জীবনানন্দ আর কাফকা
১.
একজনের জন্ম প্রাগ শহরে ১৮৮৩।
একজনের জন্ম বরিশাল শহরে ১৮৯৯।
সময়ের দূরত্ব ১৬।
স্থানিক দূরত্ব ৭১০০ কিলোমিটার।
একজন লিখতেন জার্মান ভাষায়।
একজন লিখতেন বাংলা ভাষায়।
প্রথমজন দ্বিতীয় ব্যক্তির কোনও বই পড়েননি।
দ্বিতীয়জন প্রথম ব্যক্তির বই পড়েছেন?
দুজনেই আইন নিয়ে পড়েছেন, চাকরিতে মন বসাতে পারেননি, ডায়েরি লিখেছেন।
সামান্য সময়ের জন্য হলেও ইনশিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুজনেই।
একজনের জীবিতকালে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৩, উপন্যাস শূন্য।
একজনের জীবিতকালে প্রকাশিত গল্প ও উপন্যাসের সংখ্যা শূন্য।
একজন কবিতা লেখেননি।আর একজন কবিতা লিখেছেন।কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
একজন বারবার সমস্ত লেখা পুড়িয়ে ফেলতে বন্ধুকে অনুরোধ করছেন।
একজনের গল্প ও উপন্যাসের চরিত্র তাদের লেখা পোড়াচ্ছেন। ডায়েরিতে লেখার খাতা হারিয়ে ফেলবার কথা ও নষ্ট করে ফেলবার কথা লিখছেন।
দুজনেরই যৌনতা নিয়ে অহরহ ভয়। ব্যর্থ যৌনজীবন ও ক্ষণস্থায়ী যৌনজীবন। ব্রথেলে যাচ্ছেন দুজনেই।
দুজনেরই জীবনে আলাদাভাবে তিনজন মহিলা দীর্ঘ প্রভাব ফেলেছে।
কাফকার জীবনে ফেলিস বাউয়ার, ডোরা ডায়মন্ট ও মিলেনা য়েসেনেস্কা।
জীবনানন্দ দাশের জীবনে মনিয়া, শোভনা মজুমদার ও লাবণ্য দাশ।
কাফকার লেখার একটি চরিত্র যেন কাফকার কথা বলছে:
'ডানে বাঁয়ে কোনো দিকে আমার নিস্তার নেই- সোজা সামনে শুধু, ক্ষুধার্ত পশু, ওখানেই আছে আহার্যের দিককার রাস্তা, যা তোমাকে টিকিয়ে রাখবে; বাতাস, যাতে তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারো, মুক্ত এক জীবন, এমনকি তা যদি তোমাকে জীবনের সীমান্ত পার করে নিয়ে যায় খুঁজে পাবে তাও।'
জীবনানন্দ ডায়েরি ও গল্প-উপন্যাসে এমন সমধর্মী পংক্তির অহরহ দেখা মেলে।ডায়েরিতে লিখছেন:
'জীবনটা যেন একটা পচা পাকা মিষ্টি আলুর (শাগালু) মতো গলে গলে যাচ্ছে।' উপন্যাসে লিখছেন, 'একটা গাছের জীবন অবধি আজ আর স্বাধীন নয় --- নিজের ইচ্ছেয় সে বাড়তে পারে না,জন্মাতেও পারে না, মানুষ এসে তার মাপ নেয় ---কেটে ফেলে টিম্বার তৈরি করে'।
একজন বেঁচেছেন ৪০ বছর,একজন ৫৫।
দুজনেই বারবার অপরাধবোধ, বিচ্ছিন্নতা, অ্যাবসার্ডিটি ও উদ্বেগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন।একটা অহেতুক ভয় দুজনকেই তাড়া করে ফিরেছে।
দুজনেই নাজুক, গুটিয়ে রাখা স্বভাব আর ভূতগ্রস্তের মতো পড়ুয়া।
দুজনেই প্লেটো পড়ছেন,সেন্টিমেন্টাল এডুকেশন পড়ছেন, দস্তয়েভস্কি পড়ছেন।
কাফকা ভাবছেন যে তিনি বিপন্ন, ত্রস্ত ও অবলম্বনহীন। কাফকা যে প্রায় বাতিকগ্রস্ত ডায়েরি পড়লে তা টের পাওয়া যায়।
জীবনানন্দ ভাবছেন কলকাতা শহর গোয়েন্দাতে ছেয়ে গেছে, যেকোনও মহূর্তে গ্রেফতার হতে পারেন তিনি। ভাবছেন রক্তে কোনও যৌনরোগ বাসা বাঁধেনি তো!ভাবছেন যে কোনও মুহূর্তে অন্ধ হয়ে যেতে পারেন।
তো একজন একটি উপন্যাস লিখবেন। একদিন কয়েকজন এসে ঘরে কড়া নেড়ে 'কে' নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। 'কে' জানে না তার অপরাধ কি, এমনকি তার শাস্তিও হয়ে গেল। উপন্যাসটির নাম 'দি ট্রায়াল'।
আর একজন একটি উপন্যাস লিখবেন বলে ভাবছেন। হুবহু ট্রায়ালের মতোই তার প্লট।
