সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ: চিন্তা, বিবেক, বাক-স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
১৯৭০ এর নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু, তাঁর দল আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতাকে পাকিস্তানের পরবর্তী সংবিধান রচনার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার জন্য সাংবিধানিক কাউন্সিল' গঠন করা। কিন্তু, পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ভুট্টো ও সামরিক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে উল্টো এদেশ জুড়ে গণহত্যা চালায়। ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। তারপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সংবিধান সাংবিধানিক কাউন্সিলে পাস করা হয়। ১৫৩ অনুচ্ছেদের এই সংবিধান পৃথিবীর কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে সামনে আসে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটা লিখিত সংবিধান গ্রহণ করার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু সরকারের। সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী যাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই স্বীকার করেন, এই সংবিধানের বহু অনুচ্ছেদে মানুষের চিন্তা, বিবেক ও মত-প্রকাশের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তা অনন্য। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের উদাহরণ এখানে টানা যায়।
৩৯ অনুচ্ছেদের শিরোনাম করা হয়েছে, "চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা"
৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল।
এই হলো দেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ব্যক্তির চিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। এই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশ সকল ঘটনার উৎস। এই অংশে এমন কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার বহুমাত্রিক অর্থ। একে প্রশাসন এবং নির্বাহী বিভাগ অপপ্রয়োগ করতে পারে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা তার অন্তরায় হতে পারে। ৩৯ এর (২) ধারা (ক) ও (খ) কে ব্যাহত করে বা করতে পারে। এটা এক ধরনের সংঘাত। আমাদের উচ্চ আদালতের বহু আগেই উচিত ছিল, এই সংঘাত নিরসনে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করা।
'নৈতিকতা', 'শালীনতা', 'বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক', 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তা' ইত্যাদি বিষয়গুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে পরবর্তীতে আরো কিছু আইন তৈরি করা হয়েছে। যদিও ৩৯ অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটিতে ''সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হইল" বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাহলে সংবাদপত্রের মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক আইন কী করে প্রয়োগ করা যায়? উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা নেওয়া হয়েছে কিনা? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারার ''ক" ও ''খ" উপধারার স্পষ্ট লংঘন বলে প্রতীয়মান হয়।
সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ''মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হইবে"। এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উচ্চ আদালতের নাই। দেশের সংবিধান রক্ষা করার দায়িত্ব এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয়ে সৃষ্টি হলে তা, দেখার কথা আদালতের। সংবিধান সে দায়িত্ব আদালতকে প্রদান করেছে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বেশ কিছু বিষয়ে আদালতকে পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। পঞ্চম সংশোধনীর সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে আদালত ভূমিকা পালন করেছে। আদালতের উচিত, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এমনই কিছু সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা তৈরি করা।
আমরা এবার একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেছি। মার্কিন সিনেটে যখন দ্বিতীয়বারের জন্য ট্রাম্পকে ইম্পিচমেন্ট ভোটাভুটি চলছে, তখন ট্রাম্পের আইনজীবীরা সিনেটের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১ নম্বর সংশোধনী তুলে ধরেন। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সংশোধনীতে সংবিধান মানুষকে 'যে কোন বিষয়ে কথা বলার অধিকার দিয়েছে'। সেই কথার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যদি কেউ অপরাধ সংগঠিত করে তাহলে সে অপরাধের দায়ভার কেবল যিনি বা যারা অপরাধটি সংঘটিত করেছেন, তার বা তাদের। কে কি বলেছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ আমাদের দেশে এক ধরনের আইনি ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে, যাকে বলা হয় 'হুকুমের আসামি'। কেউ একজন কোনো একটি বক্তব্য দিয়েছেন এবং সে কারণে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তার দায়ভার 'বক্তব্য' প্রদানকারী ব্যক্তির হতে পারে।যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের আইনজীবীদের প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যা গৃহীত হয়নি, তবে সিনেটে ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টও গৃহীত হয়নি।
