পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন: চোখ রাখতে হবে যেসব সমীকরণে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে এই মাসের ২৭ তারিখ থেকে। ভোটগ্রহণ চলবে প্রায় এক মাস। আট দফায় রাজ্যের ২৯৪ টি আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হবে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ও তার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের যৌথ সিদ্ধান্তে এই দীর্ঘ সময়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ইতিপূর্বে কখনো এত ব্যাপক সময় নিয়ে নির্বাচনের ইতিহাস নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব, রাজ্যের পরিস্থিতি সবকিছু বিবেচনায় রেখেই নির্বাচন কমিশন এই দীর্ঘ সময়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে ব্যাপক দলবদলের পালা। রাজ্যের কলকাতা শহরের মেয়র, মন্ত্রী, বিভিন্ন স্তরের অনেক তৃণমূল নেতা-কর্মী দলবদ্ধভাবে বিজেপিতে যোগদান করছেন।
গতকাল পর্যন্ত ধারণা করা হয়েছিল যে ব্যাপক দলবদলের ভেতর থেকে হয়তো বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মাঠে এক নিরঙ্কুশ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারবে। আগামী নির্বাচনে তারা রাতারাতি ক্ষমতা দখল করবে। বিগত নির্বাচনে তাদের অবস্থা ছিল খুবই সীমিত। মাত্র কয়েকটি বিধানসভার আসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল তারা। সে দিক থেকে বিজেপির উত্থান রাজ্যে ব্যাপক সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিগত দুটি নির্বাচনের আগে অর্থাৎ ২০১৬ এবং ২০১১ সালে যে নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে হয়েছিল দুই ক্ষেত্রেই তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিল।
দলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আসন বরাদ্দ করছিলেন মমতা ব্যানার্জি। মমতা ব্যানার্জির ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে সেই সময় দলটিতে তেমন কোনো প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি ৩০ বয়সের নিচের তরুণী অভিনেত্রীকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এই ধারা এবারকার নির্বাচনে বিজেপি অনুসরণ করেছে। দলে ব্যাপকহারে অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নিয়ে এসে তাদেরকেই মনোনয়ন প্রদান করেছে। বিজেপি এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়েছে বলা যায়। গত দুইদিন পশ্চিমবঙ্গের নানা নির্বাচনী কেন্দ্রে বিজেপি কর্মীদের ব্যাপক প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে এই নবাগতদের মনোনয়নের বিরোধিতা করে।
কংগ্রেস থেকে ব্যাপক নেতাকর্মীর দলত্যাগের মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জিরা তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে তুলেছিল, পশ্চিমবঙ্গে তেমনি একটি কৌশল অবলম্বন করেছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির শাসনামলে সারদা কেলেঙ্কারি নামক বিশাল এক দুর্নীতির খবর সামনে উঠে আসে। সেই সময়ের দ্বিতীয় প্রধান নেতা মুকুল রায়ের নাম এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন পরে দেখা যায় যে মুকুল রায় তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে প্রথমে কিছুদিন নিশ্চুপ থাকে। তাকে ভারতের সিবিআই ও এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টে নানান তদন্তের মুখোমুখি হতে হয় তারপরে সে সবকিছু হঠাৎ থেমে যায় এবং মুকুল রায় ভারতের তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপির পশ্চিমবাংলার হাল ধরেন। মুকুল রায়ের এই ধারায় পশ্চিমবাংলায় অনেকেই তৃণমূল কংগ্রেসে ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করে। এদের মধ্যে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং তার বান্ধবী বৈশাখী চট্টোপাধ্যায়, নন্দীগ্রামের নেতা শুভেন্দু অধিকারী, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী আছেন। এমনকি ভারতীয় ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র পশ্চিমবাংলার সৌরভ গাঙ্গুলীর নামও তাদের তালিকায় উঠে যাচ্ছিল তবে হঠাৎ করে সৌরভ গাঙ্গুলী হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় সম্ভবত সেই প্রচারণা গুজবে রূপান্তরিত হল। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদাধিকারী হিসেবে তার নাম উঠে আসছিল বারবার। এরকম অসংখ্য নাম গত কয়েকমাস ধরে গণমাধ্যম এর মাধ্যমে রাজ্যের জনগণ জানতে পারছে। এই দলত্যাগের পিছনে কারণ হিসেবে প্রায় সকলেই উল্লেখ করেন যে তারা মমতা ব্যানার্জির উত্তরাধিকারীর প্রশ্নে তার ভাতিজা অভিষেক ব্যানার্জীকে মমতা ব্যানার্জির তুলে ধরার ফলে তারা দল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এখন ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে আসলে অভিযোগটা সম্ভবত সত্য নয়। কারণ এদের অনেকে বিজেপিতে তাদের অবস্থান নিয়ে নিজস্ব ইচ্ছার প্রতিফলন না দেখতে পেয়ে বিজেপি ত্যাগ করছেন, তার মধ্যে গতকালকের দলত্যাগী বিজেপি নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তার বান্ধবী বৈশাখী চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। এমন আরও কয়েকটি ঘটনা সামনের দিকে ঘটতে যাচ্ছে। এখন এই নির্বাচনের ফলে পশ্চিমবাংলার গত ৭০ বছর ধরে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ যৎসামান্য গড়ে উঠেছিল তা টিকে থাকবে কি না প্রশ্ন হচ্ছে হচ্ছে সেই জায়গায়।
