ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা: ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ সদস্য
ব্রিটিশ রাজবধূ, ডাচেস অফ সাসেক্স, মেগান মার্কেল সম্প্রতি টকশো হোস্ট অপরাহ উইনফ্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন রাজপরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকার কারণ। সাবেক অভিনেত্রী ও ব্রিটিশ রাজপরিবারের এই আমেরিকান সদস্যকে নিয়ে এখনো চলছে তুমুল আলোচনার ঝড়। কেন? কারণ অপরাহ'র শো তে মেগান এই তথ্য ফাঁস করেছেন কীভাবে নিজের গায়ের রঙ এর জন্য বাকিংহাম প্যালেসে বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন তিনি।
মেগান এও জানিয়েছেন যে রাজপরিবার তখন তার অনাগত সন্তান আর্চির গায়ের রঙ নিয়েও চিন্তিত ছিল। তারা তাকে আখ্যা দিয়েছিল 'কালো নারী' হিসেবে।
তবে ডাচেস অফ সাসেক্সই কিন্তু বাকিংহাম প্যালেসের একমাত্র 'অশ্বেতাঙ্গ রাজসদস্য' নন। দ্য কুইন্ট এর এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
ভারতবর্ষের কুর্গ রাজ্যের এক খ্যাতিমান রাজকুমারীর কী অবস্থা হয়েছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের হাতে পড়ে সে খবর অনেকেরই অজানা
আজ আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্র কুর্গ রাজ্যের সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারী ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা। গৌরাম্মাই প্রথম ভারতীয় রয়্যাল যাকে বাকিংহাম প্যালেসে খ্রিস্টান বানানো হয় ব্যাপটাইজড করার মধ্য দিয়ে।
বেনারস থেকে ব্রিটেন
সালটা ছিল ১৮৩৪। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ২৪ এপ্রিল দক্ষিণ ভারতের কুর্গ রাজ্য চলে গেল ব্রিটিশদের অধীনে। পরাজিত কুর্গ রাজা চিক্কা ভিরারাজেন্দ্র সিংহাসনচ্যুত হয়ে পালিয়ে গেলেন বেনারসে (বর্তমান বারানসী)।
১৮৫২ সালের মার্চে নির্বাসিত রাজা ভিরারাজেন্দ্র তার একজন ভালো ব্রিটিশ বন্ধু ও চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম জেফারসনের সহায়তায় লন্ডন চলে যান। রাজার মনে ছিল দুটি বাসনা। তার একটি হলো তিনি ভারতের ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করবেন। আর অন্যটি হলো নিজের ১১ বছর বয়সী কন্যা গৌরাম্মাকে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে দত্তক দিবেন তার একটি সুন্দর-নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায়।
নির্ধারিত হয়ে গেল রাজকুমারী গৌরাম্মার ভবিষ্যত...
১১ বছর বয়সী গৌরাম্মা যখন লন্ডনের রাজপ্রাসাদে পা রাখেন তখন রানী ভিক্টোরিয়া পরম উৎসাহে এই বাবা-মেয়েকে বরণ করে নিয়েছিলেন। রানী গৌরাম্মার ধর্মমাতা হবার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাকে নিজের নাম দিতেও দ্বিধা বোধ করেননি।
গৌরাম্মা ও তার পিতাই ভারতের প্রথম রাজসদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যে পা রাখেন। ১৮৫২ সালের ৫ জুলাই প্রথম ভারতীয় রাজকুমারী হিসেবে গৌরাম্মা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। বাকিংহাম প্যালেসের আর্চবিশপ অফ ক্যান্টারবারি তাকে 'ভিক্টোরিয়া' নাম দিয়ে ধর্মান্তকরণ এবং ব্যাপটাইজড করেন। এভাবেই গৌরাম্মা হয়ে ওঠেন রাজপরিবারের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ সদস্য।
গৌরাম্মা থেকে ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা, এক দীর্ঘ-কঠিন যাত্রা...
মিসেস ড্রুমন্ড এবং মেজর ড্রুমন্ড নামের একটি ভারতীয় জুটি প্রথমে গৌরাম্মার দায়িত্ব নেন। তারা তাকে পশ্চিমা রীতিনীতি ও লেখাপড়া শেখান। তারপর খুব শীঘ্রই এই পালক পরিবার থেকে মূল পরিবারে স্থানান্তর ঘটে গৌরাম্মার।
বিভিন সূত্র থেকে জানা যায়, গৌরাম্মা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন না। তাকে প্রায়ই রাজকীয় বলনাচ কিংবা অনুষ্ঠানে ইংরেজদের সাথে পানাহার করতে ও নাচতে দেখা যেত। নিজের জীবনে কাগজের চুক্তিপত্রের হিসেবে এটি স্বভাবতই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বাকিংহাম প্যালেসে সম্মানের সহিত রাজকীয় জীবনযাপন করলেও গৌরাম্মাকে ভুল পথে ধাবিত করা হয় এবং তাকে ভুল বোঝা হয়েছিল। ফলে তিনি নিজের ভেতরে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। একই সাথে তার শারীরিক অবস্থারও ক্রমেই অবনতি ঘটতে শুরু করে। সেসময় প্রতিদিনই তার কাশির সঙ্গে রক্ত যেত।
অন্যান্য অশ্বতাঙ্গ রাজসদস্যরা
বাকিংহাম প্যালেসে গৌরাম্মাই একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি ছিলেন না। নিজের সাম্রাজ্যকে মানবহিতৈষী রূপে তুলে ধরতে সেসময় রানী ভিক্টোরিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা স্থান থেকে আরো অনেক কিশোর-কিশোরীদের দত্তক নেন। এদের মধ্যে বাকিং হাম প্যালেসে ছিলে মহারাজা দুলীপ সিং এবং সারাহ বনিতা ফোর্বস।
একটি ব্যর্থ জুটি এবং অশান্তিপূর্ণ বিয়ে...