সব যেমন মিল-টিল আছে আবার গোল মিলও একটু আছে।
'দি ট্রায়াল' ইংরেজিতে অনূদিত হয় ১৯৩৭। আর মূল বইটি প্রকাশিত হয় কাফকার মৃত্যুর পর ১৯২৫। জীবনানন্দ তাঁর ডায়েরিতে যে প্লটটি লিখে রাখছেন তা, ১৯৩২-এর ডায়েরিতে।
দু'টো সম্ভাবনা থেকে যায়।
এক, জীবনানন্দ জার্মান ভাষা জানতেন। মূল বইটি তিনি জার্মান ভাষায় পড়েছেন। জীবনানন্দ দাশের গল্পের একটি চরিত্র জার্মান ভাষা জানে বলে দাবিও করে।
দুই, ১৭০০ কিলোমিটার দূরত্বে বসেও দুটি ভাষার লেখক ১৮ বছরের সময়ের ব্যবধানে প্রায় একইরকম ভাবছেন।
দ্বিতীয় সম্ভাবনার দিকে যেহতু পাল্লা ভারি বলেই আমার এই দীর্ঘ তুলনা।
আরও আছে।জীবনানন্দ দাশ ডায়েরির পৃষ্ঠায় লেখক ও বইয়ের এক দীর্ঘ তালিকা করছেন। সেখানে কাফকার নাম লিখে খুব বলিষ্ঠ রেখায় ও দ্বিধাহীন মনস্কতায় সে নাম কেটেও দিচ্ছেন। কেটে ঠিক শান্তি পাচ্ছেন না। আবার ক্রস করছেন।
কেন? কাফকা তাঁর ডিস্টার্বেন্সের কারণ? তিনি কাফকাকে ইগনোর করতে চাইছেন? অতিক্রম করতে চাইছেন?
কিছু রহস্য থাকে যায়। থাকা ভাল। বারবার একজন লেখকের কাছে সেজন্যই তো ফিরতে হয়। আমার এই সামান্য জীবন এই দুইজন লেখককে তুলনা করেই হয়তো কেটে যাবে।
আমার খুব প্রিয় একজন বন্ধু প্রশ্ন করেছিল, জীবনানন্দর সঙ্গে কোন বিদেশি লেখকের বেশি মিল! উত্তরে এই কথাগুলো মনে এল। আসলে দু'জনেই গতর খাটিয়ে লিখেছিলেন।
জীবনানন্দের কলমে কাফকার নাম লিখে কেটে দেওয়া।
২.
লোকটার প্রায় কিছুই সংরক্ষণ করা যায়নি।
লোকটার জীবনটাই তো উদ্বাস্তুর।
নিজের ঘরেও সবসময় বহিরাগত।পাসপোর্টহীন।
'মাল্যবান'-এ দেখি স্ত্রী উৎপলা মাল্যবানকে ফুটপাতে গিয়ে শুতে বলছে।মাল্যবান অবাক চোখে তাকিয়ে বললে, কখন যাব!
উৎপলা বললে, এখনই যাও।
ফুটপাতে গিয়ে না শুলেও শেষ অবধি মেসে চলে যায় মাল্যবান।
৫৫ বছরের জীবনে জীবনানন্দ দাশের নিজস্ব একটা বাড়ি কোনওদিনই হয়নি।
এম.এ.পড়তে কলকাতা যাওয়ার আগে একটানা ১৮ বছর আর ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৬ এই ১১ বছর তিনি বরিশালের পৈতৃক ভিটা 'সর্বানন্দ ভবন'-এ সামান্য কিছুদিন থিতু হয়েছিলেন।বাকি জীবনটা তো সত্যিই পরগাছার।
ছাত্রজীবন ও সিটি কলেজের টিউটর জীবনে তো ৬/৭ বার বাড়ি বদল করেছেন।কিছুদিন ছিলেন বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের একটা ভাড়া বাড়িতে।
দিল্লি, বাগেরহাট, খড়গপুর কোথায় না ডেরা পেতেছেন! বোর্ডিঙের দুঃসহ দোদুল্যমান ৫/৬ বছরের জীবন! ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪,এই ৯ বছরের জীবন তো নরকযন্ত্রণার।নরকযন্ত্রণাই যে তার সাক্ষী কবির শেষজীবনের বিভিন্ন স্মৃতিচারণায়।
হয়তো মৃত্যুই হত না তাঁর যদি বোন সুচরিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেহালার দিকে যে জমি দেখতে যেতেন,এবং সত্যিই সেখানে জমি যদি পেয়ে যেতেন।
এতদূর অবধি অনিশ্চিত জীবন যে একটি চিঠিতে লিখছেন,পরবর্তী চিঠি আমাকে আর এই ঠিকানায় পাঠাবেন না।
তো চালচুলোহীন এই লোকটার কী আর সংরক্ষণ হবে!নিজস্ব থাকার বলতে তো কালো কয়েকটা ট্রাঙ্ক,যা তিনি বুকে আগলে রাখতেন।
তাও তো মৃত্যুর পর সব লুটপাট হয়ে গেল।
কিছু খাতা হারিয়ে গেল, কিছু খাতা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেল।জিনিসপত্র যে কোথায় গেল!
