বজনদের না জানার কথা নয় এবং কোনো না কোনোভাবে এই গ্রামের নামটি তাদের লেখা ও স্মৃতিচারণায় উঠে আসতো। কিন্তু কোথাও বামনকাঠি শব্দটির অস্তিত্ব নেই।
দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেয়া হয় যে, সত্যানন্দ এবং তার স্ত্রী কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল শহরেই থাকতেন কিন্তু জীবনানন্দের জন্মের সময় কুসুমকুমারী বামনকাঠি গ্রামে তার কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন, সেক্ষেত্রে বামনকাঠি গ্রামে তার কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি থাকার কথা। কিন্তু জীবনানন্দের জীবনীতে বা তার আত্মীয়-স্বজনের লেখায় এরকম কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ পিতৃ কিংবা মাতৃকুল—কোনো পক্ষের সাথেই ঝালকাঠি শহর বা তৎকালীন এই মহকুমার সাথে জীবনানন্দের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল—তা প্রমাণ করা কঠিন। বছর কয়েক আগে ধানসিড়ি নদী ও বামনকাঠি এলাকায় একটি সড়কের নাম দেয়া হয়েছে জীবনানন্দ সড়ক। তার নামে পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই সড়ক হতে পারে। কিন্তু তাতে এটি প্রমাণিত হয় না যে, জীবনানন্দের জন্ম বরিশাল শহরের বাইরে অন্য কোথাও।