১৫ বছর বয়সে শিখ সাম্রাজ্যের শেষ রাজা মহারাজা দুলীপ সিং পরাজিত ও নির্বাসিত হয়ে লন্ডন চলে আসেন এবং রানী ভিক্টোরিয়া তাকে দত্তক নেন। পরবর্তীতে তিনি 'দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স অফ পার্থশায়ার' নামে পরিচিত হন।
রানী এবং রাজপরিবারের বাকিরা মিলে এবার কিউপিডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন এবং তারা গৌরাম্মার সঙ্গে দুলীপ সিং এর বিয়ে ঠিক করলেন।
সি পি বেলিয়াপ্পার লেখা বই 'ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা: দ্য লস্ট প্রিন্সেস অফ কুর্গ' থেকে জানা যায়, রানী ভিক্টোরিয়া ভেবেছিলেন যে গৌরাম্মার সঙ্গে দুলীপ সিং এর বিয়ে হলে তারা ভারতে এসে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে সাহায্য করবেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুলীপ এবং ভিক্টোরিয়ার মধ্যে যখন পরিচয় হয় তখন তারা একে অন্যের প্রতি কোন আকর্ষণ অনুভব করেননি। তাদের দুজনের মনে হয়েছিল যে তারা একে অপরের জন্য সঠিক ব্যক্তি নন। তবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল আজীবন। মহারাজা গৌরাম্মাকে 'ভবিষ্যত স্ত্রী' এর চাইতে 'সম্মানীয় বোন' হিসেবেই ভেবেছিলেন।
১৮৬০ সালে ১৯ বছর বয়সে গৌরাম্মা ৫০ বছর বয়সী ব্রিটিশ আর্মি কর্ণেল জন ক্যাম্পবেলের প্রেমে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করেন। পরের বছর গৌরাম্মা তার কন্যা এডিথ এর জন্ম দেন। কিন্তু অতি শীঘ্রই গৌরাম্মা বুঝতে পারেন যে তার স্বামী একজন জুয়াড়ি ছাড়া আর কিছুই নয় যে শুধুমাত্র গৌরাম্মার টাকাকেই ভালোবাসে।
ভুল বোঝাবুঝি, প্রতারণার শিকার ও একাকীত্ব
ডা. প্রিয়া আতওয়াল বেশকিছু টুইটের মাধ্যমে সেই সময় বাকিংহাম প্যালেসে গৌরাম্মার অবস্থার বর্ণনা দেন।
দ্য কুইন্ট এ ডা. আতওয়াল লিখেন, 'ভিক্টোরিয়ার নাম বহন করাই যেন গৌরাম্মার কাঁধে একটা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।'
রাজকীয় পদ দেয়ার রানী ভিক্টোরিয়ার ধর্মসন্তানদের ব্যাপকভাবে এড়িয়ে চলা হয় এবং তাদেরকে অনেকটা বহিরাগত বলে সম্বোধন করা হয়।
প্রতিবেদনে এও বলা রয়েছে যে গৌরাম্মাকে তার বাবা ও পরিবারের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়া হতো না।
'সম্মানীয়া' রাজকুমারীর সম্মান আর নেই...
গৌরাম্মা একটা পরিবার ও এমন একটা জায়গা চাইতেন যেখানে তিনি ভালোবাসা পাবেন। তিনি শান্ত ও আত্মনির্ভরশীল একটা জীবন চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বিপরীতে তিনি নিজেই হয়ে গিয়েছিলেন একাকী।
গৌরাম্মার স্বামী তাকে ছেড়ে দেন এবং প্রেমহীন বিয়ের ফাঁদে বারবার আটকে যান গৌরাম্মা। ১৮৬৪ সালের মার্চে নিজের ২৩তম জন্মদিনের মাত্র কয়েক মাস আগেই টিউবারকোলসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গৌরাম্মা। সেই সাথে হারিয়ে যায় তার ধনসম্পদ ও মণিমুক্তার গয়না, আর হারিয়ে যায় ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা নামের এক রাজকুমারী।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Meet Victoria Gouramma: The first non-White British Royal
- অনুবাদ: খুশনুর বাশার জয়া