পশ্চিমবাংলার বামেরা দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জির কাছে ক্ষমতা হারায়। তারপর থেকে বাম রাজনীতির শূন্যতা ক্রমান্বয়ে বিন্দুতে পরিণত হওয়ার দিকে চলছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা ত্রিশের কোঠায় পৌঁছেছিল। এবার তা ধরে রাখার কৌশল হিসেবে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় নেতা ফুরফুরা শরীফের পীরকে সঙ্গে নিয়ে যে জোট কংগ্রেস বামপন্থীরা গড়ে তুলেছে তা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পরিপন্থী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ফুরফুরা শরীফের আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পশ্চিমবাংলার ঘরের মাঠে যে ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটেছে তা বামপন্থীদের কে উৎসাহিত করেছে। তাদের ধারণা, তারা হয়তো সামনের নির্বাচনে অতিরিক্ত কিছু অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকীর সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার ফলে বিজেপির হাতকে শক্তিশালী করা হলো কি-না এ প্রশ্ন নির্বাচনের ফলাফল যেদিন ঘোষিত হবে সেদিন বুঝা যাবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে এই বামপন্থীদের এই কর্মকাণ্ড কেবল যে ক্ষমতাকে ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া তাতে কোন সন্দেহ নেই। ৩৪ বছর বামপন্থীরা ক্ষমতায় থেকে পশ্চিমবাংলা রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য যে সংস্কার সাধন করতে পেরেছিল তা ছিল বর্গাচাষীদের অধিকার। এর বাইরে পশ্চিমবাংলা ৩৪ বছর বাম শাসনের পরিণতিতে তেমন কিছু অর্জন করে নাই। মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসীদেরকে নানানভাবে দলের অনুসারী রাখার চেষ্টা ছাড়া এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়নও তেমন কিছু ঘটে নাই।
বিজেপির এই ব্যাপক উত্থানে আপাতদৃষ্টিতে অবশ্যই এ কথা বলা যায় যে পশ্চিমবাংলায় বাম রাজনীতি ও কংগ্রেসের ব্যর্থতার ফসল বিজেপির উত্থান। মুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায় কে গত ৭০ বছরে মাঠের কৃষক রূপান্তরিত করেছে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি। শতাংশের হারে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ হওয়া সত্বেও ১০ শতাংশের উপরে সরকারি ক্ষেত্রে কোথাও এদের চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে না। পুলিশে ৯ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী কাজ করে আর রাজ্য পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনে দুই থেকে তিন শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী মনোনীত হয়। এদের এই চাকরিতে সমাজের এই অন্যান্য স্থানে জায়গা না হওয়ার কারণ হিসেবে এই বাম কংগ্রেসের ব্যর্থতায় তৃণমূলের ব্যর্থতাই প্রধান কারণ।
বিভিন্ন নির্বাচন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস এখনো ক্ষমতা ধরে রাখার পর্যায়ে আছে। বিজেপির উত্থান ২০১৬ সালের ৩আসন থেকে শতাধিক আসনে পৌঁছাতে পারে কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর্যায়ে পৌঁছনো হবেনা। তবে ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের এক নতুন ধারার সৃষ্টি হবে। পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে যদি তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিহত করতে পারে তবে আগামী ২০২৪ এর ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে তার ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করবে।
ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটছে তাতে করে একথা বলা যায় ১৯৭৫ সালের কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল তারপরে যে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে কংগ্রেস বিরোধী জোট গঠন করেছিল তারই একটি আবহাওয়া চলছে বর্তমানে সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে। কংগ্রেসকে বড় দল হিসাবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী একটি বড় জোট গঠন করার প্রত্যাশা নিয়ে এগোতে হবে। সেই দিক থেকে তারা পশ্চিমবাংলায় ব্যর্থ। পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেসের অবস্থা অনেকটা দক্ষিণ ভারতের মতন অবস্থায় পৌঁছেছে। কংগ্রেস কি বিলুপ্ত হতে চলছে? যেমনি ঘটেছে পাকিস্তানের জন্মকালীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় তেমনি কংগ্রেসকে বিলুপ্ত হবে? কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ফুরফুরা শরীফের আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগ দিয়ে যে সমীকরণ সৃষ্টি করলো তার সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে কোন প্রভাব বিস্তার করবে না। আবার একই সাথে বামপন্থীদের এই উল্টো চলা নীতি কী পরিণতি বয়ে আনবে কলকাতা তথা ভারতীয় রাজনীতিতে তা সময়ের অপেক্ষায়। বিজেপি দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক সৃষ্টি করেছে যশোবন্ত সিং নামক বিজেপি থেকে অপসারিত উত্তর ভারতের এক রাজনীতিবিদ যিনি কিনা অটল বিহারী বাজপায়ী এর সময়ে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তৃণমূলে তিনি যোগ দিয়েছেন । উত্তর ভারতের এই অবাঙালি নেতার তৃণমূল কংগ্রেসের যোগ দেওয়ার ফল কি হয় বোঝা যাবে ২ মে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক