সরবরাহ চাপে নিম্নমুখী পেঁয়াজের বাজার, কেজিতে কমেছে ৭-১০ টাকা
দেশীয় পেঁয়াজের ভরা মৌসুম এখন। বুকিং দর কম হওয়ায় ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানিও বেশি হচ্ছে। এতে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হওয়ায় পাইকারি বাজারে কমেছে নিত্য প্রয়োজনীয় মসলা পণ্য ও পেঁয়াজের দাম। গত এক সপ্তাহে ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৭-১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে বলে জানিয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আড়তগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে দেশি, ভারতীয় ও হল্যান্ডের পেঁয়াজ রয়েছে খাতুনগঞ্জে। এর মধ্যে প্রতিকেজি ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজ ৩৫-৩৬ টাকা, খাসখালী পেঁয়াজ ২৯-৩১ টাকা ও বেলেডাঙ্গা ২৮-২৯ টাকয় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ভারতীয় এসব পেঁয়াজের মধ্যে নাসিক ৪২-৪৫ টাকা, খাসখালী ৩৬-৩৭ টাকা ও বেলেডাঙ্গা পেঁয়াজ ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হতো। সেই হিসেবে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে ভারতীয় পেয়াঁজের দাম কমেছে কেজিতে ৮-১০ টাকা।
গত সপ্তাহে বাজারে দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে মেহেরপুর ৩০-৩২ টাকা এবং ফরিদপুর ৪০-৪২ টাকা। এক সপ্তাহে কেজিতে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে প্রতিকেজি মেহেরপুরের পেঁয়াজ ২৬-২৮ টাকা এবং ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সুযোগে এতদিন ৮-১০টি বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি হলেও বর্তমানে শুধু হল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজ রয়েছে বাজারে। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে প্রতিকেজি হল্যান্ডের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫-২৭ টাকার মধ্যে। যা গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৩২-৩৪ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা পণ্যের (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) কমিশন এজেন্ট ও মেসার্স শাহ মুছা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সেলিম উদ্দিন জানান, কাঁচা পণ্যের বাজার পুরোটাই আমদানি ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। নতুন মৌসুমের ফসল উঠায় পেঁয়াজের প্রধান আমদানিকারক দেশ ভারতে পণ্যটির বুকিং দর কমেছে। এতে দেশীয় বাজারে পণ্যটির আমদানি ও সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গত এক-দেড় মাস ধরে বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ রয়েছে প্রচুর। যার ফলে গত একমাস ধরে পণ্যটির দাম নিম্নমুখী রয়েছে বাজারে। এছাড়া সরবরাহ বৃদ্ধিতে গত এক সপ্তাহ থেকে পণ্যটির দাম আরো এক দফা কমেছে বাজারে।
খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্য ব্যবসায়ী মো. আলী আজম বলেন, ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি উম্মুক্ত করা এবং দেশীয় পেঁয়াজের মৌসুমে এখন বাজারে চাহিদার চেয়েও পেঁয়াজের বাড়তি সরবরাহ রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ভারত হঠাৎ হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা বিকল্প দেশ থেকে সহজে পেঁয়াজ আমদানি রপ্ত করছে। এছাড়া এই সংকটের কারণে দেশীয় কৃষকরাও পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। ফলে গত কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়নি। এরমধ্যে দেশীয় মৌসুম ও ভারতীয় মৌসুমের পেঁয়াজের সরবরাহ বৃদ্ধিতে পেঁয়াজের বাজার কমতির দিকে রয়েছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে ভারতীয় জাত সুখ সাগরের ফলন উঠা শুরু করলেও বাজার আরো কমতে পারে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে তথ্যমতে, ভারতের রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর থেকে ১১টি দেশ থেকে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ৪৭ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। যা দিয়ে সংকটকালীন মুহুর্তে দেশের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। বিকল্প দেশগুলো হলো চীন, মিয়ানমার, পাকিস্তান, মিশর, আরব আমিরাত, তুর্কি, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ইউক্রেন, মালেশিয়া। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ এসেছে পাকিস্তান এবং মিশর থেকে।
খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্লাহ মার্কেট কাঁচাপণ্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: ইদ্রিচ বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় গত পাঁচ মাসে বাজারে পেঁয়াজের অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। এরমধ্যে কাঁচাপণ্যের নিয়মিত ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু মৌসুমী ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানি করেছে। এতে কেউ কেউ লাভের মুখ দেখলেও বেশিরভাগ আমদানিকারককে বড় অংকের লোকসান গুনতে হয়েছে।
দি চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, প্রায় প্রতি বছর দেশী মৌসুমের সময় পেঁয়াজের বাজার সর্বনিম্নে চলে আসে। এবারেও দেশীয় পেঁয়াজের মৌসুম শুরু শুরু হওয়ার পর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা পেঁয়াজ রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে ভারত। ভারতীয় বাজারে বুকিং দর কম হওয়ায় আমদানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে প্রতি বছরের ন্যায় দেশীয় উৎপাদন মৌসুমে পণ্যটির দাম কমে আসছে। যাতে লোকসানে পড়বে দেশীয় কৃষকরা।
বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তর ও টিসিবির তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২২-২৩ লাখ মেট্রিকটন। এর মধ্যে ২০১৮ সালের হিসেবে দেশে ১৭-১৮ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিকটন। গেল অর্থ বছরে এই উৎপাদনের পরিমান ছিল প্রায় ১৯ লাখ টন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে সংগ্রহোত্তর অপচয় হিসেবে ২৫ শতাংশ অপচয় বাদ দিলে ব্যবহার উপযোগী পেঁয়াজ থাকে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। এদিকে আবাদকৃত পেঁয়াজের প্রায় ২ শতাংশ পরবর্তী বছরের বীজের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সেই হিসেবে, প্রায় প্রতি বছর ৯-১০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তবে আমদানিকৃত পেঁয়াজেও সরবরাহ ও বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ অপচয় হয়।