জানুয়ারি মাসের সেই ঘটনায় সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। যখন ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ হলো তার আগে পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিভাবে সেই ঘটনার উস্কানি দিচ্ছিল। তার পরেও মার্কিন ব্যবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ইনভেস্টিগেশন অর্থাৎ জিজ্ঞাসাবাদের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ দিয়ে এটুকু প্রমাণ হয় যে, ফ্রিডম অফ স্পিচের জায়গাটাকে মার্কিন সমাজ-রাষ্ট্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ধারন করে।
ব্রিটিশ রাজপুত্র হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান সাম্প্রতিক অভিযোগ করেছেন, ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো তাদের ব্যক্তিজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। যেকারণে তারা রাজপরিবারের সদস্যপদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা রাজপ্রসাদ ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন করে এখন অনেক 'শান্তিতে' আছেন। যদিও এ ট্যাবলয়েটগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছে বলেও ব্রিটিশ জনগণের একটি অংশ মনে করা সত্ত্বেও, পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা যায়নি। আদালতে মামলা হলে মামলার নিষ্পত্তি হবে, কিন্তু তার আগে পত্রিকা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। যেখানে একই জায়গায় ৩৯ অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় অংশে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে তার ভেতর থেকেই ডিজিটাল আইনের জন্ম হয়েছে। যে কারণে ৩৯ অনুচ্ছেদের এই দ্বিতীয় অংশটি সংশোধিত হওয়া উচিত অথবা সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ সবারই এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার, যেন আরেকজন মুশতাকের জীবনাবসান না ঘটে ।
লেখক মুশতাকের মৃত্যুর ঘটনায় কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, যে কোনো আইনের একটা সাধারণ নির্দেশনা বা গাইডলাইন থাকে যেমন, কতদিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে, কতদিনের মধ্যে বিচার করতে হবে, জামিন হবে কিনা ইত্যাদি; যার অধিকাংশ আমাদের দেশে পালিত হয় না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে বলা আছে, সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। কিন্তু, নানাবিধ কারণে প্রায়ই আমরা দেখি, আইনে নির্দিষ্ট থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকর করা হয় না। অর্থাৎ সময়ের ক্ষেত্রে যে নির্দেশনা থাকে তা অনুসরণ করা হয় না। সময়ের এই সীমাটা মেনে চলাটা 'বাধ্যতামূলক' কিনা তা উচ্চ আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।
সংসদে আইন করার সময় এই সময়সীমার ক্ষেত্রে অন্তত এটুকু করা যেতে পারে, নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যে তদন্ত শেষ করা না গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পাবেন। তদন্ত শেষ হয়নি অথচ, বছরের পর বছর জেলখানায় কাটাচ্ছেন বহু মানুষ। এই সব মানুষের দীর্ঘ কারাবাসের দায় থেকে তাহলে রাষ্ট্রকে রেহাই দেয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে এখনও একটি বিশেষ আইন অবস্থান করে, তার নাম ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট। আইনটি এখন তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ এই ধারায় অতীতে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, দীর্ঘকাল যাদেরকে কারাগারে আবদ্ধ রাখা হয়েছে, তারা প্রায় ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালত কর্তৃক রিট আবেদনের মাধ্যমে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। বর্তমানে এটি প্রায় অকার্যকর অবস্থায় আছে। গতকালের সংবাদপত্র পরিষদের সম্পাদকমণ্ডলী আইনটি সংশোধন করার জন্য একটি দাবি তুলেছেন। তারা যে সমস্ত ধারা সমূহের কথা বলেছেন- ঐ সমস্ত ধারা সমূহ পাল্টে দেওয়ার পরেও হয়তো নতুন কোনো ধারা সংযোজন করা হতে পারে। যার অর্থ দাঁড়াবে, সে জন্য এই সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের (২) ধারাটি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ সাপেক্ষে- এই অংশটিকে পুনর্গঠন করা অত্যন্ত জরুরি।