হাতে থাকল পেনসিল। একটা কলম, একটা ব্যবহৃত বই, একটা শার্ট, একটা চুরুট, একটা আধপোড়া সিগারেট কোথাও সংরক্ষণ হল না।
যে দু'টো বাড়িতে জীবনানন্দ জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন, একটি বরিশাল ও একটি কলকাতা, তার একটি তো ১৯৬৪-র ঝড়ে ভেঙে পড়েছে, আরেকটিতে বাড়ির মালিকানার পরিবর্তন হওয়ার পর বর্তমান মালিক সবাইকে কুকুরবেড়ালের মতো তাড়িয়ে দেয়।
পাঠকের ইচ্ছে হবে না,'মাল্যবান' ঠিক কোন ল্যাটিচুড লঙ্গিচিউডে বসে লেখা!
ইচ্ছে হবে না, ড্যাব ড্যাব করে কোথায় বসে তিনি সাবলেট করা মহিলার বাড়িতে বেড়াতে আসা মেয়েদের দেখতেন!(সাবলেট করা মহিলা একটি সাক্ষাৎকারে একথা জানিয়েছেন)
মাল্যবান ও উৎপলার খাটের দূরত্ব ঠিক কতটুকু ছিল! কোথায় অপরেশ সাইকেলটা রাখত।
না কোনও ইউনিভার্সিটি, না কোনও সরকার,না কোনও প্রতিষ্ঠান কেউ লোকটার পাশে নেই।
কোনও লবি নেই। গোষ্ঠী নেই। দাদা নেই।
তিনি জানতেন 'প্রফেসর' আসলে 'ফুঃ'!
লোকটা একা।
বড্ড একা।
আজও একা।
গায়ে একটা চাদর নেই। পায়ে কোনও মোজা নেই। পরকালে তো বিশ্বাস ছিল না লোকটার। একটু তিল ও কুশও কোথাও দেওয়া নেই।
একটা পোক্ত চেয়ারের কথা লিখেছিলেন। ডায়েরিতে লিখেছিলেন, লেখার জন্য একটা পোক্ত চেয়ার চাই।চামড়া সিগারে পোড়ালে তবে সেই চেয়ারে বসে লেখা হবে।
একটি চেয়ারের সন্ধান পাওয়া গেছে। জীবনানন্দর ব্যবহৃত কিছু বইয়ের। এই চেয়ারটাতে বসেই জীবনানন্দ দাশ বরিশাল পর্বে অনেক গল্প উপন্যাস কবিতা লিখেছেন। বিশেষত কবিতা। বনলতা সেন,ধূসর পাণ্ডুলিপি ও মহাপৃথিবী পর্বের অনেক কবিতাই আমার বিশ্বাস এই চেয়ারটিতে বসে লেখা।
আমরা হতভাগ্য একটা জাতি।
মুঠোয় কিছুই ধরে রাখতে পারি না।
বালি তো অনেক দূর একটি কলমও নয়!'আর্কাইভ' জ্ঞান আমাদের শূন্য। ক্লিন্টন সিলি সুদূর আমেরিকা থেকে এসে গবেষণা করে ফিরে গেলেন সেই ষাটের দশকে আর আমাদের ঘুম ভাঙলো এসে শতবর্ষে।
আবার হয়তো ১৫০ বছরে ঘুম ভাঙবে।
সাহিত্য অকাদেমি নড়েচড়ে বসবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্রান্টের জন্য সুপারিশ করবে।
একটা নির্জন চেয়ার আরও নির্জন হতে থাকবে।
শুধু একটা পোকা গুটিসুটি।
শ্লথ ও বিষণ্ণ।
তবু এগিয়ে যাবে।